বিজ্ঞানের সফলতম দুটি তত্ত্ব -বিবর্তন” ও সাধারণ-আপেক্ষিকতা, এদের “প্রস্তাবনা ও গবেষণার” ধারাবাহিকতার মধ্যে অদ্ভুত অমিল আছে। চার্লস ডারউইন প্রায় পাঁচ বছর এইচএমএস বিগলের অনুসন্ধান কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন (যদিও ওনার সমুদ্রযাত্রার পুরো সময় আরো কম)। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পর্যবেক্ষণ ও নমুনা সংগ্রহ শেষ হবার পরও, বিবর্তন তত্ত্ব প্রস্তাব করতে ডারউইনের সময় লাগে আরো বাইশ বছর। ডারউইন “প্রাকৃতিক নির্বাচন” মাথায় নিয়ে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেননি। বরং উল্টো, গবেষণা শেষে ওনাকে “প্রাকৃতিক নির্বাচন” তত্ত্বে পৌঁছাতে হয়েছিল। অন্যদিকে, প্রস্তাবের প্রায় পাঁচ বছর পর আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ-আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রথম এক্সপেরিমেন্টাল প্রমাণ পাওয়া যায়।
ডারউইনীয় গবেষণা প্রক্রিয়া -অর্থাৎ, “পর্যবেক্ষণ থেকে তত্ত্বে” উপনীত হওয়াটা আপাতত বায়োলজি ও বায়োকেমিস্ট্রি গবেষণার মূলধারা। এর উল্টোটা অর্থাৎ, “তত্ত্ব থেকে পর্যবেক্ষণে” যাওয়ার প্রক্রিয়াটা আপাতত ফিজিক্সের মত মৌলিক গবেষণায় বেশি দেখা যায়। এই বৈসাদৃশ্যতা একটা করণ হতে পারে -ফিজিক্সের তত্ত্বগুলোর “ভবিষ্যদ্বাণী” করার ক্ষমতা রয়েছে। তাই, ফিজিক্সে পর্যবেক্ষণের কাজ মূলত “ভবিষ্যদ্বাণী” যাচাই করা। অন্যদিকে, বায়োলজিক্যাল প্রক্রিয়াগুলো জটিল ও লক্ষ্যহীন (random)। যে কোনো random প্রক্রিয়া থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা গাণিতিকভাবে অসম্ভব। তাই বায়োলজিতে পর্যবেক্ষণের কাজ মূলত causality ও correlation যাচাই করা।
শুরুতেই এক্সপেরিমেন্টাল প্রমাণ থাকার কারণে, ডারউইনের “প্রাকৃতিক নির্বাচন” একটা “ফ্যাক্ট”। অন্যদিকে, স্যার এডিংটনের সূর্যগ্রহণ এক্সপেরিমেন্টের আগ পর্যন্ত আইনস্টাইনের সাধারণ-আপেক্ষিকতা ছিলো একটি “কনজেক্সচার”। যে কোনো কনজেক্সচারই স্রেফ educated guess, কিন্তু, কোনোভাবে “ফ্যাক্ট” নয়। কনজেক্সচার থেকে “ফ্যাক্ট” হতে হলে এক্সপেরিমেন্টাল প্রমাণ থাকতে হবে। ফিজিক্স হলো বিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যেখানে ফ্যাক্ট-এর চেয়ে কনজেক্সচার বেশি।
কোনো তত্ত্বের বিপরীতে এক্সপেরিমেন্ট না থাকার পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত- প্রযুক্তিগত বাধা, যেমন -সুপার-সিমেট্রিক পার্টিকেল (সুপার স্ট্রিং থিওরি) না পাওয়ার কারণ হিসেবে শক্তিশালী পার্টিকেল এক্সেলারেটর না থাকার কথা বলা হয়। তবে, প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে হয়তো ভবিষ্যতে এধরণের পর্যবেক্ষণ সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত- টেকনিক্যাল অসম্ভাব্যতার। কিছু কিছু এক্সপেরিমেন্ট টেকনিক্যাললি অসম্ভব। যেমন টাইম-ট্র্যাভেল করা যেতে পারে দুইভাবে -ওয়ার্মহোল ও ওয়ার্প-ড্রাইভ (এলকুবের ড্রাইভ)। কিন্তু, এদের জন্য দরকার ঋণাত্মক ভরযুক্ত পদার্থ (নেগেটিভ ম্যাটার)। নেগেটিভ ম্যাটার পাওয়া গেলে টাইম-ট্র্যাভেলের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করতে সমস্যা নেই, কিন্তু, এই নেগেটিভ ম্যাটার কোথায় থেকে আসবে সেটা কেউই জানে না।
এমন অসম্ভাব্যতার আরেকটি উদাহরণ হলো -জনপ্রিয় বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব “শূন্য থেকে মহাবিশ্ব”। এই তত্ত্বের এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে- হুইলার-ডিউইট তত্ত্ব (WDWE) ও বোহেমিয়ান মেকানিক্স ব্যবহার করে গাণিতিকভাবে দেখানো সম্ভব যে, শূন্যস্থানের কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন থেকে নতুন মহাবিশ্ব তৈরি হতে পারে। সমস্যা হলো, হুইলার-ডিউইট তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায় “ব্যাকগ্রাউন্ড-ইন্ডিপেন্ডেন্ট” কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তত্ত্ব যেটা নিজেই একটা কনজেক্সচার। এরপরের সমস্যা হলো, “শূন্যস্থান” পর্যবেক্ষণ -এটা কিভাবে সম্ভব সেটা আমার জানা নেই। তিন নাম্বার সমস্যাটা আরো বড়। কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনে যদি নতুন মহাবিশ্ব তৈরিও হয়, তার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা কখনোই জানতে পারবো না। “ব্যাকগ্রাউন্ড-ইন্ডিপেন্ডেন্ট” তত্ত্ব হবার কারণে, নতুন মহাবিশ্বের স্থানকাল হবে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন (আমাদের মহাবিশ্ব থেকে)। এই সমস্যাটা যেকোনো মাল্টিভার্স তত্ত্বের ক্ষেত্রেও অনেকাংশে প্রযোজ্য।
এরমধ্যে যদি মাল্টিভার্স টানা হয় -ফিজিক্সে বহু মাল্টিভার্স তত্ত্ব রয়েছে এবং এদের মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। যেমন: এভারেটশিয়ান-মাল্টিভার্স (everettian multiverse, একটি কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল মাল্টিভার্স), ব্রেন-মাল্টিভার্স (স্ট্রিং থিওরির মাল্টিভার্স), ইটার্নাল মাল্টিভার্স (ইনফ্লেশন থিওরির মাল্টিভার্স) ইত্যাদি ইত্যাদি। এক বিষয়ে এতগুলো কনজেক্সচার থাকাটা অসুবিধাজনক ব্যাপার।
জনপ্রিয় পপ-সায়েন্স বইগুলোতে বৈজ্ঞানিক কনজেক্সচারগুলোকে উপস্থাপন করা হয় সায়েন্স ফিকশনের মতো করে। সমস্যা হলো, ফ্যাক্ট ও কনজেক্সচারের পাঁচমিশালিতে একজন সাধারণ মানুষের কাছে বইয়ে সবকিছুই “ফ্যাক্ট” মনে হতে পারে। এই বিভ্রান্তির একমাত্র কারণ হলো, লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি। জনপ্রিয় পপ-সায়েন্স লেখকেরা মূলত আশাবাদী টাইপের। নৈরাশ্যবাদী লেখকও আছেন, তবে সায়েন্সের সাথে ফিকশন না থাকলে জনপ্রিয়তা পাওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই।
কোনো আশাবাদী বিজ্ঞানীকে যদি টাইম ট্র্যাভেল “সত্য প্রমাণিত হবার সম্ভাবনা” নিয়ে জানতে চাওয়া হয়, ওনার তাৎক্ষণিক উত্তর হবে -কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির কোথাও বলা হয়নি যে টাইম ট্র্যাভেল সম্ভব নয়। কিংবা, যদি জিজ্ঞাস করা হয় -নেগেটিভ ম্যাটার (এন্টি ম্যাটার নয়) কি আদৌ সম্ভব? তাৎক্ষণিক উত্তর পাওয়া যেতে পারে -নেগেটিভ ম্যাটারের সাথে ফিজিক্সের কোনো মৌলিক সংঘাত নেই (যেমন “ভরবেগ সংরক্ষণ নীতির” লঙ্ঘন, ইত্যাদি)।
আশাবাদী হবার পেছনে বিজ্ঞানীদের কিছু কারণ আছে, যেমন -(ডার্ক ম্যাটার ছাড়া) মহাবিশ্বের প্রতিটি পদার্থই তিনটি মৌলিক করা দিয়ে তৈরি -ইলেক্ট্রন, আপ-কোয়ার্ক, ও ডাউন-কোয়ার্ক। অথচ, স্ট্যান্ডার্ড মডেলে এই তিনটি কণা ছাড়াও এমনও মৌলিক কণা আছে যাদের কোনোই দরকার নেই (যেমন -টপ/বটম কোয়ার্ক কিংবা টাউ/মিউয়ন লেপ্টন)। যদি জানতে চাওয়া হয়, অপ্রয়োজনীয় মৌলিক কণাদের অস্তিত্ব থাকার কারণ কি? এই প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তরও আগের দুটোর মতোই -ফিজিক্সের মৌলিক নীতির সাথে টপ/বটম কোয়ার্ক কিংবা টাউ/মিউয়নদের কোনো সংঘাত নেই। সুতরাং ব্যাপার এমন -টপ কোয়ার্ক যদি বাস্তব (exist) হয়, তবে নেগেটিভ ম্যাটার বাস্তব হতে দোষ কোথায়?
একজন সাধারণ মানুষের জন্য “ফ্যাক্ট” ও “ফিকশনের” মধ্য পার্থক্য বুঝতে পারাটা জরুরি। দর্শনে “ছদ্মবিজ্ঞান” বলে একটা শব্দ আছে, সমস্যা হলো, ছদ্মবিজ্ঞান ও সায়েন্স-ফিকশন একই জিনিস না।
ছদ্মবিজ্ঞান সংজ্ঞায় কার্ল পপার তিনটি সমসাময়িক তত্ত্বের পার্থক্য লক্ষ্য করেছিলেন। এদের প্রত্যেকেটিকেই বৈজ্ঞানিক বলে দাবি করা হয়েছিলো -আইনস্টাইনের “আপেক্ষিক তত্ত্ব”, কার্ল মার্ক্সের “থিওরি অফ হিস্ট্রি”, এবং সিগমন্ড ফ্রয়েডের “সাইকোএনালাইসিস”। পপার লক্ষ্য করেন যে, ফ্রয়েডের তত্ত্বটি মানুষের সবরকম আচরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারে। মানুষের পক্ষে এমন আচরণ করা সম্ভব নয় যেটা সাইকোএনালাইসিসের গণ্ডির মধ্যে পড়ে না। অন্যদিকে, মার্ক্সের তত্ত্ব অনুসারে -স্থানকাল নির্বিশেষে প্রতিটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংঘাতই শ্রেণী সংঘাত (class struggle)। নির্দিষ্ট সামাজিক দ্বন্দ্ব যখন শ্রেণী সংঘাতের সংজ্ঞায় পড়ে না, তখন মার্ক্সিস্টরা শ্রেণী সংঘাতের সংজ্ঞা পাল্টানোর চেষ্টা করেন। অন্যদিকে, পপারের এটাও দেখেন যে, স্যার এডিংটনের এক্সপেরিমেন্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারতো। তাই পপারের সিদ্ধান্ত ছিলো -কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে শুধু “ব্যাখ্যা” করলেই চলবে না, তত্ত্বকে এক্সপেরিমেন্ট যোগ্য হতে হবে। কারণ, শুধু এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমেই কোনো তত্ত্বকে “মিথ্যা” প্রমাণ করা সম্ভব। যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণযোগ্য না (non-falsifiable), পপারের ভাষায় সেটা ছদ্মবিজ্ঞান।
সমস্যা হলো, প্রত্যেকটি বৈজ্ঞানিক কনজেক্সচার মিথ্যা প্রমাণযোগ্য, তাই শুধু ফ্যালসিফিকেশন নীতি দিয়ে এদের বিজ্ঞান থেকে আলাদা সম্ভব নয়। মজার ব্যাপার হলো, সাইকোএনালাইসিসও একটি মিথ্যা প্রমাণযোগ্য (falsifiable) তত্ত্ব। ফ্রয়েডের মতে, আচরণ নির্ভর করে মানুষের অচেতন মনের আইডি, ইগো, ও সুপারইগোর ইত্যাদির বিকাশের ওপর। কিন্তু, মানব মস্তিষ্কে ওপর অগণিত fMRI স্ক্যান চালানোর পরও নিউরো-সায়েন্টিস্টরা তথাকথিত আইডি, ইগো, বা সুপারইগো ইত্যাদির কোনো খোঁজ পাননি। আমরা এখন জানি, (সাইকোলজি অনুসারে) মানুষের আচরণ নির্ভর করে জেনেটিক্স এবং পরিবেশের জটিল ইন্টারঅ্যাকশনের ওপর। অন্যদিকে, ইতিহাসের সাথে যদি পপুলেশন ও ইকোনমিক্সের ডেটা যোগ করা হয়, তবে দেখা যাবে যে, মানব ইতিহাসে বৈষম্য ও সংঘাতের মূল কারণ “ভূগোল” বা “জিওগ্রাফি”। ভূত্বাত্তিকে সুবিধা-অসুবিধার কারণে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিকাশ হয় ভিন্ন ভিন্ন গতিতে -যেগুলো মার্ক্সিস্ট শ্রেণী সংঘাতের প্যাটার্ন অনুসরণ করে না। ফ্রয়েড ও মার্ক্সের তত্ত্বগুলোর আসল রূপ হলো “অপবিজ্ঞান”, ছদ্মবিজ্ঞান নয়।
সারাংশ হলো -বিজ্ঞান থেকে অপবিজ্ঞান আলাদা করতে এক্সপেরিমেন্টাল ডেটাই যথেষ্ট, দর্শনের কোনোই দরকার নেই। বিজ্ঞান থেকে ফিকশন থেকে আলাদা করার একমাত্র উপায়ও “এক্সপেরিমেন্ট” -পপারের মতো শুধু এক্সপেরিমেন্ট যোগ্য হলেই হবে না, এক্সপেরিমেন্ট করে দেখাতে হবে। সুতরাং, টাইম-ট্র্যাভেল, মাল্টিভার্স এগুলো কি সত্যিই সম্ভব? -এই প্রশ্নের নৈরাশ্যবাদী উত্তর হলো “আমরা জানি না”। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আশাবাদী উত্তর “ফিজিক্সের মৌলিক নীতির সাথে সংঘাত নেই” আসলে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে “আমরা জানি না” বলার মতোই। সত্যি বলতে, নেগেটিভ ম্যাটার কখনো পাওয়া যাবে কিনা “আমরা জানি না”; প্রকৃতিতে টপ/বটম কোয়ার্ক কেন পাওয়া যায় সেটাও “আমরা জানি না”।
আমার মনে হয়, বিজ্ঞানের সাথে দর্শনের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, একমাত্র বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ক্ষেত্রেই “আমরা জানি না” কথাটা ব্যবহার করা যায় (সরাসরিই হোক বা ঘুরিয়ে পেঁচিয়েই হোক)। কোনো দার্শনিক তত্ত্ব “সঠিক নাকি ভুল” এই প্রশ্নে “আমরা জানি না” কথার উল্লেখ আমি কখনো দেখিনি।