জেনেটিক-ড্রিফ্ট

এন্ড্রিয়াস উইগনারের “Life Finds a Way: What Evolution Teaches Us About Creativity” প্রকাশিত হয় ২০১৯-তে। জেনেটিক-ড্রিফ্ট ও জেনেটিক-রিকম্বিনেশন ওপর লেখা অসাধারণ একটা বই (আমার মতে)।

বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার দুটি পরিণতি আছে। ফিটনেস, যেটা পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর যোগ্যতা দেয়। “পরিবেশ” হলো একাধিক ভ্যারিয়েবলের একটি জটিল সমস্যা, যার কোনো একক “ফিটনেস” সমাধান নেই। ডারউইনিয়ান বিবর্তনের কাজ হলো, নিকটতম “ফিটনেস” সমাধান খুঁজে বের করা। বিবর্তনের দ্বিতীয় ফলাফল: সৃজনশীলতা (creativity), যার কাজ একইসাথে একাধিক “ফিটনেস” সমাধান অনুসন্ধান করা।

ডারউইনিয়ান বিবর্তনের ভিত্তি হলো: ১/ হুগো ডি ভ্যারিসের “মিউটেশন-তত্ত্ব” ২/ গ্রেগর মেন্ডেলের “জেনেটিক্স” ৩/ চার্লস ডারউইনের “ন্যাচারাল-সিলেকশন”। ডারউইনিয়ান বিবর্তন থেকে যদি ন্যাচারাল-সিলেকশন বাদ দেয়া হয়, তাহলে পাওয়া যাবে জেনেটিক-ড্রিফ্ট। জেনেটিক-ড্রিফ্ট একটি random evolutionary প্রসেস, এতে মিউটেশন সবসময় “random”। randomness-কে পরিমাপ করতে দরকার গণিত, সম্ভবত এজন্যই জেনেটিক-ড্রিফ্ট বোঝাটা ডারউইনিয়ান বিবর্তনের চেয়ে একটু বেশি কঠিন। অন্যদিকে, জেনেটিক-রিকম্বিনেশনের ক্ষেত্রে “মিউটেশন-তত্ত্ব” ও “ন্যাচারাল-সিলেকশন” দুটোই বাদ দিতে হবে। এর অন্য নাম horizontal gene transfer, সেক্স (ইত্যাদি)।

বইটিতে সবচেয়ে জোর দেয়া হয়েছে বিবর্তনের “ল্যান্ডস্কেপ” ধারণা ওপর। বিজ্ঞানে ল্যান্ডস্কেপ ধারণাটা নতুন কিছু নয়, ফিজিক্সে এর ব্যবহার ভুরিভুরি, যেমন- স্ট্রিং-থিওরির ল্যান্ডস্কেপ। স্ট্রিং-থিওরির প্রায় ১০^৫০০ টি সমাধানকে (এরা প্রত্যেকেই একটি স্বতন্ত্র মহাবিশ্ব) একটা ল্যান্ডস্কেপ হিসেবে দেখা হয়। কিংবা এনার্জি-ল্যান্ডস্কেপ; যেখানে সিস্টেম, পার্টিকেল, ইত্যাদির স্থিতিশীল কনফিগারেশন আলোচনা করা হয়। অন্যদিকে, বিবর্তনে “ল্যান্ডস্কেপ” ধারণাটা অনেকটা পার্বত্য অঞ্চলের “ম্যাপের” মতো, এতে কোনো প্রজাতির সম্ভাব্য ফিটনেস কনফিগারেশনগুলোকে একসাথে দেখানো হয়। এই ম্যাপের প্রত্যেকটি চূড়া একটি স্বতন্ত্র ফিটনেস সমাধান। যে চূড়ার উচ্চতা যতো বেশি তার ফিটনেস ততো ভালো।

ডারউইনিয়ান ও নন-ডারউইনিয়ান প্রসেসদের মূল পার্থক্য হলো, বিবর্তনীয় ল্যান্ডস্কেপে এদের গতিমুখ ভিন্ন ভিন্ন। ন্যাচারাল-সিলেকশন ল্যান্ডস্কেপে শুধুই ওপর দিকে (ভার্টিক্যাল ) যেতে বাধ্য করে এবং নিচের দিকে নামার চেষ্টা করলে ফিটনেস পেনাল্টি দিতে হয়। আশা করা যায় যে, ধীরে ধীরে শুধু ওপর দিকে চলতে থাকলে একসময় কোনো না কোনো চূড়ায় (ফিটনেস সমাধান) পৌঁছানো যেতে পারে। অন্যদিকে, জেনেটিক ড্রিফ্ট ও রিকম্বিনেশনের চলন শুধুই আড়াআড়ি (হরাইজন্টাল)। সমস্যা হলো, ল্যান্ডস্কেপে সব জায়গার উচ্চতা (ফিটনেস) সমান নয়। শুধু সামনে-পেছনে চললে, একইসাথে ওপরে ওঠার সুযোগ কিংবা নিচে নাম ঝুঁকি দুটোই রয়েছে। বিশেষ করে, এক চূড়া থেকে অন্য চূড়ার মধ্যবর্তী নিচু উপত্যকা এড়ানোর উপায় নেই। আপাতদৃষ্টিতে, জেনেটিক-ড্রিফ্ট যদি কোনো প্রজাতিকে এক ফিটনেস চূড়া থেকে অন্য ফিটনেস চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তবে যাত্রাপথে প্রজাতিটিকে ফিটনেস হারাতে হবে এবং ন্যাচারাল-সিলেকশন এই সুযোগে প্রজাতিকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেবে। অবাক হবার ব্যাপার হলো, জেনেটিক ড্রিফ্ট ও রিকম্বিনেশন নেভিগেশনে ওপরে ওঠা বা নিচে নামার মতো কোনো ব্যাপারই নেই। অর্থাৎ, ড্রিফ্ট ও রিকম্বিনেশন যখন বিবর্তনীয় ল্যান্ডস্কেপের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে নেভিগেট করে, মাঝামাঝি সময়টাতে ফিটনেসের কোনো পরিবর্তন হয় না। জেনেটিক-ড্রিফ্ট ও জেনেটিক-রিকম্বিনেশনের মধ্যে পার্থক্য হলো- এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে এই অদ্ভুত যাত্রা সম্পন্ন করে।

জেনেটিক-রিকম্বিনেশন হলো সেক্স বা প্রজনন, ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রে একে বলে হরাইজন্টাল-জিন-ট্রান্সফার। প্রজননের ক্ষেত্রে যেটা হয়, (মানব) শুক্রাণু ও ডিম্বাণুদের ২৩-বেজোড় ক্রোমোজোম ক্রমানুসারে, সারিবদ্ধভাবে সন্নিবেশিত হয়। ব্যাপার হলো, এই নতুন ক্রোমোজোম-পেয়ারে একই জিনের ভিন্ন ভিন্ন আলিলগুলোর জেনেটিক সিকোয়েন্স হুবুহু এক নয়। ২৩টি-মাতৃ ক্রোমোজোমের ৩-বিলিয়ন এবং ২৩টি-পিতৃ ক্রোমোজোমের ৩-বিলিয়ন নিউক্লিয়টাইড-পেয়ারগুলোর মধ্যে গড়পড়তা ৩-মিলিয়ন অমিল থাকে। বিবর্তনীয় ল্যান্ডস্কেপে একটি নিউক্লিয়টাইড-পেয়ারের অমিলকে যদি এক কদম ধরা হয়, তবে ৩-মিলিয়ন অমিল মানে প্রায় ৭০০ মাইল দূরত্ব! এরমানে হলো, শুধু প্রজনন দিয়েই কোনো রকম ফিটনেস-পেনাল্টি ছাড়াই বিস্তৃত ফিটনেস উপত্যকা পাড়ি দেয়া সম্ভব। জেনেটিক-রিকম্বিনেশন অনেকটা স্টার-ট্রেক সিরিজের টেলি-ট্রান্সপোর্টেশনের মতো। সমস্যা হলো, জেনেটিক টেলি-ট্রান্সপোর্টেশনে গন্তব্যের ফিটনেস যদি কম হয়, তবে পেনাল্টির এড়ানোর উপায় নেই। কিন্তু, অনেক ক্ষেত্রেই গন্তব্য হতে পারে নতুন ফিটনেস-চূড়া।

অন্যদিকে, জেনেটিক-ড্রিফ্ট একটি মাল্টি-ডিমেনশনাল বা বহুমাত্রিক বিবর্তনীয় শক্তি। একটি জিনে যদি ১০০টি নিউক্লিয়টাইড-পেয়ার থাকে এবং আমরা যদি শুধু একটি নিউক্লিয়টাইড-পেয়ারের Random মিউটেশনের (পয়েন্ট-মিউটেশন) কথা চিন্তা করি; তবে শুধু এই একটি জিনের জন্যই (জেনেটিক-ড্রিফ্টের দৃষ্টিতে) বিবর্তনীয় ল্যান্ডস্কেপ ১০০-মাত্রিক। এখন যদি কোনো জিন-পুলের সমস্ত জিন এবং এদের সম্ভাব্য Random মিউটেশন হিসাব করা হয়, তবে ল্যান্ডস্কেপের মাত্রা ও জেনেটিক-ড্রিফ্টের গতিপথ কল্পনা করা অসম্ভব। এই বহু-মাত্রা কিভাবে জেনেটিক-ড্রিফ্টকে সাহায্য করে, সেটা বুঝতে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক চলনের পার্থক্য দেয়া যাক। একটা বিখ্যাত উদাহরণ হলো, দ্বিমাত্রিক প্রাণীর পক্ষে খাওয়া ও বাথরুম করা সম্ভব না। কারণ, ঢোকা ও বেরুবার সময় খাবার দেহকে দুই ভাগ করে ফেলবে। কিন্তু, আমাদের মতো ত্রিমাত্রিক প্রাণীর জন্য এটা কোনো সমস্যাই না, আমাদের পরিপাকতন্ত্র এমনই একটি পথ, যেটা দিয়ে (কোনো রকম কাটাছেঁড়া ছাড়াই) খাবার ঢুকতে ও বেরুতে পারে। ন্যাচারাল-সিলেকশন অনেকটা দ্বিমাত্রিক শক্তি, যা শুধুই ওপরে উঠতে পারে। অন্যদিকে, জেনেটিক-ড্রিফ্ট উচ্চতর মাত্রার বিবর্তনীয় শক্তি। নিম্ন মাত্রায় যে চূড়াগুলো বিচ্ছিন্ন, জেনেটিক-ড্রিফ্টের উচ্চতর মাত্রায় এই চূড়াগুলো সংযুক্ত। ফলে, ন্যাচারাল-সিলেকশনের জন্য যে পথ পাড়ি দেয়া অসম্ভব, জেনেটিক-ড্রিফ্টের জন্য সেটা মামুলি ব্যাপার।

এখন প্রশ্ন হলো, বিবর্তনীয় ল্যান্ডস্কেপে কোনোটি বেশি শক্তিশালী? ন্যাচারাল-সিলেকশন নাকি জেনেটিক-ড্রিফ্ট? এটা নির্ভর করে পপুলেশন আকারের ওপর। বিশাল পপুলেশনের ক্ষেত্রে ন্যাচারাল-সিলেকশনই প্রভাবশালী শক্তি। যেমন: এক বর্গ ইঞ্চিতে কয়েক বিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া বসবাস করতে পারে, তাই এরা যখন এন্টিবায়োটিক রেসিস্টেন্স (উদাহরণ) অর্জন করে, এর মূল কারণ ন্যাচারাল-সিলেকশন। অন্যদিকে পপুলেশন যদি ছোট হয়, তবে জেনেটিক ড্রিফ্টই মূল বিবর্তনীয় শক্তি। ধরা যাক, ১০ সদস্যের মানব জনগোষ্ঠীর জিন-পুলে কোনো জিনের দুটি আলিল আছে। সিলেকশন-প্রেসার থাকুক বা নাই থাকুক, পরবর্তী ১০ প্রজন্মেই এই জনগোষ্ঠীতে একটি আলিলের বিলুপ্তি ঘটবে এবং জনগোষ্ঠীটি ইন-ব্রিডিং শুরু করবে। যেহেতু জেনেটিক-ড্রিফ্ট একটি Random প্রসেস, যে আলিলটি বিলুপ্ত হবে সেটা প্রয়োজনীয় হতেও পারে (যার বিলুপ্তি গোষ্ঠীর জন্য হুমকি), কিংবা বিপদজনকও হতে পারে (যার বিলুপ্তি গোষ্ঠীর জন্য ভালো)। এই জেনেটিক-ড্রিফ্টের কারণেই কোনো পপুলেশনের আকার ইচ্ছামতো ছোট (arbitrary small) হতে পারে না। যেমন: মানুষের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা প্রায় ৫০-৫০০ এর ভেতর। সুতরাং, তথাকথিত ২-সদস্যের মানব পপুলেশন থেকে ৭-বিলিয়নের পৌঁছানো গাণিতিকভাবে অসম্ভব।

বইটার মূল কথা হলো, ন্যাচারাল-সিলেকশন, জেনেটিক-ড্রিফ্ট, রিকম্বিনেশন, ইত্যাদি, এরা স্রেফ life’s way to navigate through evolutionary landscape। ন্যাচারাল-সিলেকশন যখন কোনো ফিটনেস-চুড়ায় পৌঁছে, সেটা হতে পারে একটা বিবর্তনীয় ডেড-এন্ড, অথবা জেনেটিক-ড্রিফ্ট হয়তো হুট্ করে যেতে পারে নতুন চূড়ায়, সেখান থেকে হয়তো আবার শুরু হবে ন্যাচারাল-সিলেকশনের সিঁড়ি ভাঙা।