আধুনিক মহাকাশবিজ্ঞানকে বলে মতৈক্যের-মহাকাশবিদ্যা বা কনকোর্ডেন্সে-কসমোলজি (Concordance Model), এবং এর ভিত্তি আইনস্টাইনের সাধারণ-আপেক্ষিকতা। কনকোর্ডেন্সে-কসমোলজির চলিত নাম হলো স্ট্যান্ডার্ড-কসমোলজি, এবং এর ভালো নাম Lambda-CDM-Model: এখানে Lambda হলো ডার্ক-এনার্জির সূচক এবং CDM (Cold dark matter) হলো শীতল ডার্ক-ম্যাটার কণা।
স্ট্যান্ডার্ড-কসমোলজি অনুসারে, CMB তৈরি হয় বিগ-ব্যাংয়ের সময়, এবং ছড়িয়ে পড়ে রিকম্বিনেশনের সময়, বিগ-ব্যাংয়ের প্রায় ৪লক্ষ বছর পর। তাই CMBয়ের মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্বের যে ছবি দেখতে পাই, সেটা রিকম্বিনেশনের সময়কার। মহাবিশ্বের বর্তমান বয়স প্রায় ১৩.৭বিলিয়ন বছর। আমরা যদি মহাকাশের পূর্বে তাকাই, তবে ১৩.৭ বছরের পুরোনো CMB দেখতে পাবো। অথবা, যদি পশ্চিমে তাকাই, তবে সেদিকেও ১৩.৭ বিলিয়ন বছরের পুরোনো CMB দেখতে পাবো। মহাকাশের বিপরীত প্রান্তীয় CMB ফোটনদের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ২৭.৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। এই দুই CMBয়ের পক্ষে কখনোই ১৩.৭বিলিয়ন বছরে ২৭.৪বিলিয়ন আলোকবর্ষ পাড়ি দিয়ে একে অন্যের সংস্পর্শে আসা সম্ভব নয়। ব্যাপারটা এটাই ইঙ্গিত করে যে, বিগ-ব্যাংয়ের সময় এই দুই প্রান্তীয় CMBদের ফোটনগুলো কখনোই কাছাকাছি আসার সুযোগ পায়নি। তাই আমরা ধরে নিতেই পারি যে, মহাবিশ্বের একবারে কিনারার CMB গুলোর মাঝে তাপমাত্রার পার্থক্য উল্লেখ করার মতো। সমস্যা হলো, WMAPয়ের তথ্য অনুসারে এই পার্থক্য দশলক্ষভাগের একভাগ। শুধুই তাই নয়, আমরা মহাকাশের যে দিকেই তাকাই এবং CMBয়ের যে তারতম্য লক্ষ্য করি, সেটা অতিনগন্য, প্রায় ±0.004 ডিগ্রী কেলভিন। অর্থাৎ, CMB অনুসারে মহাবিশ্ব আগাগোড়াই সমান (Isotropic)। প্রশ্ন হলো, মহাবিশ্বের ইতিহাসে প্রান্তীয় CMBয়ের ফোটনেরা যদি কখনোই একে অন্যের সংস্পর্শে আসার সুযোগ না পায়, তবে তাদের তাপমাত্রা এতো কাছাকাছি হলো কিভাবে? এই ব্যাপারটিকে বলে দিগন্ত-সমস্যা বা Horizon problem।
ফ্ল্যাটনেস-প্রবলেম, কোইন্সিডেন্স-স্ক্যান্ডেল, এবং দিগন্ত-সমস্যা এই তিনটি ছিলো স্ট্যান্ডার্ড-কসমোলজির সবচেয়ে বড় সমস্যা। ১৯৮১ সালে মার্কিন পদার্থবিদ অ্যালেন-গুথ সর্বপ্রথম ইনফ্লেশন-তত্ত্ব (Inflation theory) বা স্ফীতি-তত্ত্ব প্রস্তাব করে, যেটা একই সাথে এই তিনটি সমস্যার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয়। অ্যালেন-গুথ কাজ করছিলেন GUTয়ের (Grand unified theory) ওপর। GUTয়ের লক্ষ্য ছিলো প্রবল-নিউক্লিয়ার-বল এবং দুর্বল-বৈদ্যুতিক-বলের সমন্বয় ঘটানো। এই GUTয়ের একটা ভবিষ্যদ্বাণী ছিলো, ম্যাগনেটিক-মনোপল বা একমেরুযুক্ত-চুম্বক। আমরা প্রকৃতিতে ইলেকট্রিক-মনোপল বা বৈদ্যুতিক-একমেরুযুক্ত কণা দেখি, যেমন: ইলেক্ট্রন বা প্রোটন। কিন্তু, প্রকৃতিতে কখনোই একমেরুযুক্ত-চুম্বক দেখতে পাওয়া যায় না। অ্যালেন-গুথ মহাবিশ্বের এমন একটি প্রারম্ভিক-শর্ত (Initial condition) তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন যেটা, একমেরুযুক্ত-চুম্বক নিরুদ্দেশ হবার কারণ ব্যাখ্যা করবে। ইনফ্লেশন-তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্বের শুরুতে কিছু একমেরুযুক্ত চুম্বক তৈরি হয়েছিলো ঠিকই। কিন্তু, এরপরই মহাবিশ্ব হঠাৎ ভয়াবহ গতিতে সম্প্রসারিত হতে থাকে। ফলে, ঐ একমেরুযুক্ত-চুম্বকগুলো মহাবিশ্বের এমনভাবে ছড়িয়ে যায় যে, এদের খুঁজে বের করাটা খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতো ব্যাপার।
অ্যালেন-গুথ স্ফীতি-তত্ত্ব প্রস্তাব করে ১৯৮১ সালে, মহাবিশ্বের ত্বরিত-সম্প্রসারণশীলতা আবিষ্কারের অনেক আগেই। তাই মহাবিশ্বের স্ফীতিকরণ বা ইনফ্লেশন পর্যায়টি ব্যাখ্যা দিতে গুথকে সম্পূর্ণ নতুন একটি কোয়ান্টাম-বলক্ষেত্র উদ্ভাবন করতে হয়। গুথের এই বলক্ষেত্রকে বলে ইনফ্ল্যাটন-বলক্ষেত্র (Inflaton field)। ইনফ্ল্যাটন-বলক্ষেত্র বৈশিষ্ট্যগতভাবে কুইনটেসেন্স-বলক্ষেত্র মতোই, অনেকেই এই দুটোকে একই বলক্ষেত্র মনে করেন। কিন্তু, ব্যাপার হলো, ইনফ্ল্যাটনের প্রভাব ছিলো মহাবিশ্বের একেবারেই প্রারম্ভিক পর্যায়, এবং কুইনটেসেন্সের প্রভাব অতিসম্প্রতি। আর এইজন্যই এদের একই বলক্ষত্র হবার সম্ভাবনা কম।
স্ফীতি-তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্ব শুরুতেই তিনটি পর্যায় মধ্যে দিয়ে গেছে: স্ফীতিকরণ, বিচলন (Perturbation), এবং রিহিটিং (Reheating)।
স্ফীতিকরণ: বলে রাখা ভালো, স্ফীতি-তত্ত্বের লক্ষ্য হলো স্ট্যান্ডার্ড-কসমোলজির প্রারম্ভিক-শর্ত নির্ধারণ করা, যাতে করে মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থার স্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যা দেয়া যায়। মহাবিশ্বের জন্ম এবং বিগ-ব্যাং দুটি ভিন্ন ঘটনা। মহাবিশ্বের জন্ম হয় সিঙ্গুলারিটি থেকে, এই সিঙ্গুলারিটি এবং বিগ-ব্যাংয়ের মাঝেমাঝি সময়টিতে ঘটে স্ফীতিকরণ। জন্মের প্রায় ১০^(-৩৫)তম সেকেন্ডে মহাবিশ্বের স্ফীতিকরণ শুরু হয়। স্ফীতিকরণ পর্যায়ে ইনফ্ল্যাটন-বলক্ষেত্র বিপুল শক্তিতে তীব্রবেগে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ঘটাতে থাকে। এই স্ফীতিকরণের পূর্বে স্থানকালের যেকোনো জ্যামিতিক-বক্রতা থাকা সম্ভব ছিলো। কিন্তু, তীব্র স্ফীতিকরণের ফলে এই বক্রতা অতিদ্রুত বিলীন হয়ে যায়। অনেকটা কুঁচকানো চাদরকে টানটান করে বিছিয়ে ফেলার মতো। ফলে, বিগ-ব্যাং শুরুর আগেই মহাবিশ্ব সমতল হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, মহাবিশ্বের শূন্য-বক্রতা ব্যাখ্যার জন্য আমাদের আর ডার্ক-এনার্জির দ্বারস্থ হতে হবে না। তাই, ফ্ল্যাটনেস-প্রবলেম থাকলো না। এর আরেকটা দিক হলো, কোইন্সিডেন্স-স্ক্যান্ডেল থেকে মুক্তি। কারণ, স্ফীতি-তত্ত্ব অনুসারে, আমাদের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই মহাবিশ্ব সমতল ছিলো।
বিচলন: ইনফ্ল্যাটন-বলক্ষেত্র একটি কোয়ান্টাম-বলক্ষেত্র, আর তাই হেইজেনবার্গের: ∆t * ∆E ≥ ħ/2; অসমতাটি ইনফ্ল্যাটনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা আগের পর্বে দেখেছি, এই অসমতার করণে স্থানকালের শূন্যস্থানে প্রতিনিয়তই অসংখ্য ভার্চুয়াল-কণা তৈরি হয় এবং হারিয়ে যায়। এই ব্যাপারটিকে বলে কোয়ান্টাম-ফ্লাকচুয়েশন। এই কোয়ান্টাম-ফ্লাকচুয়েশনের কারণে কোনো কোয়ান্টাম-বলক্ষেত্র মসৃন হতে পারে না। ইনফ্ল্যাটন যখন স্থানকালের বক্রতা মুছে দিয়ে স্থানকালকে তীব্র বেগে সম্প্রসারণ করছিলো, একইসময় কোয়ান্টাম-ফ্লাকচুয়েশন ইনফ্ল্যাটন-বলক্ষেত্রের সর্বাংশে সামান্য বিচলন তৈরি করছিলো।
রিহিটিং: স্ফীতিকরণ শেষে ইনফ্ল্যাটন বলক্ষেত্রের প্রায় সবশক্তিই পদার্থ (সাধারণ এবং ডার্ক-ম্যাটার) এবং বিকিরণ কণায় রূপান্তরিত হয়। শক্তি থেকে ভরের এই রূপান্তরকে বলে রিহিটিং। রিহিটিং শেষে ইনফ্ল্যাটন-বলক্ষেত্র তার সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে এসে পৌঁছে। ফলে, শেষ হয় মহাবিশ্বের স্ফীতিকরণ, এবং শুরু হয় বিগ-ব্যাং। রিহিটিং পর্যায়টি ভীষণভাবে প্রভাবিত হয় কোয়ান্টাম-ফ্লাকচুয়েশন দ্বারা। কোয়ান্টাম-ফ্লাকচুয়েশনের কারণে ইনফ্ল্যাটন-বলক্ষেত্রে যে বিচলন তৈরি হয়েছিলো, তার কারণেই রিহিটিং পর্যায়ে পদার্থ এবং বিকিরণের ঘনত্ব মহাবিশ্বের সব অংশে সমানভাবে হয়নি। গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো, স্ফীতি-তত্ত্বের গাণিতিক ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, কোয়ান্টাম-ফ্লাকচুয়েশনের কারণে মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের পদার্থ-ঘনত্বের তারতম্যের, এবং পর্যবেক্ষণকৃত CMBয়ের তাপমাত্রার তারতম্য সমঞ্জস্যপূর্ণ।
যেহেতু CMBয়ের ফোটনগুলো তৈরি হয় একই ইনফ্ল্যাটন-বলক্ষেত্র থেকে, তাই মহাকাশের যেকোনো প্রান্তের CMBয়ের তাপমাত্রা প্রায় সমান। অন্যদিকে, CMBয়ের তাপমাত্রায় নগন্য তারতম্যের কারণ হলো ইনফ্ল্যাটন-বলক্ষেত্রের কোয়ান্টাম-ফ্লাকচুয়েশন। অর্থাৎ, স্ফীতি-তত্ত্বে আর দিগন্ত-সমস্যা রইলো না।
স্ফীতি-তত্ত্বের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে: CMBয়ের পোলারাইজেশন এবং বহুবিশ্ব (Multiverse)।
ইনফ্ল্যাটনের পাশাপাশি অন্য যেই বলক্ষেত্রটি মহাবিশ্বের জন্মের সময় থেকেই কাজ করছিলো, তার নাম মাধ্যাকর্ষণ। ইনফ্ল্যাটনের প্রভাবে স্থানকালের তীব্র সম্প্রসারণ মাধ্যাকর্ষণ-বলক্ষেত্রে ঢেউ তৈরি করেছিলো, যাকে বলে মাধ্যাকর্ষণ-তরঙ্গ। সমস্যা হলো, মহাবিশ্বের স্ফীতিকরণ পর্যায়ের তৈরি হওয়া এই মাধ্যাকর্ষণ-তরঙ্গ বর্তমানে অত্যন্ত দুর্বল। এই দুর্বল মাধ্যাকর্ষণ-তরঙ্গ শনাক্তকরণের প্রযুক্তি আপাতত আমাদের কাছে নেই। কিন্তু, ভিন্ন উপায়ে আমরা এই মাধ্যাকর্ষণ-তরঙ্গের উপস্থিতি নির্ণয় করতে পারি।
আমরা জানি, ফোটন ১-স্পিনযুক্ত কণা। এই স্পিনের উপাংশের ওপর নির্ভর করে ফোটনের পোলারাইজেশন। রিহিটিংয়ের সময় তৈরি হওয়া CMB ফোটনের স্পিন-উপাংশ মাধ্যাকর্ষণ-তরঙ্গের প্রভাবে পাল্টে যায়, এতে ফোটনের পোলারাইজেশনও বদলে যায়। স্ফীতি-তত্ত্বের মাধ্যমে গাণিতিকভাবে এই পোলারাইজেশন পরিবর্তনের পরিমাণ নিখুঁতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। আপাতত আমরা জানি, CMB ফোটনের পোলারাইজেশন ভিন্ন, তবে এর পরিমাণ প্রত্যাশিত ভবিষ্যদ্বাণীর সমান কিনা সেটা জানার জন্য আমাদেরকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ইউরোপীয় স্পেস-এজেন্সী বা ESAয়ের অত্যাধুনিক প্লান্ক-স্যাটেলাইট মিশনের একটা উদ্দেশ্য হলো এই CMB-পোলারাইজেশন নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা।
স্ফীতি-তত্ত্বের আরেকটি ভবিষ্যদ্বাণী হলো, বহুবিশ্ব। স্ফীতি-তত্ত্ব অনুসারে আমাদের মহাবিশ্ব হলো স্থানকালের ছোট্ট একটা অঞ্চল। আমরা স্থানকালের যে অঞ্চলগুলো দেখতে পাই না, সেই অঞ্চলগুলোতে হয়তো ইনফ্ল্যাটন-বলক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্নভাবে বিকশিত হচ্ছে। ফলে, ওই অঞ্চলগুলোর ভৌত-প্রক্রিয়াগুলোও হয়তো ভিন্ন। ইনফ্ল্যাটন-বলক্ষেত্রের প্রভাবে একই স্থানকালের বিভিন্ন অংশে অগণিত বিগ-ব্যাং মহাবিশ্ব থাকা সম্ভব। এই ভবিষ্যদ্বাণী যদি বাস্তব হয় তবে, কসমোলজিক্যাল-কনস্ট্যান্ট সমস্যারও একটা বিহিত হবে। হয়তো, বিভিন্ন মহাবিশ্বে Λয়ের মান বিভিন্ন। অর্থাৎ, বহুবিশ্বের প্রেক্ষাপটে, আমাদের মহাবিশ্বের Λ = ১০^(-১২০) হয়তো ল্যামডার অগণিত সম্ভাব্য মানের মধ্য একটি।
আমরা দেখেছি, ডার্ক-ম্যাটার এবং ডার্ক-এনার্জির কারণ আইনস্টাইনের সাধারণ-আপেক্ষিকতা। তাই প্রশ্ন হতে পারে, আইনস্টাইনের মাধ্যাকর্ষণ ধারণা কি সঠিক?
পদার্থবিদ মর্ডেহাই-মিলগ্রোম (Mordehai Milgrom) ভেরা-রুবিনের মতোই একাধিক গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করেন এবং গ্যালাক্সিগুলোর রোটেশন-কার্ভ সম্পর্কে কিছু স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। তার এই সিদ্ধান্তগুলো যেকোনো গ্যালাক্সির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
প্রথমত, যেকোনো গ্যালাক্সির কিছু প্রান্তীয় অঞ্চল আছে, নক্ষত্ররা যদি এই অঞ্চলের বাহিরে অবস্থান করে, তবে অতিরিক্ত মাধ্যাকর্ষণ ব্যাখ্যা করতে ডার্ক-ম্যাটার প্রয়োজন। এই অঞ্চলকে বলে ক্রসওভার-পয়েন্ট। মিলগ্রোম লক্ষ্য করেন যে, যেকোনো গ্যালাক্সির ক্রসওভার-পয়েন্ট কেন্দ্র থেকে একই দূরত্বে অবস্থিত।
দ্বিতীয়ত, ডার্ক-ম্যাটার রাখতে হয় গ্যালাক্সির ফাঁপা অংশে, যদি ডার্ক-ম্যাটার গ্যালাক্সির ভেতরে সাধারণ-পদার্থের সাথে রাখা হয়, তবে প্রান্তীয় নক্ষত্রগুলোর আবর্তন হয় অস্থিতিশীল।
এই পর্যবেক্ষণ থেকে মিলগ্রোম মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা দেন। তিনি বলেন যে, ক্রসওভার-পয়েন্ট পর্যন্ত মাধ্যাকর্ষণ 1/r^2 নীতি অনুসরণ করে। কিন্তু, ক্রসওভার-পয়েন্ট পেরিয়ে গেলে মাধ্যাকর্ষণ 1/r নীতি অনুসরণ করে।
1/r^2 নীতির কারণে দূরত্বের বাড়ার সাথে সাথে মাধ্যাকর্ষণ চারগুণ শক্তি হারায়। অন্যদিকে, 1/r নীতির কারণে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি হারাবে মাত্র অর্ধেক। ফলে, মিলগ্রোম ধারণা অনুসারে, দূরের নক্ষত্রগুলো ওপর গ্যালাক্সির মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাব কমতে থাকবে কাছের নক্ষত্রগুলোর চেয়ে অনেক ধীরে।
অর্থাৎ, মিলগ্রোমের মতে, স্বল্প দূরত্বে মাধ্যাকর্ষণ বলের শক্তিমাত্রা 1/r^2 বা বিপরীত-বর্গীয়-নীতি অনুসরণ করে। কিন্তু, বেশি দূরত্বে মাধ্যাকর্ষণ শুধু বিপরীত-নীতি বা 1/r অনুসরণ করে। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে মিলগ্রোম মাধ্যাকর্ষণের মন্ড-তত্ত্ব (MOND বা Modified newtonian dynamics) প্রস্তাব করেন। মাধ্যাকর্ষণের মন্ড-তত্ত্ব ডার্ক-ম্যাটার ছাড়াই গ্যালাক্সিদের রোটেশন-কার্ভ ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু, ক্লাস্টারের ক্ষেত্রে মন্ড-তত্ত্ব ব্যর্থ হয়।
জেকব-বেকেনস্টেইন পরবর্তীতে মন্ড-তত্ত্বের গাণিতিক পরিবর্তন আনেন। এই পরিবর্তিত মন্ড-তত্ত্ব ক্লাস্টারের রোটেশনাল-কার্ভেরও ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছিলো। সমস্যা হলো, বেকেনস্টেইনের গাণিতিক ব্যাখ্যা ছিলো অত্যন্ত জটিল। এবং মন্ড-তত্ত্বে ডার্ক-ম্যাটার দরকার না হলেও, ডার্ক-এনার্জি এবং তপ্ত-কণা বা নিউট্রিনোর দরকার ছিলো।
মাধ্যাকর্ষণের ধরণ পাল্টানোর জন্য, সাধারণ-আপেক্ষিকতার মূল সমীকরণকেও অনেকভাবে পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। সমস্যা হলো, এই সমীকরণের যেকোনো পরিবর্তনের ফলে মাধ্যাকর্ষণের জন্য একাধিক বলক্ষেত্রের প্রয়োজন হয়। এই বলক্ষেত্রগুলো গ্র্যাভিটন ছাড়াও সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির মাধ্যাকর্ষণ কণার জন্ম দেয়। মাধ্যাকর্ষণ যদি একাধিক সম্পূর্ণ ভিন্ন কণার মাধ্যমে প্রকাশ পেতো, তবে আমরা নিশ্চিতভাবে এতোদিনে তাদের প্রভাব অন্যান্য কণাদের ওপর দেখতে পেতাম।
সুতরাং, মহাবিশ্ব ব্যাখ্যায় ৯৫% ডার্ক-ম্যাটার এবং ডার্ক-এনার্জি টেনে আনা ছাড়া আপাতত অন্য কোনো উপায় নেই। যেদিন আমরা এই ৯৫%য়ের প্রকৃত রহস্য উম্মোচন করতে পারবো, সেদিন হয়তো বর্তমান পদার্থবিজ্ঞানের আমূল পরিবর্তন ঘটবে।
অবলম্বনে: “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “Dark Matter, Dark Energy: The Dark Side of the Universe” by “Sean Carroll”