ক্রিয়েশনিস্টদের প্রতি খোলা চিঠি

অন্তর্বর্তী ফসিল: একটি বাস্তবধর্মী প্রত্যাশা

বিবর্তন তত্ত্ব অনুসারে, আজকের প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের আবির্ভাব ঘটেছে সুদূর অতীতে, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের পৈতৃক জীববৈচিত্র থেকে। সময়ের সাথে সাথে এই আদিম পৈতৃক জনপদের বৈশিষ্ট্যগুলো পরিবর্তিত হতে থাকে, এবং একসময় সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এই পরিবর্তনগুলো অপেক্ষাকৃত ধারাবাহিক, এবং এই পরিবর্তনের ধারায় একটি প্রজাতি প্রায় কয়েক হাজার প্রজন্ম শেষে তার আদিম গঠন থেকে স্পষ্টতই আলাদা হয়ে যায়। প্রজাতিকরণের গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তরগুলো যেমন: মাছ থেকে উভয়চর, কিংবা সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী, ইত্যাদি নিশ্চিতভাবে কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে অনেকগুলো অন্তর্বর্তী ধাপের মাধ্যমে ঘটেছে। তাই আমরা স্বভাবতই ফসিল আকারে এই অন্তর্বর্তী ধাপগুলোর প্রমাণ পাওয়ার আশা করতে পারি।

মূলধারার বিজ্ঞানের দাবি, এসব অন্তর্বর্তী ফসিল যথেষ্ট পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু, ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্ট এবং ইন্টেলিজেন্ট-ডিজাইনের প্রবক্তারা মোটেই একমত নয়। এই প্রসঙ্গে তারা ডারউইনের অরিজিন-অফ-স্পেসিসের (ষষ্ঠ সংস্করণ) নিচের উদ্ধৃতিটুকু তুলে ধরে,

“অতীতে টিকে থাকা অন্তর্বর্তী বৈচিত্রতারগুলোর সংখ্যা নিশ্চয়ই অনেক ছিলো। তাহলে কেনো প্রতিটি ভূতাত্ত্বিক কাঠামো এবং প্রতিটি শিলাস্তরকে এইসব অন্তর্বর্তী ফসিলে পরিপূর্ণ অবস্থায় দেখা যায় না? বিস্ময়করভাবে ভূতত্ত্ব কোনো নিখুঁত ধারাবাহিক জৈব শৃঙ্খল উন্মোচন করে না, এবং এটাই সম্ভবত তত্ত্বের বিরুদ্ধে আনার মতো সবচেয়ে সুস্পষ্ট এবং গুরুতর অভিযোগ।”

তাই, বিবর্তনের স্বপক্ষে কিংবা বিরুদ্ধে একটি উল্লেখেযোগ্য প্রমাণ হলো এই অন্তর্বর্তী ফসিল। সঠিক মূল্যায়নের স্বার্থেই এই  অন্তর্বর্তী ফসিলগুলোর প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা জরুরি। অন্তর্বর্তী ফসিলের প্রকৃতি চারটি প্রভাবক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যেগুলো নিচে ব্যাখ্যা করা হলো।

প্রথমেই, কিছু আভিধানিক শব্দ: জীবিত অণুজীবদের বিভিন্ন স্তরে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। এই স্তর বিন্যাস উঁচু থেকে নিচুতে এভাবে সাজানো: ডোমেইন, কিংডোম, ফাইলাম, ক্লাস, অর্ডার, ফ্যামিলি, জেনাস, এবং স্পেসিস (প্রজাতি)। স্পেসিসের আরো নিচে রয়েছে স্ট্রেইন বা উপপ্রজাতি। সমস্ত প্রাণীদের একসাথে একটি কিংডোমে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়, আর উদ্ভিদের অন্য কিংডোমে। মনে রাখা দরকার, এই শ্রেণীকরণ প্রক্রিয়াটি মানুষেরই তৈরী, মানুষই এই শ্রেণীকরণ এলোমেলো জীবজগতের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আর তাই, যৌক্তিক কারণেই বিজ্ঞানীদের মাঝে এই শ্রেণীকরণের বিভিন্ন উপায় নিয়েই মতানৈক্য থাকতেই পারে। উদ্ভিদ বা প্রাণী যেকোনো প্রজাতির একটি সাধারণ সংজ্ঞা হলো, একটি বড় দলবদ্ধ অণুজীব যারা আন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে উর্বর সন্তান জন্ম দান করতে পারে।

অন্তর্বর্তী ফসিলের চারটি মুখ্য প্রভাবক

(১) ফসিল সহজাত কারণেই দুর্লভ। বহুকাল আগের মৃত অণুজীবদের খুবই সমান্যই ফসিলে পরিণত হয়েছে। আমাদের আশেপাশের দেখা যায়, অক্ষত অবস্থায় শিলাস্তরের নিচে চাপা পরার বদলে প্রায় সব মৃতদেহই পঁচে যায়, নয়তো অন্যান্য প্রাণী বা জীবাণুরা খেয়ে ফেলে। অন্যদিকে, সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বেড়ে শিলাস্তর পানিতে ডুবে গেলে ঐ শিলাস্তরে আটকে থাকা অনেক ফসিলই ক্ষয়ে যায়। আবার, শিলাস্তর যদি ভুপৃষ্টের খুব গভীরে চাপা পড়ে থাকে, তাহলে ফসিল শিলাস্তরে এমনভাবে লেপ্টে যায় যে, ফসিলদের গঠন বোঝার কোনো উপায়ই থাকে না। শেষে সমস্যাটা পেলিওজোয়িক যুগের (ক্যামব্রিয়ান থেকে পার্মিয়ান যুগ পর্যন্ত) ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য, কারণ সুদীর্ঘ ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার ফলে পেলিওজোয়িক ফসিলগুলো ভুপৃষ্টের ওপরে উঠে উন্মোচিত হয়ে ক্ষয়ে যাবার, কিংবা ভুপৃষ্টের আরো গভীরে নিমজ্জিত হবার সুযোগ পেয়েছে। অন্যদিকে, জীবাশ্মবিদদের নাগালের মধ্যে, ভুপৃষ্টের খুব কাছাকাছি পাওয়া যায় এমন ফসিলযুক্ত শিলাস্তর খুব সামান্যই।

উইকিপিডিয়ার অনুসারে “ফসিলের মাধ্যমে আবিষ্কৃত প্রজাতির সংখ্যা আমাদের জানা প্রজাতিগুলোর ৫ শতাংশেরও কম। অনুমান করা হয় যে, এই পর্যন্ত আমাদের জানা-অজানা যত প্রজাতি পৃথিবীতে এসেছে, ফসিলের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছে তাদের ১ শতাংশেরও কম”। শুধু জীবিত প্রাণীদের কথাই ধরা যাক, তিরিশটির বেশি ফাইলার অন্তর্ভুক্ত জীবিত প্রাণীদের এক তৃতীয়াংশেরই কোনো ফসিল এখনো পাওয়া যায়নি। মাঝে মধ্যে আমরা বার্গেস শেলের (Burgess Shale) মতো এমন কিছু পুরোনো শিলাস্তর খুঁজে পাই, যেগুলো সুদূর অতীতে স্থানীয় প্রাণীকুলের ফসিল সংরক্ষণের জন্য একদম উপযুক্ত অবস্থায় ছিলো, এইধরণের শিলাস্তর ঐ সময়কার জীববৈচিত্রের একটা স্থিরচিত্রের মতো। ল্যাগেরসস্ট্যাট (Lagerstatte) পলিল শিলাস্তরকে ব্যতিক্রম মনে করা হলেও বাস্তবে এই শিলাবিন্যাসও একই নিয়ম প্রমাণিত করে: আদিম সমুদ্রগুলো জীব বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ ছিলো, কিন্তু, ফসিল গঠনের মতো অতি বিরল অবস্থা ছাড়া, অধিকাংশ সময়ে এবং জায়গাতেই ঐ জীবকুল ফসিল হিসেবে সংরক্ষিত হতে পারেনি।

সিল্যাকান্থ (Coelacanth) অর্ডারের মাছগুলো ফসিলের খামখেয়ালীপনার একটা বড় উদাহরণ। সুদূর অতীতে এই মাছগুলো সারা মহাসাগর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। সিল্যাকান্থের ফসিল প্রাচুর্যতা সবচেয়ে বেশি ২৪০ মিলিয়ন বছর পুরোনো শিলাস্তরে, এরপর ফসিলের পরিমাণ কমতে থাকে। এই মাছের সাম্প্রতিক ফসিল ৮০ মিলিয়ন বছরের পুরোনো। একসময় মনে করা হতো সিল্যাকান্থ বুঝি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু, ১৯৩৮ সালে ভারত মহাসাগরে একটি জীবিত সিল্যাকান্থ ধরা পড়ে। এরপর আরো জীবিত সিল্যাকান্থের সন্ধান পাওয়া যায়। এখন, কোনো বুদ্ধিমান সত্ত্বা যদি অলৌকিকভাবে এই আধুনিক সিল্যাকান্থ পুনর্জীবিত না করে, তবে আমাদেরকে স্বীকার করতেই হবে যে, এই মাছের কিছু ঝাঁক গত ৮০ মিলিয়ন বছর ধরে বেঁচে ছিলো যাদের কোনো ফসিলই নেই।

ফসিলের এরকম বিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার মুখোমুখি হাবার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। এখানে সিল্যাকান্থের মতোই ফসিলে মিলিয়ন বছর হারিয়ে থাকা কিছু ট্যাক্সন দেয়া আছে, যাদের পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়া যায়।

(২) ছোট, বিচ্ছিন্ন পপুলেশনে নতুন প্রজাতি উদ্ভবের প্রবণতা বেশি। পপুলেশন জেনেটিক্সের একবারে মৌলিক গণিত অনুসারে, কোনো নতুন জেনেটিক মিউটেশনের জন্য ছোট পপুলেশনে টিকে থাকা সহজ, কিন্তু বড় পপুলেশনে খুব কঠিন। অর্থাৎ, বড় পপুলেশনে নতুন জেনেটিক মিউটেশনের স্থায়িত্ব খুব কম হয়। এই ব্যাপারটা একাধিক ল্যাবরোটারী স্টাডিতে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন: Perfeito et al দেখেন যে, ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রে উপকারী মিউটেশনগুলো বড় পপুলেশনের চেয়ে ছোট পপুলেশনে খুব সহজেই প্রতিষ্ঠিত হয়। 

এটা খুবই সম্ভব যে, নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে ছোট, বিচ্ছিন্ন পপুলেশনে, যারা এমন পরিবেশগত চাপের ভেতর থাকে যা জেনেটিক পরিবর্তনে অনুকূলে। আর এই ধরণের ছোট, সীমিত পপুলেশনের ফসিল পাওয়া সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। পরিবর্তনের পর এই প্রজাতি যদি তার পুরোনো রূপের চেয়ে বেশি সক্ষমশীল হয়, তাহলে তারা বিস্তার লাভ করবে, আর তখনই এদের ফসিল পাওয়া সম্ভাবনা বাড়বে। কিন্তু সমস্যা হলো, একবার যখন এই নতুন প্রজাতি বিস্তার লাভ করবে এবং তার  ইকোলোজিতে সফলভাবে  খাপ খাইয়ে নেবে, তখন তাদের ওপর প্রাকৃতিক নির্বাচনে চাপ কমে যাবে। ফলে, এই নতুন অভিযোজিত প্রজাতিগুলোর মিলিয়ন বছর ব্যাপ্তিতে যে ফসিলগুলো পাওয়া যাবে তাতে উল্লেখেযোগ্য পরিবর্তন থাকবে না।

(৩) কোনো পপুলেশন কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে শুধু নগন্য গঠনগত পরিবর্তন নিয়েই টিকে থাকতে পারে।সিল্যাকান্থ পপুলেশনের দীর্ঘায়ুর ব্যাপারটা থেকে বোঝা যায় যে, কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে একটি প্রজাতি টিকে থাকে পারে শুধু অতিসামান্য পরিবর্তন নিয়ে। ধরুন, আমরা যদি কোনো প্রজাতির ফসিল পাই, যার শিলাস্তর ১০০ মিলিয়ন বছরের পুরোনো। তাহলে আমরা যদি এর সবচেয়ে প্রাচীনতম ফসিল খুঁজে নাও পাই, এটা খুবই সম্ভব যে, প্রায় একই সম্পর্কিত প্রজাতিও (একই জেনাস বা ফ্যামিলিভুক্ত)  ১১০ মিলিয়ন বছর বা তারও আগে উপস্থিত ছিলো। ব্যাপারটা সিল্যাকান্থের গত ৮০ মিলিয়ন বছরেরও আগের ফসিলবিহীন বংশানুক্রমের মতো।

(৪) বিবর্তনীয় বংশানুক্রম শাখা-প্রশাখার মতো বিস্তারের প্রবণতা রয়েছে। গাছের সাথে তুলোনা করা হলে, বংশানুক্রম সংযোগকারী কাণ্ডের বদলে, ফসিলে সাধারণত দেখতে পাওয়া যায় বহিঃস্থ শাখা-প্রশাখাগুলোতে। এই শাখা প্রজাতিগুলোতে প্রায়শই অন্তর্বর্তী বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু, এরা যথার্থ অন্তর্বর্তী ফসিল নয়।

ঘোড়ার বিবর্তন: শাখা বংশানুক্রমের উদাহরণ

ছোট্ট পূর্বপুরুষ থেকে আধুনিক ঘোড়ার (জেনাস: ইক্যাস/Equus) বিবর্তন ফসিলের মাধ্যমে শক্তভাবে সমর্থন করা যায়। হাইরাকোথেরিয়াম/Hyracotherium (একে কখনো কখনো ইয়োহিপ্পাস/Eohippus, বা  প্রথম ঘোড়া/Dawn Horse বলে) পৃথিবীতে বিচরণ করতো আজ থেকে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন বছর আগে। দাঁড়ানো অবস্থায় এরা মাত্র ১৮ ইঞ্চি (৫০ সেন্টিমিটার) লম্বা, দেখতে ছোট কুকুরের মতো। এদের দাঁত অভিযোজিত হয়েছিলো ফল এবং নরম ঘাস, লতাপাতা খাবার জন্য। অন্যদিকে, আজকের বন্য ঘোড়াগুলো তেজস্বী ভঙ্গিমায় সমতল ভূমিতে ঘুরে বেড়ায় এবং শক্ত ঘাস খায়। হাইরাকোথেরিয়ামের সাথে এই আধুনিক ঘোড়ার পা এবং পায়ের হাড় গড়ন একেবারেই ভিন্ন। নিচের ছবিতে দাঁত, পায়ের আঙ্গুল, এবং সার্বিক শরীরের আকারের পরিবর্তনগুলো দেখানো হয়েছে।

dlevine-horse-evol

নিচের ছবিটি ফ্লোরিডার ন্যাশনাল হিস্ট্রি জাদুঘর থেকে নেয়া, যেখানে সময়ের সাথে সাথে ঘোড়ার খুলির ফসিলের আকার ও কাঠামোর পরিবর্তন দেখানো হয়েছে।

floridamuseum-horse-evol

কেথলিন হান্ট (Kathleen Hunt) তার এই প্রবন্ধে ঘোড়ার একটি পূর্ণাজ্ঞ বংশানুক্রম দেখিয়েছেন (জেনাস থেকে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে)। হান্টের দেখানো শাখা-প্রশাখার পরিমাণ উদ্ধার করা ফসিল থেকেও বেশি।

khunt-horse-fossil-tree

হান্ট কয়েকটি স্পষ্ট, ধারাবাহিক পরিবর্তনের কথা বলেছেন যেটা ফসিল পরম্পরায় পাওয়া যায়। যেমন: হাইরাকোথেরিয়ামের/Hyracotherium (ইয়োহিপ্পাস/Eohippus) দুই পাশের চোয়ালে মাত্র তিনটি পেষণ দাঁত ছিলো, ওরোহিপ্পাসের/Orohippus চারটি, এপিহিপ্পাসের/Epihippus পাঁচটি, এবং মেসোহিপ্পাসের গালে ছিলো ছয়টি পেষণ দাঁত (cheek teeth)। যদিও ইয়োহিপ্পাস এবং আধুনিক ঘোড়ার মধ্যে স্পষ্ট বংশানুক্রম রেখা টানা যায়, হান্ট সর্তকতার সাথে মন্তব্য করেন, ফসিলে যে জটিল প্যাটার্ন দেখা যায় তা একমুখী কোনো প্রবণতা নির্দেশ করে না

ঘোড়ার প্রজাতিগুলো শাখা-প্রশাখার মতো ক্রমাগত বিবর্তনীয় বংশানুক্রম  থেকে বেরিয়ে যায়, যাদের গতিধারার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। আপাত দৃষ্টিতে ঘোড়ার বিবর্তনে কোনো সুস্পষ্ট রেখা নেই। অনেক ঘোড়ার প্রজাতি একই সময়ে উপস্থিত ছিলো, যাদের পায়ের অঙ্গুল সংখ্যা ছিল ভিন্ন, যারা ভিন্ন ভিন্ন খাদ্যাভ্যাসে অভিযোজিত হয়েছিলো।হাইরাকোথেরিয়াম থেকে ইক্যাস পর্যন্ত অনুসরণ করলে আমরা কয়েকটি বংশানুক্রমিক প্রবণতা দেখতে পাই: পদাঙ্গুলির সংখ্যা হ্রাস, গালের দাঁতের আকার বৃদ্ধি, মুখ লম্বাটে হওয়া, শরীরের আকার বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু, এই প্রবণতা সব ঘোড়া প্রজাতির মধ্যে দেখা যায় না, তবে সামগ্রিকভাবে, ঘোড়ার আকারে বড় হতে শুরু করলো। অন্যদিকে কিছু কিছু ঘোড়া (আর্কিওহিপ্পাস/Archeohippus, ক্যালিপ্পাস/Calippus) পরবর্তীতে ছোট হতে লাগলো। অনেক সাম্প্রতিক প্রজাতির ঘোড়াদের চেহারায় জটিল খাঁজ ছিলো, কিন্তু এদের কিছু উত্তরপুরূষ এই বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। অতি সাম্প্রতিক (৫-১০ মিলিয়ন বছর) ঘোড়াদের পদাঙ্গুলি একটি নয় বরং তিনটি ছিলো। এই তিন পদাঙ্গুলির ঘোড়ারা বিলুপ্ত হওয়ার কারণেই, আমরা ফসিলে “এক পদাঙ্গুলির” দিকে ধাবিত হবার প্রবণতা দেখতে পাই।

অন্তর্বর্তী ফসিলের ওপর লেখা এই প্রবন্ধে কেইথ মিলার (Keith Miller) নিচের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন:

আর্শ্চযজনকভাবে, বিবর্তনের কিছু সমালোচক ইয়োহিপ্পাস (হাইরাকোথেরিয়াম) থেকে ইক্যাস পর্যন্ত পাওয়া ফসিলগুলোকে তুচ্ছ মনে করেন। এরকম মনে করার কারণ হলো, অন্তর্বর্তী গঠনগুলো আমাদের জানা রয়েছে। এই অন্তর্বর্তী গঠনগুলো ছাড়া, বংশানুক্রমিক গঠনগত ভিন্নতাকে অনেক বিশাল মনে হতো। ইয়োহিপ্পাস ছিলো খুব ছোট (কিছু প্রজাতি ছিলো মাত্র ১৮ ইঞ্চি লম্বা) এবং তৃণভোজী (সম্ভবত, দ্রুত বর্ধনশীল নিরামিষী)। সুপরিচিত পদাঙ্গুলির সংখ্যার পার্থক্য ছাড়াও (চার পদাঙ্গুলি সামনে, পেছনে তিনটি), ইয়োহিপ্পাসের খুলি ছিলো সরু লম্বাটে, মস্তিষ্ক ছিলো ছোট, এবং চোখ ছিলো খুলির সামনে অবস্থিত। এদের ছোট ছেদক দাঁত (canine teeth), অগ্রজ পেষণ দাঁত (premolars), এবং পাতলা মুকুটযুক্ত সরল পেষণ দাঁত ছিলো। ভূতাত্ত্বিক সময়ের সাথে সাথে মাত্র কয়েকটি বংশাণুক্রমেই, খুলি আরো দীর্ঘ হলো, চোখ পেছনে সরে এলো, এবং মস্তিষ্ক আরো বড় হলো। সামনের ছেদন দাঁতগুলো (incisors) চওড়া হলো, অগ্রজ পেষণ দাঁতগুলো পুরোপুরি পেষণ দাঁতে পরিণত হলো, এবং পেষণ দাঁতগুলোর মুকুটগুলো আরো পুরু এবং এনামেলের (enamel) খাঁজগুলো গভীরতর হলো। 

ঘোড়ার ফসিলের তাৎপর্য পরিষ্কার হতে শুরু করে যখন এগুলোকে প্যারিসোডাক্টাইলা/Perissodactyla (বেজোড় খুরযুক্ত প্রাণী) অর্ডারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে তুলোনা করা হয়। বিলুপ্ত টাইটানোথেরেসের/Titanotheres পর্যাপ্ত ফসিল রয়েছে, এবং এদের প্রাচীনতম সদস্যদের সাথে ইয়োহিপ্পাসের যথেষ্ট মিল রয়েছে। একইভাবে, ট্যাপির/Tapirs ও গন্ডারের প্রাচীন সদস্যরা ছিলো ইয়োহিপ্পাসের মতো। তাই, প্যারিসোডাক্টাইলের শ্রেণীগুলোকে অতীতের দিকে অনুসরণ করলে একই রকম ছোট সাধারণ খুরযুক্ত প্রাণী পাওয়া যাবে।

ফসিল ধারাবাহিকতার প্রত্যাশা 

নিচের ছবিটি ধারাবাহিক ফসিলের ভিত্তিতে A প্রজাতি থেকে D প্রজাতিতে পৌঁছানোর একটি বিবর্তনীয় বংশানুক্রম দেখানো হয়েছে। এই ছবিতে একটি রৈখিক বংশানুক্রম দেখানো হয়েছে, যেখানে পাশাপশি পূর্বসূরিদের ফসিলে পাওয়া যায়। এই ধরণের ফসিলের ধারাবাহিকতায় নতুন প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেলে পূর্ববর্তী প্রজাতির ফসিলগুলো নিখুঁতভাবে হারিয়ে যায়, তাই দুই প্রজাতির ফসিলের মধ্যে কোনো সমপতিত অংশ থাকে না (overlaps)। ওপরের আলোচিত চার প্রভাবকের কারণে ছবিটি মোটেও বাস্তবধর্মী নয়, তবুও ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্টরা এটাই দেখার দাবি জানায়।

figure-1-evol-lineage

নিচের ছবিটি অপেক্ষাকৃত বাস্তবধর্মী ফসিলের ধারাবাহিকতা। যেই বিন্দুগুলো থেকে পূর্বপুরুষদের থেকে প্রজাতিগুলোর বিচ্যুতি ঘটেছে (common ancestors) সেই বিন্দুগুলোতে ফসিল থাকার সম্ভাবনা একবারই ক্ষীণ। বরং, B এবং C -য়ের মতো সফল পপুলেশনগুলো যে শাখা প্রজাতিগুলো তৈরি করে তাদের ফসিলে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। এটা বিবর্তনের কোনো দুর্বলতা নয়। বরং, এটা প্রজাতিকরণের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য (বংশাণুক্রমের শাখা-প্রশাখা, নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে ছোট, বিচ্ছিন্ন পপুলেশনে, ইত্যাদি) এবং যা নির্ভর করে ফসিল সংরক্ষণের উপযুক্ত পরিবেশের ওপর।

figure-2-evol-lineage

ওপরের ছবিটির সমস্যা হলো, সময়ের সাথে সাথে বিবর্তনীয় পরিবর্তনের হার সব প্রজাতির ক্ষেত্রেই সমান দেখানো হয়েছে, যেটা মোটেও বাস্তবধর্মী নয়। আগেই বলা হয়েছে, বিবর্তনীয় পরিবর্তনগুলো ছোট পপুলেশনের ক্ষেত্রে ঘটে অপেক্ষাকৃত দ্রুত, যারা খুঁজে পাওয়ার মতো কোনো ফসিল রেখে যায় না। অন্যদিকে, বিশাল ও সফল পপুলেশনগুলো বহু মিলিয়ন বছর ধরে নগন্য পরিবর্তন নিয়েই টিকে থাকে। “অপেক্ষাকৃত দ্রুত” বলতে এখানে কয়েক মিলিয়ন বছরে মেরুদন্ডী প্রাণীদের নতুন জেনাস উদ্ভবের কথা বোঝানো হয়েছে, অবশ্য যেসব অণুজীবের প্রজনন হার দ্রুত তাদের ক্ষেত্রে কম সময় প্রয়োজন।

প্রজাতিকরণ এবং ফসিলীকরণ হিসেবে আনলে আমরা নিচের ছবির মতো ফসিল প্যাটার্ন দেখতে পাবো।

figure-3-evol-lineage

ওপরের মোটাখাড়া রেখাগুলো A-D প্রজাতিগুলোর কালানুক্রমিক ফসিলের ব্যাপ্তি নির্দেশ করে। B এবং C -য়ের ফসিলগুলো এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার জন্য এদের A এবং D -য়ের অন্তর্বর্তী প্রজাতি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। সমস্যা হলো, এই অন্তর্বর্তী ফসিলগুলো সঠিক বিবর্তনীয় ক্রমানুসারে পাওয়া যায় না। যেমন, C -য়ের সব ফসিলই এক্ষেত্রে B -য়ের পূর্ববর্তী, যদিও বিবর্তনীয় বংশানুক্রম বিশ্লষণে এটা স্পষ্ট যে, B খুব সম্ভবত C -য়ের পূর্বপুরুষ। একইভাবে, D -য়ের কিছু ফসিল C -য়ের সমসাময়িক।

ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্টরা মাঝে মধ্যেই দাবি করে বসে যে, “out of order” ফসিলগুলো বিবর্তনের জন্য বিশাল হুমকি। এই দাবি পুরোপুরি মিথ্যা। কারণ, আলোচিত চার প্রভাবক এই ধরণের প্যাটার্নেরই পূর্বাভাস দেয়। ফসিলে পাওয়া A, B, C, এবং D খুব সম্ভবত বিশাল এবং স্থায়ী পপুলেশন। কিন্তু ব্যাপার হলো, ব্যাপক বিস্তারের আগেও এই প্রজাতিগুলো টিকে ছিলো যদিও ভূতাত্ত্বিক কারণে ঐ সময় তাদের কোনো ফসিল তৈরি হতে পারেনি। এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত যে, B এবং C -য়ের মধ্যকার common ancestor টিকে ছিলো C -য়ের ফসিল তৈরি হবার আগ পর্যন্ত, যদিও এই common ancestor থেকে B পর্যন্ত কোনো ফসিল এখনো  পাওয়া যায়নি।

figure-4-evol-lineage

একটি সম্ভাব্য বংশানুক্রমিক ও ফসিলের ধারাবাহিকতা ওপরে ছবিতে দেখানো হলো। মোটা রেখাগুলো পর্যবেক্ষিত ফসিল, এবং চিকন রেখাগুলো অনুমিত বংশানুক্রমিক সম্পর্ক।

figure-5-evol-lineage

একই ফসিলের ধারাবাহিকতার সম্পূর্ণ ভিন্ন কিন্তু সম্ভাব্য আরেকটি বংশানুক্রম ওপরে দেখানো হলো। এখানে common ancestors -দের ভিন্নধর্মী বিভাজন দেখানো হয়েছে। এখানে প্রশ্ন হলো, কোনো বংশানুক্রমটি (Figure ৪ বনাম ৫) সবচেয়ে ভালোভাবে ফসিলগুলো সাথে খাপ খায়?

অর্থোপড: ফসিল ভিত্তিক বংশানুক্রমের উদাহরণ

ক্ল্যাডিস্টিক্স নামের একটি শিক্ষাক্ষেত্র রয়েছে যেখানে বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন। বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে ফসিলের বিভিন্ন ভৌত বৈশিষ্ট্যগুলো সংজ্ঞায়িত এবং বিশ্লেষণ করেন, সেই সাথে জীবিত প্রজাতিগুলোর মধ্যকার জেনেটিক সম্পর্কও খুঁজে বের করেন। ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে শুরু হওয়া অর্থোপেডদের (পোকামাকড়) বিবর্তনের ওপর ক্ল্যাডিস্টিক্সের চিন্তাভাবনার একটা উদাহরণ নিচে দেয়া হলো। ডেনিস ভেনেমা লিখছেন:

সব জীবিত অর্থোপডদের কিছু নির্ধারক বৈশিষ্ট্য থাকে যেমন: শক্ত খোলস, বিশেষায়িত দেহাংশ, এবং বিশেষায়িত উপাঙ্গ (appendages)। যদিও এই বৈশিষ্ট্যগুলো আধুনিক অর্থোপড সংজ্ঞায়িত করার জন্য প্রয়োজন, এই নির্ধারকগুলো অর্থোপডদের বিবর্তনীয় ইতিহাসের দৃষ্টিতে কম গুরুত্বপূর্ণ। কারণটা সহজ, বিবর্তনের দৃষ্টিতে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো হুট্ করে তৈরি হয়নি। বরং, এই বৈশিষ্ট্যগুলোর আবির্ভাব ঘটে সময়ের সাথে সাথে এবং বংশানুক্রমে ধাবিত হয়েছে আধুনিক অর্থোপডে। তাই, ফসিলে আবিষ্কৃত প্রজাতিগুলোতে অর্থোপড নির্ধারক সব বৈশিষ্ট্যগুলো একসাথে না পাওয়ারই কথা।

arthropods-venema
http://www.biologos.org -য়ে লেখা ডেনিস ভেনেমার “Evolution Basics: The Cambrian Diversification and Assembling Animal Body Plans, Part 1” থেকে নেয়া।

ওপরের বিবর্তনীয় বংশানুক্রম (phylogeny) থেকে আমরা অর্থোপডের মতোই দুই শ্রেণীর অন্তর্বর্তী ফসিলে পাওয়ার আশা করতে পারি। একটি হলো, এমন ফসিল যাদের তিনটির মধ্যে শুধু একটি বৈশিষ্ট্য থাকবে (শুধু বিশেষায়িত উপাঙ্গ)। অন্যটিতে দুটি বৈশিষ্ট্য: বিশেষায়িত উপাঙ্গ এবং দেহাংশ। এই দুই শ্রেণীর প্রজাতিগুলোকে অন্তর্বর্তী ফসিল হিসেবে গণ্য করা যায় এই দৃষ্টিতে যে, এদের গুটি কয়েক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো ধাপে ধাপে আধুনিক অর্থোপডের পূর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট্যে অর্জনের ইঙ্গিত করে।

বস্তুত, উপরোক্ত প্যাটার্নটিই ফসিলের দেখতে পাওয়া যায়। Legg, et al.  -য়ের নিচের ছবিটি থেকে দেখা যায় যে, উপাঙ্গ এবং দেহাঙ্গের ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্থোপডের মতো আদিম প্রাণীদের পরিপূর্ণ আধুনিক অর্থোপডে রূপান্তরের ধারণাটি প্রাপ্ত ফসিলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখানে, আধুনিক অর্থোপডগুলোকে (হেক্সাপোডা/পতঙ্গ, এবং ক্রাস্টাসিয়া/কাঁকড়া) নিচে দেখানো হয়েছে, এবং প্রাচীনতম বিবর্তনীয় শাখাগুলোকে ওপরে। যেমন: এনোমালোক্যারিসের/Anomalocaris যৌগিক চোখ এবং বিশেষায়িত উপাঙ্গ ছিলো, কিন্তু তাদের পুরো শরীরে জুড়ে কঠিন খোলস ছিলো না। একে পূর্ণাঙ্গ অর্থোপডের পরিবর্তে অন্তর্বর্তী অর্থোপড ধরা হয়। ছবিটির প্রতিটি বিন্দুতে (১, ২, ৩, ইত্যাদি) একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন লক্ষ্য করা যায়, যেমন: যৌগিক চোখ, অর্থোপডের মতো অঙ্গ, খোলস ইত্যাদি।

arthropods-legg-2012

উপরের ছবিটিতে দেখানো ক্লাডিস্টিক্স-সম্পর্কগুলো ফসিলের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য যেনোতেনো প্রস্তাব করা হয়নি। নিক ম্যাৎজকি (Nick Matzke) এই ডায়াগ্রামটি তৈরির পেছনে কি পরিমাণ কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছে সেটা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে:

এই গবেষকবৃন্দ এবং তাদের পূর্ববর্তীগণ যাদের কাজের ওপর ভিত্তি করে ওনার এগুচ্ছেন, তারা ৫৮০টি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করেছেন, যার প্রতিটিকে চিহ্নিত, সংজ্ঞায়িত, আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের সেটে ভাগ, এবং এনকোড করা হয়েছে। এই শ্রমসাধ্য কাজটি এক্ষেত্রে ১৭৩টি ফসিলের বা জীবিত টেক্সার জন্য পুনরাবৃত্তি করতে হবে…অনেক ফসিলের অনেক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত…যা জীবাশ্ম বিশ্লেষণে খুবই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত…তারপরও এটা একটা বিশাল একটা কাজ। এতকিছু শেষে ক্লাডিস্টিক্স অথবা অন্যান্য ফাইলোজেনেটিক্স বিশ্লেষণ চালাতে হয়…এবং সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান গণনা করা হয়। …প্রায় সব বায়োলজিক্যাল ডাটাসেটেরই উচ্চ সম্ভাবনাময় tree signal থাকে। আর, এই ফলাফল অন্যান্য বিশ্লেষণের সাথে নিখুঁতভাবে নাও মিলতে পারে, কিংবা গবেষকেরা যে ধরণের যোগসূত্র খুঁজছিলেন তার সাথে একমত নাও হতে পারে। এইধরণের মতানৈক্যগুলো গবেষকদের মধ্যকার ব্যাপাক সহযোগিতার মাধ্যমে নিখুঁতভাবে মীমাংসা করা হয়।

মাছ থেকে ট্রেটাপড: মিসিং-লিংক কি পাওয়া গেছে?

৪০০ মিলিয়ন বছর আগে, সমুদ্রগুলোতে বিভিন্ন ধরণের মাছের ব্যাপক বিচরণ ছিলো, এই মাছদের ক্ষীণকায় পাখা (fin) ছিলো, এবং এদের বেশিভাগই পুরোপুরি পানির নিচে বসবাস করতো। প্রায় ৩৬৫ মিলিয়ন বছরের পুরোনো ফসিল যেমন: একান্থসটেগা/Acanthostega এবং ইচথাইওসটেগা/Ichthyostega আদিম টেট্রাপডের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। এই প্রাণীগুলোর চারটি পায়ের মতো অঙ্গ ছিলো, যেগুলো দিয়ে তারা শরীরের ভারবহন করতে পারতো এবং অগভীর পানিতে ঘুরে বেড়াতে পারতো (যদিও তারা খুব সম্ভবত শুকনো ভূমিতে হাঁটা চলা করতে পারতো না)। প্রশ্ন হলো, কিভাবে মাছ পরিণত হলো টেট্রাপডে? এই রূপান্তরের জন্য পায়ের মতো অঙ্গের বিকাশ ছাড়াও, মাথার দুই খন্ড হাড় পরিণত হয় এক খণ্ডে, এবং নিরেট মাথা ও শরীরের সংযোগস্থল প্রতিস্থাপিত হয় নমনীয় ঘাড়ে।

টেট্রাপডের পূর্বসূরির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে গণ্য করা হয় লোব-ফিন/lobe-finned মাছকে। এই মাছের তলদেশের ডানাগুলো শরীরের অভ্যন্তরীণ হাড়ে সাথে লাগানো এবং জোড়ায় জোড়ায় বিন্যস্ত ছিলো। এই ডানাগুলো পরবর্তীতে পায়ে বিবর্তিত হওয়াকে সহজতর করে। ডেভোনিয়ান সময়ে এইধরণের লোব-ফিন মাছগুলো প্রয়োজনে মাথার সূক্ষ্ম ছিদ্র (spiracles) দিয়ে সরাসরি বাতাসে শ্বাস গ্রহণ করতো।

বিভিন্ন ধরণের লোব-ফিন মাছের ফসিল অনেক আগেই জানা গিয়েছে, যাদের ডানার কঙ্কাল কাঠামো অনেকটা পরবর্তীতে আসা স্থলজ প্রাণীর পায়ের হাড়ের আদিম সংস্কারের মতো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ওসথেনোপটেরোন/Eusthenopteron এবং প্যান্ডারিচথাইস/Panderichthys, যাদের সময়কাল প্রায় ৩৮০ মিলিয়ন বছর পুরোনো। যদিও, এদের ফসিলগুলোর বিবর্তনীয় গতিপথ টেট্রাপডের দিকে ইঙ্গিত করে, তথাপি এরা ছিলো সাধারণ মাছের মতোই। তাই, সুস্পষ্ট টেট্রাপড বৈশিষ্ট্যযুক্ত ফসিলের আবিষ্কার এক্ষেত্রে অত্যন্ত সন্তোষজনক হবে।

১৯৯৯ সালে শিকাগো ইউনিভার্সিটির নীল স্যুবিনের (Neil Shubin) নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী এই অন্তর্বর্তী ফসিলের খোঁজে বের হন। যেহেতু, মাছ-টেট্রাপড ফসিলের আবির্ভাব ৩৬৩ থেকে ৩৮০ মিলিয়ন বছরের মধ্যে, তারা মনোযোগ দেন ক্যানাডিয়ান আর্কটিক অঞ্চলের উন্মুক্ত শিলাস্তরের দিকে, যার বয়স ঐসময় পরিসরের ভেতর। এই বিশেষ শিলাস্তরের তৈরি হয়েছিলো অগভীর মিঠাজল পরিবেশে। বছরের পর বছর ধরে উনারা খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়ে যেতে থাকেন, অবশেষে ২০০৪ সালে তাদের পরিশ্রমের পুরস্কার হিসেবে আবিষ্কার করেন টিকটালিক/Tiktaalik। যদিও, টিকটালিক মাছ-টেট্রাপডের বিভাজনের “মাছ” অংশের ভেতর পড়ে, এর টেট্রাপডের মতো আকর্ষণীয় কিছু বৈশিষ্ট্য ছিলো।

টিকটালিকের আবিষ্কার ছিলো বিবর্তনের স্বপক্ষে নাটকীয় জয়। যেকোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের একটি কঠিন পরীক্ষা হলো, তত্ত্বটির অভিনব ভবিষ্যৎবাণী করার ক্ষমতা থাকে হবে, যার সত্যতা পরীক্ষণের নিশ্চিত হওয়া যায়। মূলধারার ভূতত্ত্ব (an old earth) এবং বায়োলজির (common ancestry) ধারণাগত কার্যধারার (conceptual framework) মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে স্যুবিনের দল খোঁড়াখুঁড়ির জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা বেছে নেন, এবং সম্পূর্ণ নতুন ধরণের ফসিলে আবিষ্কার করেন যার ভবিষৎবাণী ওনারা আগেই করেছিলেন। ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্ট এবং ইন্টেলিজেন্ট-ডিজাইনে এমন কিছুই নেই যেটা এমন নিখুঁত এবং অভিনব ভবিষৎবাণী করতে পারে।

উইকিপেডিয়া অনুসারে, মাছ ও টেট্রাপডের মিশ্রিত যে বৈশিষ্ট্যগুলো টিকটালিকের মধ্যে পাওয়া যায় সেগুলো হলো,

মাছ: ফুল্কা, আঁশ, ডানা।

মাছ ও টেট্রাপডের মাঝামাঝি: অর্ধমাছ ও অর্ধটেট্রাপডের মতো পায়ের হাড় এবং সংযোগস্থল (অনেকটা কব্জির সংযোগস্থলের মতো, তবে হাতের বদলে ডানা বিস্তার লাভ করে)। কানের অঞ্চলটি অর্ধমাছ ও অর্ধটেট্রাপডের মতো।

টেট্রাপড: পাঁজরের হাড় এবং ফুসফুস। আলাদা আলাদা পেক্টোরাল-গার্ডেলযুক্ত (pectoral girdle) নড়াচড়া করার মতো নমনীয় ঘাড়।

২০১৪ সালে, স্যুবিন এবং তার সহকর্মীবৃন্দ পেলভিক গার্ডেল (pelvic girdle) এবং ডানার ওপর বিস্তারিত পেপার প্রকাশ করেন, যেখানে টিকটালিকের মাছ এবং টেট্রাপডের অন্তর্বর্তী বৈশিষ্ট্যগুলো পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়েছে:

টিকটালিকের পেলভিস জোড়ায় জোড়ায় বিন্যস্ত এবং এদের প্রশস্ত ইলিয়াক (iliac) কার্যকারিতা রয়েছে, এদের রয়েছে সমতল এবং লম্বাটে পিউব (pubes), এবং এসিটাবুলা (acetabulae) যেটা বলিষ্ঠ হাড় দিয়ে ঘেরা গভীর সকেট গঠন করে। অন্যান্য ডানাযুক্ত টেট্রাপডোমর্ফদের তুলোনায় টিকটালিকের পেলভিস অনেক বড়। বৃহৎ এবং বলিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও টিকটালিকের পেলিভস আদিম বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে, যেমন এর সক্রেল-পাঁজর (sacral rib) এবং ইসকিয়াম (ischium) সংযোগস্থল নেই। 

নিচের ছবিটি আহ্লবার্গ এবং ক্লাক থেকে নেয়া, যেখানে ফসিলে পাওয়া কঙ্কাল এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের বর্ণিত পার্থক্যগুলো দেখানো হয়েছে। ছবিতে ফুল্কার আবরণ ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়া (নীল রং) এবং খুলির পুনর্গঠন দেখা যাচ্ছে।

evol-tetrapods-from-tik-nature2006

নিচের ছবিটি কেভিন পাডিয়ানের (Kevin Padian), যেটা পরবর্তীতে আনাস্তাসিয়া থানুকস (Anastasia Thanukos) পুনরাবৃত্তি করেন। ছবিটিতে অন্তর্বর্তী প্রজাতিগুলোর ডানা ও পায়ের খুঁটিনাটি দেখানো হয়েছে। নিচে ৮ ডিজিট থেকে ৭ ডিজিট, এবং ৭ ডিজিট থেকে ৬ ডিজিটের একটা ধারাবাহিক প্রগতি লক্ষ্য করা যায়। এই ৭ এবং ৬ ডিজিটযুক্ত ফসিলগুলোকে অন্তর্বর্তী ডানা হিসেবে গণ্য করা যায়, কারণ জীবিত টেট্রাপডের অঙ্গুল ৫ ডিজিট। ছবিতে অবশ্য এই ফসিল প্রজাতিগুলোর পূর্ববর্তী বংশানুক্রমের (common ancestor) সময়সীমা দেয়া হয়নি।

evol-tetrapods-padian
K. Padian, Integra Comp Biol 2008; 48: 175-88, reproduced in A. Thanukos, Evolution: Education and Outreach 2009; 2: 84-89.

টিকটালিকের আবিষ্কার নিঃসন্দেহে প্রশংসা যোগ্য, কিন্তু এর ভূমিকাকে বাড়িয়ে বলা হলে সমস্যা হতে পারে। কিছু বিজ্ঞান জনপ্রিয়কারক এই মাছকে আমাদের “পূর্বপুরুষ” বলে উল্লেখ করেছেন। আবারও বলে রাখা দরকার, ওপরে দেখানো প্রতিটি প্রজাতিই বিবর্তনীয় শাখা-বংশানুক্রমের একেবারেই শেষপ্রান্ত (dead-end)। সাবধানতার সাথে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, ওপরের কোনো প্রজাতিই বর্তমান জীবিত টেট্রাপডের পূর্বপুরুষ নয়। বরং, তাদের মধ্যে কিছু হলো বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যাদের কিছু টেট্রাপডের মতো বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এবং বাকিরা টেট্রাপড প্রজাতি যাদের মধ্যে মাছের বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এবং এদের এমন ভূত্বাত্তিক সময়ে পাওয়া যায় যা আধুনিক টেট্রাপড ফসিল আবির্ভাবেরও অনেক অনেক পুরোনো। টেট্রাপড যদি সত্যিই লোব-ফিন মাছ থেকে বিবর্তিত হয়, তাহলে আমরা ইতিমধ্যেই প্রত্যাশিত অন্তর্বর্তী ফসিল পেয়ে গেছি। এই সময়টা ৩৫০ মিলিয়ন বছর পুরোনো, যা মহাদেশগুলোর ওঠা-নামা, ভেঙে যাওয়া বা জোড়া লাগার জন্য যথেষ্ট সময়, আর এই ধরণের আন্তঃমহাদেশীয় কার্যালাপ খুব সহজেই প্রাচীন ফসিলকে ধ্বংস বা আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাহিরে নিয়ে যেতে পারে।

টেট্রাপডের সর্বশেষ খবর হলো, ২০১০ সালে Niedźwiedzki et al পোল্যান্ডে পাওয়া ৩৯৭ মিলিয়ন বছরের পুরোনো শিলাস্তরে একটি অচেনা প্রজাতির টেট্রাপডের পদচিহ্ন আবিষ্কারের তথ্য প্রকাশ করেন। যা কিনা, এক্যান্টোসটেগা এবং আইচটোসটেগার চেয়েও ৩০ মিলিয়ন বছরের পুরোনো। এর পরপরই আয়ারল্যান্ডের সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত ভালেন্টিয়া দ্বীপে সম্ভাব্য ৩৮৫ মিলিয়ন বছরের পুরোনো টেট্রাপডের পদচিহ্ন পাওয়া যায়। এই পদচিহ্নগুলো আসলেই কোনো টেট্রাপডের কিনা সে ব্যাপারে এখনো বিতর্ক রয়েছে। আর, এগুলো সত্যি যদি টেট্রাপডের হয়ে থাকে, তবে মাছ থেকে টেট্রাপড রূপান্তরের সময়সীমা আমাদের পূর্বানুমানের চেয়ে আরো ৩০ মিলিয়ন বছর পেছনে ঠেলে দেবে। ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্ট এটা বিবর্তনের জন্য বিরাট একটা সমস্যা মনে করেন, কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। এটা স্রেফ টিকটালিক, এক্যান্টোসটেগা, ইত্যাদির সময়সীমা আরো বর্ধিত করবে। 

ফ্রিডম্যান এবং ব্রাজাউ টেট্রাপড সম্পর্কিত ডেভোনিয়ান ফসিলগুলো বিশ্লেষণ করে দেখতে পান যে, ঐ সময়কালে টিকে থাকা সমস্ত টেট্রাপড প্রজাতির মাত্র গুটি কয়েকের ফসিল পাওয়া গিয়েছে। তুলোনা করলে, ডেভোনিয়ান সময়কালে প্রজাতিদের ফসিল সংরক্ষণের হার সেনোজোয়িক সময়কালের শুধু উত্তর আমেরিকার স্তন্যপায়ী প্রজাতিদের চেয়েও কয়েকগুণ কম। আর তাই, এটা মোটেও আর্শ্চযজনক নয় যে, ডেভোনিয়ান সময়কালের টেট্রাপডদের ফসিলগুলোতে প্রচুর ফাঁক রয়েছে।

নিচের ফাইলোগ্রামটি পূর্ববর্ণিত Niedźwiedzki থেকে নেয়া, এখানে কিছু নির্দিষ্ট লোব-ফিন মাছ, মূলধারার টেট্রাপড, এবং সেই সাথে অচেনা প্রজাতির (যাদের পদচিহ্ন পাওয়া গেছে) সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। এখানে: Pan= Panderichthys, Tik=Tiktaalik,  Aca= Acanthostega, Ich= Ichthyosteg, and  Tul = Tulerpeton.

tetrapods-polish-trackway
Niedźwiedzki et al., Nature 463, 43-48 (2010)

আরেকটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে, কিছু প্রাচীন ডেভোনিয়ান পদচিহ্ন বাস্তবে টেট্রাপডের নয়, বরং মাছেরা অগভীর পানিতে ডানার ওপর ভর করে ছোটাছুটি করার সময় এগুলো তৈরি হয়েছিলো। King, et al. ২০১১ সালে প্রকাশিত একটি স্টাডিতে দেখান, কিভাবে একটি আধুনিক লাঙফিশ তাদের পেলভিক ডানা ব্যবহার করে সমুদ্রের তলদেশ হাঁটার মতো পর্যায়ক্রমিক প্যাটার্ন তৈরি করতে পারে, এবং এর পুরো সময়টা জুড়ে লাঙফিশের বাকি শরীরটা পানিতে ভেসে থাকে। Niedźwiedzki পেপারে উল্লেখিত পোলিশ পদচিহ্ন (PGI 1728.II.15 (Figure 2 c.)) দেখতে এমনই দুই ডানার কারসাজি বলে মনে হয়। আপাত দৃষ্টিতে, এই পদচিহ্নগুলো তৈরি হয়েছে একজোড়া উপাঙ্গের মাধ্যমে (চার পায়ের মাধ্যমে নয়), এই দুই উপাঙ্গ কখনো কখনো পর্যায়ক্রমে আবার কখনো একইসাথে সমান্তরালে ঠেলা দেবার প্যাটার্ন তৈরি করেছে।

সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী

সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ীর বিবর্তনে রয়েছে কৌতূহলোদ্দীপক প্যাঁচ। সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের চোয়াল এবং কানের হাড়ের কাঠামোতে রয়েছে লক্ষণীয় পার্থক্য। সরীসৃপের নিচের চোয়ালে রয়েছে নূন্যতম চারটি হাড়, স্তন্যপায়ীদের মাত্র একটি। কিন্তু, সরীসৃপদের মধ্যেকর্ণে রয়েছে মাত্র একটি হাড়, অন্যদিকে স্তন্যপায়ীদের তিনটি (হ্যামার, এনভিল, এবং স্টেপস)। বিকাশমান ভ্রূণের ওপর পরীক্ষা করে জানা গেছে, দুটি হাড় যেটা সরীসৃপের ক্ষেত্রে নিচের চোয়ালে সন্নিবেশিত হয়, স্তন্যপায়ীর ক্ষেত্রে হাড় দুটি সন্নিবেশিত হয় মধ্যকর্ণে।

বিংশ শতাব্দীর শুরু দিকে বিজ্ঞানীরা সম্ভাব্য অন্তর্বর্তী প্রজাতির সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তারা এমন ধরণের অন্তর্বর্তী প্রজাতির কথা কল্পনা করার চেষ্টা করছিলেন, যারা এই হাড় দুটো ধীরে ধীরে চোয়াল (সরীসৃপ) থেকে মধ্যকর্ণে (স্তন্যপায়ী) সরে আসার সময়কালে যথেষ্ট পরিমাণ শ্রবণ ক্ষমতা এবং চোয়ালের শক্তি বজায় রাখতে পেরেছিলো। বিস্তারিত TalkOrigins -য়ে লেখা ডগলাস থিওবাল্ডের এই প্রবন্ধে রয়েছে।

reptile-mammal-theobald-figure-2
Douglas Theobald, “29+ Evidences for Macroevolution”, http://www.TalkOrigins.org; Figure based on K. V. Kardong, Vertebrates: Comparative Anatomy, Function, Evolution. New York: McGraw Hill (2002).

বিংশ শতাব্দীর পুরো সময় জুড়ে পাওয়া একশ্রেণীর ফসিল থেকে জানা যায় যে, এই দুটি হাড়ের স্থানান্তর ঘটে একাধিক পর্যায়ে। এক পর্যায়ে, চোয়ালে দুটি স্বাধীন সংযোগস্থল ছিলো। এই পর্যায়টি চোয়ালকে নড়নক্ষম, এবং একইসাথে হাড় দুটোকে চোয়াল ও মধ্যকর্ণের মধ্যবর্তী অবস্থান ধরে রাখতে অপরিহার্য ছিলো।

ওপারে ছবিটি TalkOrigins -য়ের প্রবন্ধ থেকে নেয়া, যেখানে হাড়ের এই স্থানান্তর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ছবিতে তিনটি আদর্শ খুলির পার্শ্বদৃশ্য দেখানো হয়েছে: স্তন্যপায়ী, থেরাপসিড (স্তন্যপায়ীর মতো সরীসৃপ), এবং পেলেইকোসেরাস (প্রাচীন সরীসৃপ)। স্থানান্তরিত হাড়গুলোকে গোলাপি, হলুদ, ও নীল রঙে দেখানো হয়েছে, এবং চোয়ালের সংযোগস্থল কালো বিন্দুর মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। অন্তর্বর্তী ফসিল থেরাপসিডের ক্ষেত্রে, হাড়গুলো চোয়ালের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় স্বাধীন দুটি সংযোগস্থল তৈরি করেছিলো।

অন্তর্বর্তী ফসিল কি বিবর্তনকে প্রমাণিত করে?

আমরা এই পর্যন্ত বেশ কয়েকটি উদাহরণ দেখিয়েছি, যেখানে বর্ণিত চারটি প্রভাবক হিসেবে আনলে (ফসিল সংরক্ষণের বিরলতা, ছোট পপুলেশনে প্রজাতিকরণ প্রবণতা, ইত্যাদি) ফসিল ধারাবাহিকতা বিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির মধ্যকার সামান্য পরিবর্তন আমাদের নাগালের বাহিরে, এবং সরাসরি রৈখিক বংশানুক্রম সাধারণত পাওয়া যায় না। তথাপি, কোনো বিশাল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শ্রেণীর কিছু জ্ঞাতি (cousin) ফসিল পাওয়া যায়, যেগুলো অন্তর্বর্তী বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে, এবং এই ফসিলগুলোর সময়কাল ঐ বিশাল পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেকোনো বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে এগুলো বিবর্তনের পক্ষে শক্তিশালী সাক্ষ্য প্রমাণ তৈরি করে, এবং এটা নিশ্চিতভাবে দেখানো যায় যে, ফসিল বিবর্তনের জন্য কোনো সমস্যাই সৃষ্টি করে না।

ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্টরা তাহলে এই ফ্যাক্টগুলো থেকে কি ফাঁকফোকর বের করে? তাদের সব দাবি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে মিথ্যাসাব্যস্তকরণ করতে গেলে আস্ত একটা বই লিখতে হবে, তাই এখানে শুধু গুটি কয়েক ইস্যু উল্লেখ করা হলো। এক ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্ট তথাকথিত এক “ফ্যাক্ট” হাজির করেছিলো যা আপাত দৃষ্টিতে বিবর্তনকে ভুল প্রমাণিত করে। ঘোড়ার বিবর্তনের স্বপক্ষে ফসিলের প্রমাণ এতোই শক্তিশালী যে, বিবর্তন বিরোধীদের এক্ষেত্রে “ফ্যাক্ট” জোগাড় করতে বাড়তি প্রচেষ্টার দরকার হয়েছিলো। এরকম প্রচেষ্টার ফসল স্বরূপ এক “ফ্যাক্ট” হলো, হাইরাকোথেরিয়ামের (ইয়োহিপ্পাস) ফসিল নাকি প্রাচীন ঘোড়ার পূর্বসূরিদের নয়, বরং ঐ ফসিল নাকি আধুনিক হ্যারাক্সের (Hyrax) হাড়গোড় (এরা মধপ্রাচ্যে বিচরণ করে, দেখতে খরগোশের মতো)। তাদের এই দাবি TalkOrigins -য়ের এই প্রবন্ধে মিথ্যাসাব্যস্ত করা হয়েছে।

একটি রকম আরেকটা “ফ্যাক্ট” তারা প্রচার করেছিলো যে, হাইরাকোথেরিয়াম এবং ইক্যাস দুটোই নাকি পাওয়া গেছে একই শিলাস্তরে, তাদের এই দাবিও মিথ্যা

এটা অবশ্যম্ভাবী যে, গত দেড়শত বছর ধরে ফসিল সংগ্রহ এবং বিন্যস্ত করার সময় বিজ্ঞানীরা কিছু কিছু ভুলত্রুটি মুখোমুখি হয়েছেন। যেমন: গত একশত বছর ধরে বিজ্ঞানের টেক্সটবুকগুলোতে চার পদাঙ্গুলির হাইরাকোথেরিয়াম থেকে এক পদাঙ্গুলির ইক্যাস পর্যন্ত বিবর্তনকে একক, পরিষ্কার, অপরিবর্তনশীল বংশানুক্রমের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, শাখা-বংশানুক্রম (Branching), শেষপ্রান্তে পৌঁছানো বংশানুক্রম (Dead end), যুগপৎ বংশানুক্রম, ইত্যাদি কারণে সার্বিক দৃশ্যপট অনেক জটিল। ১৯৫০ সালের সময় থেকে অনেক বিজ্ঞানীই স্বীকার করেন যে, ঘোড়ার বিবর্তনের পূর্ববর্তী সরল দৃশ্যপট সঠিক ছিলো না। ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্টরা এই বক্তব্যকে লুফে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রচার করতে থাকে: অবশেষে বিবর্তনবাদীরা মেনে নিলেন যে, ফসিল রেকর্ড বিবর্তনকে সমর্থন করে না!

শঠতার সাথে বিজ্ঞানীদের উদ্ধৃতি ব্যবহার করা ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্ট লেখকদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এই “উদ্ধৃতি খননকারী” (quote mining) প্রতিষ্ঠানটি অপ্রাসঙ্গিক কোনো মন্তব্য নিয়ে, গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বাদ দিয়ে, বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে যাতে তাদের আকাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। TalkOrigins -য়ের Quote Mine Project অংশটিতে নিবেদিতভাবে এই ধরণের বিভ্রান্তিমূলক উদ্ধৃতিকরণকে উন্মোচিত করা হয়েছে।  

তাদের চিন্তাভাবনা অনেকটা এরকম, চলো এবার আমরা এই উদ্ধৃতি নিয়ে ক্যাঁচাল করি, (আমরা এই উদ্ধৃতিটি প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করেছি):

“অতীতে টিকে থাকা অন্তর্বর্তী বৈচিত্রতারগুলোর সংখ্যা নিশ্চয়ই অনেক ছিলো। তাহলে কেনো প্রতিটি ভূতাত্ত্বিক কাঠামো এবং প্রতিটি শিলাস্তরকে এইসব অন্তর্বর্তী ফসিলে পরিপূর্ণ অবস্থায় দেখা যায় না? বিস্ময়করভাবে ভূতত্ত্ব কোনো নিখুঁত ধারাবাহিক জৈব শৃঙ্খল উন্মোচন করে না, এবং এটাই সম্ভবত তত্ত্বের বিরুদ্ধে আনার মতো সবচেয়ে সুস্পষ্ট এবং গুরুতর অভিযোগ।”

ডারউইনের অরিজিন-অফ-স্পেসিস থেকে নেয়া এই উদ্ধৃতিটি ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্টদের অগণিত ওয়েবসাইটে এমনভাবে ব্যবহার করা হয় যেনো, ডারউইন নিজেই স্বীকার করেছেন, “ফ্যাক্ট” তার তত্ত্বকে সমর্থন করে না! ক্রিয়েশনিস্ট অবশ্য সবসময়ই এরপরের উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করতে ভুলে যায়, যেটাতে ডারউইন বলেছেন, কেনো এই তথাকথিত “ফ্যাক্ট” তার তত্ত্বের জন্য কোনো সমস্যা নয়: “আমি মনে করি, এর ব্যাখ্যা হলো, ভূতাত্ত্বিক রেকর্ড অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ।” আমরা আগেই ব্যাখ্যা করেছি, ডারউইনের অনুমান একদম সঠিক।

পরবর্তী অনুচ্ছেদে ডারউইন অত্যন্ত নির্ভুলভাবে ফসিলে ধারাবাহিকতার প্রকৃতি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন:

“প্রথমেই তত্ত্ব অনুসারে মনে হতে পারে, কি ধরণের অন্তর্বর্তী প্রজাতির উপস্থিতি অবশ্যাম্ভী ছিলো। যেকোনো দুটি প্রজাতি নেয়া হলে, নিজেকে এই দুইয়ের সরাসরি অন্তর্বর্তী কল্পনা না করাটা আমার নিজের কাছেই কঠিন মনে হয়। কিন্তু, এটা পুরোপুরি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের অন্তর্বর্তী খুঁজতে হবে প্রতি প্রজাতি এবং একটি সাধারণ (common) কিন্তু অজানা পূর্বপুরুষের মধ্যে।” 

এই “সাধরণ কিন্তু অজানা পূর্বপুরুষ” নির্দেশ করে রৈখিক common ancestor যাদের ফসিল পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম (যেটা আগেই বলা হয়েছে)।

এই উদ্ধৃতিগুলো অরিজিন-অফ-স্পেসিসের দশম অধ্যায় থেকে নেয়া, যার শিরোনাম “On The Imperfection Of The Geological Record”। এই অধ্যায়ের উপসংহারে ডারউইন বলেন, “আমি ভূতাত্ত্বিক রেকর্ডকে দেখি পৃথিবীর ইতিহাসের মতো যাকে ত্রুটিপূর্ণভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং লিখা হয়েছে পরিবর্তনশীল ভাষায়। এই ইতিহাসের শুধু শেষ খণ্ডটি আমাদের নিয়ন্ত্রণের আছে, যেটাতে লেখা আছে মাত্র দুই কি তিন শতাব্দীর ইতিহাস। এই খণ্ডের এখানে সেখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট্ট একেকটি অধ্যায়, এবং প্রতি পৃষ্ঠার এখানে ওখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে গুটি কয়েকটি লাইন। এই ইতিহাসের প্রতিটি শব্দ লেখা হয়েছে ধীর গতিতে পরিবর্তিত হতে থাকা এক ভাষায়, এই পরিবর্তনের হার অধ্যায়গুলোর কোথাও কম কোথাও বেশি, এই ভাষা নির্দেশ করে জীবগঠন, যাদের সমাধিস্থ করা হয় পরবর্তী শিলাস্তরে, এবং এটাই আমাদের কাছে মনে হয় হুট্ করে “আবির্ভাব”। এই দৃষ্টিতে উপরোক্ত জটিলতাগুলো  নিমেষেই অদৃশ্য হয়ে যায়। “  আবারো ডারউইন একদম সঠিক।

ডারউইন স্বীকার করেন যে, সব জায়গাতেই অগণিত নিখুঁত অন্তর্বর্তী ফসিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই, তথাপি তিনি যৌক্তিক সংখ্যক উল্লেখযোগ্য অন্তর্বর্তী ফসিল পাওয়া কথা বলেছেন। তিনি ষষ্ঠ সংস্করণের একাদশতম অধ্যায়ে লিখেছেন:

“যেহেতু, ফসিল তৈরির পূঞ্জীভূতকরণ প্রক্রিয়া প্রায়শই ব্যাহত হয়, ফলে ধারাবাহিক ফসিলের মাঝে বিশাল ফাঁকা অংশ সৃষ্টি হয়, শেষ অধ্যায়ে আমি যা দেখানোর চেষ্টা করেছি, যেকোন একটি বা দুইটি ফসিল শিলাস্তরের ক্ষেত্রে, সকল অন্তর্বর্তী প্রজাতি যেগুলো এই ফাঁকা অংশের মধ্যে পড়ে, তাদের পাওয়ার আশা করা আমাদের উচিত হবে না। কিন্তু, এই ফাঁকা অংশের পরে, যা কিনা বছরের হিসেবে খুবই লম্বা, যদিও ভূতাত্ত্বিক পরিমাপে সামান্য সময়, কাছাকাছি স্বগোত্রীয় ফসিল, অন্যান্য লেখকের ভাষ্যমতে প্রতিনিধিমূলক প্রজাতি, আমরা নিশ্চিতভাবে এদের খুঁজে পাই। সংক্ষেপে, আমরা নির্দিষ্ট জীবগঠনের ধীর এবং দুর্লভ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মিউটেশনের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণ খুঁজে পাই, যেটা প্রত্যাশা করার ন্যায্যতা আমাদের রয়েছে।” 

“… ভূতাত্ত্বিক রেকর্ড যে অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ সেটা দেখানোর আমি চেষ্টা করেছি;…শুধু বিশেষ কিছু শ্রেণীর জীবই ব্যাপকভাবে ফসিল অবস্থায় সংরক্ষিত হয়;…প্রাণীকে মৃত্যুর পর ডুবে যেতে হয়, ফলে এদের ওপর পলির পুরু স্তর জমা হতে পারে, এবং এই পলির স্তর যথেষ্ট পুরু হতে হয় যাতে ভবিষৎ ক্ষয় থেকে রক্ষা পায়, এবং পরপর ফসিল তৈরির মাঝে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়…প্রথমত প্রজাতিকে স্থানীয় হতে হবে এবং সবশেষে, প্রতি প্রজাতি অনেকগুলো অন্তর্বর্তী ধাপ অতিবাহিত করে, এটা খুবই সম্ভব যে প্রজাতিদের পরিবর্তিত হবার সময়কাল অপরিবর্তিত থাকার সময়কালের চেয়ে ছোট। এই ব্যাপারগুলোকে যদি একসাথে নেয়া হয়, তাহলে কেনো আমরা অনেক যোগসূত্র খুঁজে পাই কিন্তু অন্তর্বর্তী প্রজাতি খুঁজে পাই না, এই ধাঁধার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব, একইসাথে বিলুপ্ত এবং টিকে থাকা সমস্ত প্রজাতির মধ্যে নিখুঁত ধারাবাহিক সম্পর্ক তৈরি করাও সম্ভব হবে।”   

উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলো অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে অন্তর্বর্তী ফসিলের স্বল্পতা ব্যাখ্যা করে (যেমন: দুর্লভ ফসিল, ছোট স্থানীয় পপুলেশনের প্রতি বিবর্তনের ঝোঁক, শাখা-প্রশাখাযুক্ত বংশানুক্রম, ইত্যাদি)। এবং এই কথাগুলো পরিষ্কারভাবে অরিজিন-অফ-স্পেসিসে উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রবন্ধটি ডারউইনের দেড়শো বছরেরও বেশি পুরোনো লেখার একটা ঝলক মাত্র। সুতরাং, “ডারউইন তার তত্ত্বের দুর্বলতা স্বীকার করেছিলেন” এই ধারণা জাহির করার কোনো অজুহাত বিবর্তন বিরোধীদের নেই।

সংশয়বাদের বৈচিত্রতা

ফসিল রেকর্ড স্পষ্টতই বিবর্তনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। বস্তুত শুধু ফসিলই নয়, একই কথা ভূতত্ত্ব, জীববিজ্ঞান, রসায়ন, এবং জেনেটিক্সের মতো ভৌত পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কঠিন বাস্তবতা হলো, একজন নিবেদিত প্রাণ ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্ট কখনোই ম্যাক্রো বিবর্তনকে মেনে নেবে না, তাকে যতোই ভৌত সাক্ষ্য প্রমাণ দেয়া হোক না কেনো। তার সামনে যতোই অন্তর্বর্তী ফসিল আনা হোক না কেনো, সে কোনো না কোনো উপায়ে প্যাঁচাল শুরু করবে। সে হয়তো বলবে, “ঠিক, এই ফসিলগুলো ধারাবাহিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে, কিন্তু তুমি কখনোই প্রমাণ করতে পারবে না যে, এদের একটি অন্যটিতে বিবর্তিত হয়েছে, তুমি শুধু ফসিলগুলোর মধ্যে বিবর্তনীয় সম্পর্ক অনুমান করছো।” অথবা “তুমি কিভাবে জানো যে, সৃষ্টিকর্তা অলৌকিক উপায়ে এই প্রজাতিগুলোকে এমন ধারাবাহিকভাবে সৃষ্টি করেননি?”

বিল নাইয়ের (Bill Nye) সাথে ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্ট কেন হ্যামের (Ken Ham) সাম্প্রতিক বিতর্কে হ্যামের উপস্থাপিত বক্তব্যে আমার কিছু সমালোচনা রয়েছে। তথাপি, “দৃঢ়প্রত্যয়ী” থাকবার কারণগুলো সততার সাথে স্বীকার করার জন্য আমি হ্যামকে সমাদর করি। তাকে যখন জিজ্ঞাস করা হয়েছিলো, “এমনকি কিছু আছে, যেটা আপনার মনের পরিবর্তন ঘটাবে?” প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, “এই প্রশ্নের উত্তর হলো, আমি একজন খ্রীষ্টান, এবং খ্রীষ্টান হিসেবে আমি আপনাদের প্রমাণ দিতে পারবো না, কিন্তু সৃষ্টিকর্তা নিশ্চিতভাবে তার বাণী এবং যীশুখৃষ্টের মাধ্যমে নিজেকে আমার কাছে প্রকাশ করেছেন। বাইবেল সৃষ্টিকর্তার বাণী। আমি মেনে নিচ্ছি যে, বাইবেলে থেকেই আমি সবকিছু শুরু করবো…এবং সৃষ্টিকর্তার বাণীর প্রসঙ্গে, না, কেউই আমাকে বোঝাতে পারবে না যে, সৃষ্টিকর্তার বাণী সত্য নয়।” এটা ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্ট মনোভাবের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, এজন্যই তারা সাক্ষ্য প্রমাণের ব্যাপারে একদম সংবেদনহীন।

বেশিরভাগ ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের প্রবক্তারাও ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্টদের মতোই রক্ষণশীল খ্রীষ্টান ধর্মবিশ্বাস দ্বারা অনুপ্রাণিত, এবং তারা তাদের নিয়মপ্রণালী (Methodology) নিয়ে যথেষ্ট দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সবকিছুর মধ্যে “ডিজাইন” খুঁজে পাওয়ার দাবি করে, কিন্তু কার্যালাপ অনুসারে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন স্রেফ ক্ল্যাসিক god-of-the-gaps। আধুনিক বিবর্তনীয় ইতিহাসের শূন্যস্থানগুলোর কথা জানতে পেরে অনেক খ্রীষ্টান পুলোকিত হন, এই শূন্যস্থানগুলোর যেনো সৃষ্টিকর্তার অপরিহার্যতা প্রমাণ করে। দুঃখজনকভাবে, ইন্টেলিজেন ডিজাইন অনবরত আমাদের জ্ঞানের বিভিন্ন শূন্যস্থানগুলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে, এবং শঠতাপূর্ণ, অর্ধসত্য তথ্য ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের জাহির করে (যেমন:chimp and gorilla genomes, “junk” DNA, এবং Cambrian explosion)।

ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের প্রবক্তারা সাধারণত ফসিলের মূলধারার ভূতাত্ত্বিক সময়কাল মেনে নেয়, সমস্যা হলো, মেনে নেবার সাথে সাথেই তাদের হতবুদ্ধিভাব শুরু হয়: ৫ থেকে ৫৫ মিলিয়ন বছরের অন্তর্বর্তী ঘোড়ার ফসিলগুলো যদি বিবর্তনের ফসল না হয় তবে ওগুলো আসলো কোত্থকে? মেসোজোয়িক সময়কালের সব সরীসৃপ-থেকে-স্তন্যপায়ী অন্তর্বর্তী ফসিলগুলো যদি প্রাকৃতিক বিবর্তনীয় বিকাশ নির্দেশ না করে, তবে এই ফসিলগুলো ওখানে গেলো কিভাবে? তাদের কথা শুনে মনে যেনো, কোনো বুদ্ধিমান সত্ত্বা এক ফুৎকারে এই সমস্ত প্রজাতিগুলোকে ধারাবাহিক হাজির করেছিলো, আর এই ধারাবাহিকতা দেখে মানুষ একসময় নিজেদের বিবর্তিত প্রাণী মনে করার মতো বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। অথবা, সত্ত্বাটি কোনো উপায়ে শারীরিকভাবে প্রজাতিগুলোর ডিএনএ পর্যন্ত পৌঁছে, টিংক্যারিংয়ের মাধ্যমে অতিপ্রাকৃতিক মিউটেশন ঘটান। বুদ্ধিমান সত্ত্বার ফুৎকারের ব্যাপারটি গ্রহণ করা ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্টদের জন্য সমস্যা না হলেও, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের প্রবক্তারা এই ব্যাপারটিতে এসে আটকে যান। কারণটা হাস্যকর, তারা বিজ্ঞানের ছদ্মাবরণ ঠিক রাখতে চান, তাই কোনো বুদ্ধিমান সত্ত্বার তদারকির কৃতিত্ব জানাতে ওনারা অপরাগ।

বড় বড় ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগ লেখকেরাই ভূতাত্ত্বিক, জেনেটিক্স, এবং জীবাশ্মবিদ্যার তথ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তারা শঠতার সাথে এই তথ্যগুলোকে এমন বিকৃতিভাবে উপস্থাপন করেন যে, পাঠকের কাছে তথ্যগুলোকে “দশহাজার বছর বছরের পুরোনো পৃথিবীকে” সঙ্গতিপূর্ণ, কিন্তু প্রাকৃতিক বিবর্তনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয় (এখানে দেখুন Grand Canyon geology)।

গ্যালোপের জরিপ অনুসারে প্রায় ৪৬% মার্কিন নাগরিকই বিশ্বাস করে যে, মানুষ সৃষ্টিকর্তার তৈরি বিশেষ জীব, যার আবির্ভাব ঘটেছে মাত্র কয়েক হাজার বছরের আগে। এই জনগোষ্ঠী স্বাভাবিকভাবেই প্রচলিত বিশ্বাসে গা ভাসবে, আর তাদের এই বিশ্বাসকে সুসংহত করবে ইয়ং-আর্থ ক্রিশনিস্টদের মুখপাত্ররা। উপরন্ত, সাধারণ মানুষ যে ধরণের প্রমাণ দেখতে চায়, বিবর্তনের প্রমাণগুলো মোটেও সে ধরণের নয়। বিজ্ঞানীরা প্রয়োজনে প্রচুর আনুষঙ্গিক প্রমাণাদি উপস্থাপন করতে পারেন, যেগুলোর সাপেক্ষে  বিবর্তন পর্যবেক্ষিত প্যাটার্নে সাথে মিলে যায়। তারপরও, পঞ্চাশ বছর ধরে পরীক্ষণ চালানো হলেও চোখের সামনে নতুন ফাইলামের বিবর্তন দেখানো সম্ভব নয়। সমস্যা হলো, প্রকৃতি ছোট্ট সময়ের পরিসরে জীবজগতে ওপর স্বচালিত বিবর্তনের বিশাল কিন্তু টেকসই পরিবর্তনের কোনো সন্তোষজনক প্রমাণ প্রদর্শন করে না।

সাধারণ মানুষ যেটা দেখে, প্রাণীরা প্রজননের মাধ্যমে তাদের মতোই সন্তান জন্ম দেয়, আর এই প্রক্রিয়ায় প্রাণীদের খুব সামান্যই পরিবর্তন হয়। “বিবর্তন একটি অতি ধীর প্রক্রিয়া” কিংবা “ফসিল প্রমাণাদি স্বাভাবিকভাবেই দুর্লভ” ইত্যাদি বক্তব্যের পেছনে বিজ্ঞানীরা নিঃসন্দেহে বৈধ যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন। কিন্তু, অপপ্রচারণার কারণে বিবর্তন সম্পর্কে যারা শুরু থেকেই সন্দিহান তারা এইসব যুক্তিকে খোঁড়া অজুহাত বলে উড়িয়ে দেবে।

ইয়ং-আর্থ ক্রিয়েশনিস্টদের কর্মপ্ররণা তাদের অদ্ভুত বাইবেলীয় দীক্ষা, অন্যদিকে, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের মুখ্য অনুপ্রেরণা মূলত সংস্কৃতি এবং দর্শন। মৌলিক অবস্থানের প্রসঙ্গে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের বস্তুবাদের প্রতি আতঙ্ক স্পষ্ট ফুটে উঠেছে, তারা কিছু আধুনিক সমস্যা থেকে শুরু করে সমাজতন্ত্রের অপব্যবহার প্রসঙ্গেরও ডারউইনসহ অনেকেই দায়ী করে:

…চার্লস ডারউইন, কার্ল মার্ক্স, এবং সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতো চিন্তাবিদরা মানুষকে ন্যায়পরায়ণ এবং আধ্যাত্মিক সত্ত্বার বদলে নিছক প্রাণী কিংবা যন্ত্র হিসেবে অঙ্কিত করেন, যারা কিছু নৈর্ব্যক্তিক বল দ্বারা চালিত এক মহাবিশ্বে বসবাস করে, যাদের আচরণ ও গভীর চিন্তাভাবনাগুলোর নিয়ন্ত্রণ করে রসায়ন, জীববিদ্যা, এবং পরিবেশের রূঢ় বল। বাস্তবতার এই বস্তুবাদী ধারণা কার্যত আমাদের সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরকে সংক্রমিত করেছে, রাজনীতি ও অর্থনীতি থেকে শুরু করে সাহিত্য ও শিল্পকলা পর্যন্ত…বস্তুবাদীরা লক্ষ্যযুক্ত নৈতিকতার মাপকাঠিকে অস্বীকার করে, এবং দাবি করে আমাদের আচরণ ও বিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশ।…”মানবীয় চিন্তাধারা এবং আচরণ জীববিজ্ঞান এবং পরিবেশের নিয়মে আবর্তিত হয়” এই অজুহাতে বস্তুবাদীরা ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার অবমূল্যায়ন করে।…বস্তুবাদী রূপরেখায় সবাই পরিস্থিতির স্বীকার, তাই কাউকেই নিজ কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হয় না।…পরিশেষে, বস্তুবাদী জন্ম দিয়েছে অত্যন্ত ভয়ানক শ্রেণীর কল্পনাবাদীতার (utopianism)। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ব্যবহার করে নিখুঁত সমাজ গঠনের আশায়, পৃথিবীতে স্বর্গ তৈরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়া দমনমূলক সরকারের কার্যালাপের পক্ষে এই বস্তুবাদী সংস্কারকরা ওকালতি করে। 

ওনাদের বক্তব্যে হয়তো কিছু যৌক্তিক উপাদান আছে, কিন্তু বিবর্তনকে আক্রমণ করে বস্তুবাদের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। এর কারণ হলো, এ পর্যন্ত প্রতিটি জীবিত মানুষ জন্ম গ্রহণ করেছে এবং বেড়ে উঠছে কঠিন বস্তুবাদী প্রক্রিয়ায়। যেমন: প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা শুক্রাণুর মাধ্যমে ডিম্বাণুর নিষিক্তকরণ দেখতে পাই, এরপর ঘটে ডিম্বাণুর বিভাজন, এবং এদের পেছনের বায়োলজিক্যাল প্রক্রিয়াগুলোর গতিপথ আমরা বিস্তারিতভাবে পরিমাপ করতে পারি। ভ্রূণের মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয় কোনো অলৌকিক সত্ত্বার হস্তক্ষেপ ছাড়াই। প্রতিটি মানসিক ঘটনার পেছনে রয়েছে মস্তিষ্কের একাধিক ভৌত কার্যাবলী, আর মস্তিষ্কের এই ভৌত প্রক্রিয়াগুলো পদার্থবিজ্ঞানের নীতি অনুসরণ করে। এগুলো হচ্ছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও পর্যবেক্ষিত ফ্যাক্ট যেগুলো বস্তুবাদী বিরোধীদের সামলাতে হবে।

বিজ্ঞানীরা বিবর্তনের সমস্ত প্যাচঁ এবং কানাগলি ব্যাখ্যা করতে না পারলেও ওপরে বর্ণিত ফ্যাক্টগুলোর কোনো পরিবর্তন হবে না। তাই, বিবর্তনের বিরুদ্ধে সন্দেহের বীজ বুনে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন কোনোভাবেই বস্তুবাদ দর্শনের মূলোৎপাটন করতে সফল হবে না।  

যদি, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন এই মৌলিক বিষয়টি করায়ত্ত করতে পারে, তবে তারা গঠনমূলক উপায়ে তাদের আন্দোলনকে পুনরায় কেন্দ্রীভূত করতে পারবে। এই অগ্রগতি হবে স্বাগত জানানো মতো, কারণ বর্তমানে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন আন্দোলন প্রচুর অর্থ ও মেধাস্বত্ব অপচয় করছে, যেগুলো বস্তুবাদীতার আসল সমস্যা পেছনে ব্যবহার করা যাবে।

লেখক:  Scott Buchanan মূল লেখা: Realistic Expectations for Transitional Fossils

পাদটীকা: স্কট বুচানান একজন Evangelist, উনি সবসময়ই চেষ্টা করেছেন বিশ্বাস এবং বিজ্ঞানের ভেতর ভারসাম্য বজায় রাখতে। ওনার এই প্রবন্ধের Varieties of Skepticism অংশের শেষ দুটি প্যারাগ্রাফ এবং Addressing the Underlying Issues অংশের প্রথম ছয়টি প্যারাগ্রাফ অনুবাদ করা হয়নি। এই প্যারাগ্রাফগুলোতে  বুচানান বাইবেলে ব্যাখ্যা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাইবেলের সাথে বিবর্তনের সমন্বয়সাধনের কিছু রূপরেখা দিয়েছেন। কোনো পাঠক চাইলেই ঐ অংশগুলো মূল ইংরেজিতে পড়তে পারেন ওপরের দেয়া লিংক থেকে।