কোয়ান্টাম ফিজিক্সের পাঁচ নম্বর সাধারণ নিয়ম কম্পোসিশন-রুলটি আরেকবার দেখা যাক। কম্পোসিশন-রুল অনুসারে, দুটি কণার সম্মিলিত বা যৌথ কোয়ান্টাম-স্টেট কণা দুটোর আলাদা আলাদা কোয়ান্টাম-স্টেটের সাধারণ গুনফল, কিংবা গুণফলের সুপারপজিশন-স্টেট। দুটি উদাহরণ দেয়া যাক, দুটি কণার আলাদা আলাদা স্টেট যদি ।U> এবং ।V> হয়, তবে তাদের যৌথ স্টেট হবে ।UV>; কিংবা, একটি কণা যদি ।U> সাধারণ স্টেটে এবং অন্য কণাটি যদি a।V> + b।W> সুপারপজিশন-স্টেটে থাকে তবে কণা দুটির যৌথ স্টেট হবে a।UV> + b।UW>; লক্ষ্য করা বিষয় হলো, কম্পোসিশন-রুলে প্রাপ্ত যৌথ স্টেটে কণাদের নিজস্ব স্টেট থাকে। কিন্তু, বাস্তবে একজোড়া কণার এমন যৌথ স্টেট তৈরি করা সম্ভব যাতে কণাগুলোর নিজেদের আলাদা কোনো স্টেট থাকে না। যেমন: গবেষণাগারে দুটো 1/2-স্পিন কণাকে সম্পূর্ণ-শূন্য-স্পিন বা টোটাল-স্পিন-জিরো (Total spin zero) সিস্টেমে পরিণত করা সম্ভব। শুধু Z-উপাংশের (Z component) ক্ষেত্রে এই টোটাল-স্পিন-জিরো সিস্টেমকে সূচিত করা হয় এভাবে:
।TSZ> = s।↟↡> – s।↡↟>;
এই ।TSZ> সিস্টেমের দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, যদি পরিমাপ করা হয় তবে, এই সিস্টেমে কণার যেকোনো কণার Z-উপাংশের মান ।↟> বা ।↡> হবার সম্ভাবনা ৫০%। একইভাবে, যেকোনো কণার X-উপাংশের মান ।↠> কিংবা ।↞> পাওয়ার সম্ভাবনাও অর্ধেক অর্ধেক। দ্বিতীয়ত, যেহেতু পুরো সিস্টেমের মোট স্পিন শূন্য, তাই পরিমাপের মাধ্যমে যদি একটি কণার X-উপাংশ ।↠> পাওয়া যায় তবে পরিমাপ ছাড়াই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, অন্য কণাটির X-উপাংশ ।↞>; উল্টোটাও সত্যি। ঠিক একইভাবে যদি পরিমাপ করে একটি কণার Z-উপাংশ পাওয়া যায় ।↟>; তবে কোনো পরিমাপ ছাড়াই আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, অন্য কণাটির Z-উপাংশ হবে ।↡>;
।TSZ> সিস্টেমের সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপারটি হচ্ছে, কণা দুটির স্টেট সময় কিংবা স্থানের ওপর নির্ভর করে না। ধরা যাক, দুটি 1/2-স্পিন কণাকে ।TSZ> সিস্টেমে নিয়ে আসা হলো। এরপর কণা দুটিকে মহাবিশ্বের দুই প্রান্তে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এবার যদি একটি কণার Z-উপাংশের পরিমাপ করা হয় এবং ধরি এর মান ।↟> পাওয়া গেলো; তবে তৎক্ষণাৎ কয়েক বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে থাকা অন্য কণাটির Z-উপাংশের মান হবে ।↡>; ব্যাপারটি X-উপাংশের জন্যও সত্যি। এই পর্যবেক্ষণটি ক্লাসিক্যাল-ফিজিক্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাংঘর্ষিক, সেটি হলো লোক্যালিটি (Locality) বা কারণ-প্রভাবের স্থানীয়করণ।
আমরা জানি, যেকোনো প্রভাবের (Effect) জন্য দরকার এক বা একাধিক কারণ (Cause)। একে বলে কজ্যালিটি (Causality)। ক্লাসিক্যাল-ফিজিক্সে যেকোনো “কারণ”-এর “প্রভাব” স্থানীয়। যেমন ধরুন, আপনার নিকটবর্তী মোবাইল টাওয়ার থেকে আপনার উদ্দেশ্যে প্রেরিত কল বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়, যেটা আপনার মোবাইল ফোনে এসে পৌঁছে, আর তাই আপনি কল গ্রহণ করতে পারেন। এখানে “কারণ” হলো আপনার আশপাশের বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ এবং “প্রভাব” হলো আপনার মোবাইল ফোনটি বেঁজে ওঠা। যদিও ফোন-কলটি আসতে পারে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে থাকা কোনো বন্ধুর কাছ থেকে, তবুও কলটির বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আপনার মোবাইল ফোনে না পৌঁছালে আপনি কলটি গ্রহণ করতে পারবেন না। অর্থাৎ, দূরবর্তী ফোন-কলটি আপনার আশেপাশের পরিবেশকে পরিবর্তন করে, আর স্থানীয় পরিবেশের এই পরিবর্তনই আপনার মোবাইল ফোন বেঁজে ওঠার কারণ। কোনো ঘটনা যদি দূরবর্তী “প্রভাব” ফেলতে চায় তবে ঘটনাটিকে প্রথমে দূরবর্তী “কারণ” তৈরি করতে হবে। বিশেষ-আপেক্ষিকতার জন্য ক্লাসিক্যাল-ফিজিক্সে কোনো স্থানের একটি ঘটনা আলোরগতির চেয়ে বেশি গতিতে অন্যস্থানে “কারণ” তৈরি করতে পারে না। এই পুরো ব্যাপারটিই হচ্ছে লোক্যালিটির মূল কথা।
।TSZ> সিস্টেমের ক্ষেত্রে দূরবর্তী কণা পরিমাপের মাধ্যমে কোনো রকম স্থানীয় পরিমাপ (লোক্যালিটির ভাষায় স্থানীয় “কারণ”) ছাড়াই একটি কণার স্পিন জানা যায়। স্পষ্টতই এটা লোক্যালিটির লঙ্ঘন। এই ব্যাপারটির গুরুত্ব সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেন আইনস্টাইন। আইনস্টাইন এবং তার দুই সহকর্মী বোরিস-পোডোলস্কি (Boris Podolsky) এবং নাথান-রোসেন (Nathan Rosen) সম্মিলিতভাবে ১৯৩৫ সালে একটি পেপার প্রকাশ করেন যার শিরোনাম ছিলো: “Can quantum-mechanical description of physical reality be considered as complete?” বা “কোয়ান্টাম-মেকানিক্স কি বাস্তবতার পূর্ণাজ্ঞ বর্ণনা দিতে পারে?” এই ঐতিহাসিক পেপারটি EPR-পেপার নামে পরিচিত। আইনস্টাইন EPR-পেপারে দূরবর্তী কণা পরিমাপের মাধ্যমে স্থানীয় কণার অবস্থা নিশ্চিতভাবে নির্ণয়ের ব্যাপারটিকে “Spooky action at a distance” বা “দূর থাকে আজব কান্ড” বলে সম্বোধন করেন। ঐ একই বছর এরউইন-শ্রোডনিগার (Erwin Schrödinger) ঘটনাটির আনুষ্ঠানিক নাম দেন কোয়ান্টাম-এনট্যাংলমেন্ট (Quantum Entanglement)।
আইনস্টাইন যদিও ১৯৩০ সালের সলভেই-কনফারেন্সের পর কোয়ান্টাম-মেকানিক্সের সামঞ্জস্যতা একপ্রকার মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু, ১৯৩৫ সালের EPR-পেপারে কোয়ান্টাম-এনট্যাংলমেন্ট এবং লোক্যালিটি ব্যবহার করে আইনস্টাইন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন যে, কোয়ান্টাম-মেকানিক্স প্রকৃতির বাস্তবতা পূর্ণাজ্ঞভাবে বর্ণনা করতে পারে না। EPR-পেপারে তার যুক্তি এতোই সূক্ষ্ম ছিলো যে ১৯৬৪ সালের আগে পরীক্ষিতভাবে তার যুক্তি ভুল প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। আইনস্টাইন মারা যান ১৯৫৫ সালে এবং নিলস-বোর মারা যান ১৯৬২ সালে। পর্দাথবিজ্ঞানের ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের নিষ্পত্তি তারা কেউই দেখে যেতে পারেননি।
ধরুন, আপনার পকেটে কোনো মুদ্রা আছে কি নেই সে ব্যাপারে আমি ভবিষ্যদ্বাণী করবো। আমার এই ভবিষ্যদ্বাণীটি সত্যি কিংবা মিথ্যা হতে পারে। কিন্তু, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, আমার ভবিষ্যদ্বাণী করার সময় আপনার পকেটে মুদ্রা উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি সুনির্দিষ্ট এবং পূর্বনির্ধারিত হতে হবে। যেমন: আমি যদি বলি আপনার পকেটে মুদ্রা আছে এবং আমার ভবিষ্যদ্বাণী শোনার পর যদি আপনি পকেটে হাত দিয়ে মুদ্রা খুঁজে পান, তবে আমাদের সাধারণ জ্ঞান বলে যে, মুদ্রাটি আপনার পকেটে আগে থেকেই ছিলো। অথবা যদি মুদ্রা খুঁজে না পান তবে আমাদের সাধারণ জ্ঞান এটাও বলে যে, মুদ্রাটি আপনার পকেটে কখনোই ছিলো না। হতে পারে মুদ্রার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি আপনি আগে থেকে জানতেন না, কিন্তু আমার ভবিষ্যদ্বাণী করার সময় আপনার পকেটে মুদ্রার উপস্থিতি অনির্ণেয় থাকতে পারে না। অর্থাৎ, আপনার পকেটে মুদ্রার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি পূর্বনির্ধারিত। EPR-পেপারে বাস্তবতার যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছিলো সেটা ঠিক এরকমই। আইনস্টাইন বলেন: “কোনো পরিমাপ ছাড়াই যদি সিস্টেমকে কোনো নির্দিষ্ট স্টেটে পাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় তবে ঐ স্টেটটি অবশ্যই বাস্তব।” আইনস্টাইনের বাস্তবতার এই সংজ্ঞাটি এসেছে আমাদের সাধারণ জ্ঞান থেকে এবং এই সংজ্ঞাটি কম্প্লিমেন্টারিটি-প্রিন্সিপলের উল্টো। আমরা জানি, কম্প্লিমেন্টারিটি-প্রিন্সিপল মতে পরিমাপ করা না হলে সিস্টেমের বেসিস-স্টেটগুলো সুপারপজিশন-স্টেটে বা অনির্ণেয় অবস্থায় থাকে।
EPR-পেপারের যুক্তি ছিলো এরকম। ।TSZ> সিস্টেমের ক্ষেত্রে যেহেতু কোনো স্থানীয় পরিমাপ ছাড়াই নিশ্চিতভাবে স্থানীয় কণার স্পিনের ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় (দূরবর্তী কণা পরিমাপের মাধ্যমে), তাই স্থানীয় কণার স্পিন সুনির্দিষ্ট এবং পূর্বনির্ধারিত। অর্থাৎ, ।TSZ> সিস্টেমের ক্ষেত্রে কম্প্লিমেন্টারিটি-প্রিন্সিপলটি ভুল। EPR-পেপারের মতে কোয়ান্টাম-এনট্যাংলমেন্টের ক্ষেত্রে কণারা এমনভাবে তাদের নিজস্ব কোয়ান্টাম-স্টেটের তথ্য বহন করে যেটা কোয়ান্টাম-মেকানিক্সের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তাই, কোয়ান্টাম-মেকানিক্স বাস্তবতার পূর্ণাজ্ঞ ব্যাখ্যা দিতে পারে না।
EPR-পেপারটি কোপেনহেগেনে এসে পৌঁছুলে বোরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরে। বোর ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে আইনস্টাইনের যুক্তিতে দুর্বলতাটা কোথায়। অবশেষে, বোর EPR-পেপারটির উত্তর দেন এভাবে:
।TSZ> সিস্টেমে কণা দুটি কম্পোসিশন-রুল অনুসরণ করে না। ফলে, সিস্টেমে কণাদের নিজস্ব আলাদা কোনো স্টেট থাকে না। অর্থাৎ, কণা দুটি একই স্টেট ভাগাভাগি করে নেয়। তাই কম্প্লিমেন্টারিটি-প্রিন্সিপলের দৃষ্টিতে কণাগুলো বহুদূরে অবস্থিত আলাদা আলাদা দুটি কণা নয় বরং এরা একটি কণা। বোরের মতে এটা হলো “Complementarity at a distance” বা “বহুদূর বিস্তৃত পরিপূরকতা”। যেহেতু, ।TSZ> সিস্টেমে এনট্যাংগেল্ড কণাগুলো একেক কণার মতো, কম্প্লিমেন্টারিটি-প্রিন্সিপলের জন্য স্পিনের Z এবং X-উপাংশগুলো পরিপূরক। অর্থাৎ, এক উপাংশ নির্ণয় করলে অন্য উপাংশগুলো অনির্ণেয় থেকে যাবে। বোর বলেন এই কম্প্লিমেন্টারিটি-প্রিন্সিপলের জন্যই ।TSZ> সিস্টেম পরিমাপের ক্ষেত্রে নিচের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।
(১) আমি একটি ।TSZ> সিস্টেম তৈরি করবো এবং সিস্টেমের একটি কণা আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবো।
(২) আপনি আমাকে জানাবেন আপনার কণাটির কোন উপাংশটি আমাকে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হবে। ধরি, আপনি পছন্দ করলেন Z-উপাংশ।
(৩) আমি আমার কাছে থাকা কণাটির Z-উপাংশ পরিমাপ করলাম এবং পেলাম ।↟>; সুতরাং আমি নিশ্চিত আপনার কণার Z-উপাংশ ।↡>;
(৪) আমি আপনাকে আমার ভবিষ্যদ্বাণী জানাবো, এবার আপনি আপনার কণার Z-উপাংশ পরিমাপ করবেন এবং আমার ভবিষ্যদ্বাণী এবং আপনার ফলাফল মিলিয়ে দেখবেন।
বোর বলেন, আইনস্টাইন নিচের মতো করে পরিমাপ করতে চেয়েছেন যেটা কম্প্লিমেন্টারিটি-প্রিন্সিপলের জন্য সম্ভব নয়।
(১) আমি একটি ।TSZ> সিস্টেম তৈরি করবো এবং সিস্টেমের একটি কণা আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবো।
(২) আপনি কণার X এবং Z-উপাংশ পরিমাপ করবেন এবং আমাকে ভবিষ্যদ্বাণী করতে বলবেন।
(৩) আমি আমার কাছে থাকা কণার যেকোন উপাংশ পরিমাপ করবো। ধরি, আমি পরিমাপ করলাম Z-উপাংশ এবং পেলাম ।↟>; সুতরাং, আমি নিশ্চিত আপনার Z-উপাংশ ।↡> ;
(৪) আমি আপনাকে জানাবো যে, আমার ভবিষ্যদ্বাণী হলো আপনার কণার Z-উপাংশ ।↡>;
(৫) এবার আপনি আমার ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে আপনা পূর্বের ফলাফল মিলিয়ে দেখবেন।
বোর তার জবাবের শিরোনাম হুবুহু EPR-পেপারের মতোই রাখেন। বোরের জবাব আইনস্টাইনসহ সবাইকে এই সান্ত্বনাই দেয় যে, EPR-পেপারের যুক্তি অকাট্য নয়। কিন্তু, বোর EPR-পেপারকে ভুল প্রমাণিত করতে পারেননি। ১৯৬৪ সালে আইরিশ পদার্থবিদ স্টুয়ার্ট বেল (Stewart Bell) EPR-পেপারের একটি গাণিতিক মডেল তৈরি করেন, যেটা বেল-থিওরেম (Bell’s theorem) নামে পরিচিত। পরবর্তীতে এই বেল-থিওরেম ওপর চালানো পরীক্ষণের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, EPR-পেপারের যুক্তি পুরোপুরি ভুল।
বেল প্রথমে EPR-পেপারের যুক্তির প্রধান উপাদানগুলো চিহ্নিত করেন এবং এদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন। EPR-পেপারের উপাদান হলো,
(১) কোয়ান্টাম-মেকানিক্স সঠিকভাবে এনট্যাংগেল্ড সিস্টেম (যেমন: ।TSZ>;) ব্যাখ্যা করতে পারে।
(২) গোপন-চলরাশি বা হিডেন-ভ্যারিয়েবল (Hidden variable): যেহেতু কণাদের স্পিন উপাংশগুলো সুনির্দিষ্ট এবং পূর্বনির্ধারিত তাই কণারা এই তথ্য ধারণ করে কিছু গোপন-চলরাশির মাধ্যমে।
(৩) লোক্যালিটি: কণাদের স্টেট নির্ধারিত হয় স্থানীয় পরিমাপের মাধ্যমে। অর্থাৎ, এক কণার পরিমাপ অন্য কণার স্টেট নির্ধারণ করতে পারে না।
এবার বেল এমন একটি কাল্পনিক মহাবিশ্বের কথা চিন্তা করেন যেখানে কণারা ওপরের যুক্তিটি অনুসরণ করে। এই কাল্পনিক মহাবিশ্বে যদি আমরা একটি ।LSZ> সিস্টেম তৈরি করি, তবে কণা দুটি নিজেদের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট উপাংশ পরিমাপের ক্ষেত্রে কোন কণা কি মান ব্যবহার করবে সেই ব্যাপারে সিন্ধান্তে পৌঁছুবে এবং মানগুলো তারা নিজেদের গোপন-চলরাশিতে লিখে নেবে। যখনই কণাদের স্থানীয়ভাবে পরিমাপ করা হবে তখনই কণারা নিজেদের গোপন-চলরাশি থেকে পূর্বনির্ধারিত মানগুলো প্রদর্শন করবে। এই প্রক্রিয়ায় গোপন-চররাশি ব্যবহারের ফলে লোক্যালিটি বজায় থাকে। বেলের মতে, EPR-পেপারের যুক্তিটি হলো:
এনট্যাংলমেন্ট + লোক্যালিটি ==> গোপন-চলরাশি;
এই যুক্তিটির মানে হলো, এনট্যাংলমেন্ট যদি লোক্যালিটি মেনে চলে তবে কণার অবশ্যই গোপন-চলরাশি ব্যবহার করে।
বেলের এই কাল্পনিক মহাবিশ্ব থেকে একটি গাণিতিক অসমতা পাওয়া যায় এভাবে; আমরা একটি ।TSZ> সিস্টেম তৈরি করবো এবং কণাদের স্থানীয়ভাবে পরিমাপ করবো। যেহেতু পরিমাপগুলো স্থানীয়, ধরি প্রথম কণাকে আমরা A এবং B-অক্ষ এবং দ্বিতীয় কণাকে আমরা C এবং D-অক্ষ বরাবর পরিমাপ করবো। এই অক্ষগুলোর মধ্যকার কোণগুলো নিচের ছবিতে দেয়া হলো। আমাদের পরিমাপগুলো থেকে মোট চারটি সম্পর্ক পাওয়া যাবে। অক্ষগুলোর মধ্যকার কোণগুলো এমনভাবে নেয়া হয়েছে যাতে এই চারটি সম্পর্কের মান পরীক্ষণের মাধ্যমে নির্ণয় করাটা সহজ হয়। এখানে প্রথম তিনটি সম্পর্কের মান পরীক্ষণের মাধ্যমে এবং চতুর্থ সম্পর্কটির মান EPR-পেপারের যুক্তি থেকে পাওয়া। Z-উপাংশের ক্ষেত্রে সম্পর্কগুলো এবং তাদের মান হলো:
(১) A-অক্ষে প্রথম কণার স্পিন ।↟> এবং C-অক্ষে দ্বিতীয় কণার স্পিন ।↡> (বা উল্টোটি) হবার যৌথ সম্ভাবনা: P (A = C) = 0.85;
(২) B-অক্ষে প্রথম কণার স্পিন ।↟> এবং C-অক্ষে দ্বিতীয় কণার স্পিন ।↡> (বা উল্টোটি) হবার যৌথ সম্ভাবনা: P (B = C) = 1.00;
(৩) B-অক্ষে প্রথম কণার স্পিন ।↟> এবং D-অক্ষে দ্বিতীয় কণার স্পিন ।↡> (বা উল্টোটি) হবার যৌথ সম্ভাবনা: P (B = D) = 0.85;
(৪) A-অক্ষে প্রথম কণার স্পিন ।↟> এবং D-অক্ষে দ্বিতীয় কণার স্পিন ।↡> (বা উল্টোটি) হবার যৌথ সম্ভাবনা: P (A = D) = ?
চতুর্থ সম্পর্কের জন্য এবার আমাদের EPR-পেপারের যুক্তি খাটাতে হবে:
(১) প্রথম সম্পর্ক থেকে: ।TSZ > সিস্টেমে A এবং C অক্ষের পরিমাপ একমত না হবার সম্ভাবনা (1.00 – 0.85) = 0.15;
(২) দ্বিতীয় সম্পর্ক থেকে: ।TSZ > সিস্টেমে B এবং C অক্ষের পরিমাপ একমত না হবার সম্ভাবনা (1.00 – 1.00) = 0.00;
(৩) তৃতীয় সম্পর্ক থেকে: TSZ > সিস্টেমে B এবং D অক্ষের পরিমাপ একমত না হবার সম্ভাবনা (1.00 – 0.85) = 0.15;
(৪) যেহেতু আমরা ধরেই নিয়েছি যে, পরীক্ষিত সম্ভাবনাগুলো এসেছে গোপন-চলরাশি, তাই |TSZ> সিস্টেমের A এবং D অক্ষের পরিমাপ একমত না হবার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা (0.15 + 0.00 + 0.15) = 0.30; অর্থাৎ, A-অক্ষে প্রথম কণার স্পিন ।↟> এবং D-অক্ষে দ্বিতীয় কণার স্পিন ।↡> (বা উল্টোটি) হবার যৌথ সর্বনিম্ন সম্ভাবনা: P (A = D) হবে, (1.00 -0.30) = 0.70; বা, P (A = D) ≥ 0.70;
এই, P (A = D) ≥ 0.70; বেলের অসমতা (Bell’s inequality) নামে পরিচিত। EPR-পেপার অনুসারে চতুর্থ সম্পর্কের নূন্যতম সম্ভাবনা 0.70। এবার আসা যাক আমাদের বাস্তব জগতে। গবেষণাগারে ব্যাপক পরীক্ষণের মাধ্যমে পাওয়া চতুর্থ সম্পর্কের সর্বোচ্চ মান 0.50। এটা স্পষ্টতই বেলের অসমতার লঙ্ঘন। এর মানে হলো, পরীক্ষিত মান স্পষ্টভাবে EPR-পেপারের গোপন-চলরাশির যুক্তিকে ভুল প্রমাণিত করে।
EPR-পেপারকে ভুল প্রমাণিত করতে প্রায় ৩০ বছর সময় লাগে। কিন্তু, এর উপলব্ধি অত্যন্ত গভীর। EPR-পেপার ভুল হবার মানে হলো ক্লাসিক্যাল-ফিজিক্সের লোক্যালিটির ধারণাও ভুল। এনট্যাংগেল্ড-সিস্টেমে “কারণ” এবং “প্রভাব” যেহেতু স্থানকালের বিস্তৃতির ওপর নির্ভর করে না, তাই আমাদেরকে হয়তো স্থানকাল (Spacetime) সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা শুরু করতে হবে।
আগের পর্ব: পরিচয় সঙ্কট: বোসন এবং ফার্মিয়ন
পরের পর্ব: কোয়ান্টাম তথ্য এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং
অবলম্বনে: “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “Quantum Mechanics: The Physics of the Microscopic World” by “Benjamin Schumacher”