মহাবিশ্ব কি দিয়ে তৈরি? প্রশ্নটি হাজার বছরের পুরোনো। আধুনিক মহাকাশবিদ্যার কল্যাণে আজ আমরা উত্তরটা নিশ্চিতভাবে জানি। উত্তরটা এক লাইনে দেয়া যায় এভাবে,
৫% সাধারণ-পদার্থ
২৫% ডার্ক-ম্যাটার
৭০% ডার্ক এনার্জি
ডার্ক-ম্যাটার এবং ডার্ক-এনার্জি দুটি সম্পূর্ন ভিন্ন জিনিস। এদের নামের ডার্ক বা অন্ধকার শব্দটি অত্যন্ত বিভ্রান্তমূলক। যদিও ডার্ক-ম্যাটার এবং ডার্ক-এনার্জিকে এখনো কোনো গাণিতিক মডেলের ঢোকানো সম্ভব হয়নি। তবে এরা কি হতে পারে, কিংবা কি না হতে পারে সেটা সম্পর্কে আমাদের ভালোই ধারণা আছে।
মহাকাশবিদ্যা বিজ্ঞানের হাজার বছরের পুরোনো একটা শাখা। তবে আধুনিক মহাকাশবিদ্যার জন্ম নিউটনের সর্বজনীন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র থেকে। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের মাধ্যমে সৌরজগৎ এমনকি আস্ত একটা গ্যালাক্সির ডাইনামিক্স বা গতিশীলতা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আমরা যদি নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের মাধ্যমে একটি মহাবিশ্বকে কল্পনা করি, তবে মহাবিশ্বটির কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবো, যেমন:
নিউটনের মহাবিশ্বে “স্থান” এবং “সময়”জিনিস দুটি একেবারেই ভিন্ন এবং একে অন্যের থেকে স্বাধীন। “স্থান” জিনিসটি “স্থির” বা অপরিবর্তনশীল। তাই, বিগ-ব্যাং কিংবা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীলতা কোনোটাই নিউটনের মহাবিশ্বে সম্ভব নয়। এই মহাবিশ্বে “স্থান” অসীম, প্রান্তহীন, এবং স্থানে কোনো ঘটনার বিকাশ ঘটে সময়ের সাথে সাথে।
![spactime](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spactime.png)
অন্যদিকে, নিউটনের মহাবিশ্বে “সময়” জিনিসটা পরম। অর্থাৎ, মহাবিশ্বে প্রত্যেকের সময় এক এবং সবার ঘড়ির কাঁটা একই গতিতে চলে। সময়ের এই পরমশীলতার জন্যই নিউটনের মহাবিশ্বে আলোর চেয়ে বেশি গতিতে চলন সম্ভব। যেমন: কোনো মহাকাশযাত্রী যদি দূরবর্তী কোনো গ্যালাক্সি থেকে ভ্রমণ শেষে পৃথিবীতে ফিরে আসে, তবে মহাকাশযাত্রীর সময় এবং পৃথিবীর সময় একই হতে হবে। এবং এই দুটি সময়কে এক রাখার জন্য যেকোনো গতি অনুমোদনযোগ্য। বস্তুত, নিউটনের মহাবিশ্বে মাধ্যাকর্ষণ বলের কার্যকারিতা তাৎক্ষণিক, যেমন: হটাৎ কোনো অলৌকিক কারণে যদি সূর্য হারিয়ে যায় তবে পৃথিবী সেটা টের পাবে সাথে সাথে।
![spactime-2](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spactime-2.png)
নিউটনের মহাবিশ্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এই মহাবিশ্বের “শক্তি” এবং “ভর” দুটি ভিন্ন জিনিস। মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণ “ভর”; কিন্তু শক্তির কোনো ভর নেই, তাই শক্তি কোনোভাবেই মাধ্যাকর্ষণ বল প্রয়োগ করতে পারে না। অর্থাৎ, মাধ্যাকর্ষণ বল প্রয়োগ করতে পারে শুধু সেইসব জিনিস যাদের ভর আছে। শক্তির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আমরা যে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকিরণ দেখি সেগুলো মাধ্যাকর্ষণ বল প্রয়োগ করতে না পারে না, এমনকি এরা মাধ্যাকর্ষণ বল দ্বারা প্রভাবিতও হয় না। ফলে, নিউটনের মহাবিশ্বে পরিমাপ করা যায় শুধুই “পদার্থ”; এবং “বিকিরণ” এই মহাবিশ্বের জন্য ডার্ক-ম্যাটার।
এবার তাকানো যাক আইনস্টাইনের মহাবিশ্বের দিকে। আইনস্টাইন তার বিশেষ-আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশ করেন ১৯০৫ সালে। এই বিশেষ-আপেক্ষিক তত্ত্ব নিউটনের “পরম সময়” ধারণাটিকে পাল্টে দেয়। বিশেষ-আপেক্ষিকতা অনুসারে মহাবিশ্বের একমাত্র পরম জিনিসটি হলো শূন্যস্থানে আলোরগতি। একইসাথে, আইনস্টাইন প্রস্তাব করেন “সময়” এবং “স্থানের” অভিন্নতা, তাই আইনস্টাইনের মহাবিশ্বে এদের একসাথে বলা হয় “স্থানকাল” বা “স্পেসটাইম”।
![spacetime-1](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spacetime-1.png)
আইনস্টাইনের মহাবিশ্বে “সময়” একটি স্থানীয় পরিমাপ। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি অংশে “স্থানের” মতোই “সময়ও” আলাদা। স্থানকালের এক বিন্দু থেকে অন্যবিন্দুতে যাওয়া মানে হলো “স্থান” এবং “কালের (সময়ের)” যুগপৎ ভ্রমণ। ঠিক এইজন্যই, কোনো মহাকাশযাত্রী যখন দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে পৃথিবীতে ফিরে আসবে, তখন মহাকাশযাত্রীর সময় এবং পৃথিবীর সময় হবে ভিন্ন।
![spactime-3](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spactime-3.png)
বিশেষ-আপেক্ষিকতার পরপরই আইনস্টাইন প্রস্তাব করেন e=mc^2 সমীকরণটি। যেটা শক্তি এবং ভরের সমতুল্যতা নির্দেশ করে। ফলে, আইনস্টাইনের মহাবিশ্বে বিকিরণ আর ডার্ক-ম্যাটার থাকলো না। আইনস্টাইনের মহাবিশ্বে ভরযুক্ত পদার্থ এবং ভরহীন বিকিরণের মধ্যে রূপান্তর সম্ভব এই e=mc^2 সমীকরণের মাধ্যমে।
সমস্যা হলো, বিশেষ-আপেক্ষিকতায় “ত্বরণ” এবং “মাধ্যাকর্ষণ” এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো না। ফলে, বিশেষ-আপেক্ষিকতা নিউটনের মহাবিশ্বকে পাল্টে দিতে পারেনি। প্রায় দশ বছর পর, ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন বিশেষ আপেক্ষিকতা ছুঁড়ে ফেলে সাধারণ-আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। সাধারণ-আপেক্ষিক তত্ত্বে আইনস্টাইন মাধ্যাকর্ষণকে টেনে আনেন। আইনস্টাইন প্রস্তাব করেন “সমতুল্যতার-নীতি”, যাতে বলা হয় “ত্বরণ” এবং “মাধ্যাকর্ষণ” দুটোই বাস্তবে একই জিনিস। এই সাধারণ-আপেক্ষিকতাই হলো আইনস্টাইনের সত্যিকার মহাবিশ্ব, আমরা আজ যে মহাবিশ্বের কথা বলি সেটা আইনস্টাইনের মহাবিশ্ব।
আইনস্টাইনের মহাবিশ্বে “ভর” কিংবা “শক্তি” স্থানকালকে বাঁকিয়ে ফেলে, আর বাঁকানো স্থানকালে ভ্রমণরত কোনো বস্তু যে “ত্বরণ” অনুভব করে সেই ত্বরণই হলো মাধ্যাকর্ষণ। অর্থাৎ, স্থানকালের বক্রতাজনিত ত্বরণই হলো মাধ্যাকর্ষণ। স্থানকালকে যদি বাঁকানো না হয় তবে মাধ্যাকর্ষণও অনুভূত হবে না। এথেকে বোঝাই যাচ্ছে যে, আইনস্টাইনের “স্থান” নিউটনের মতো স্থির বা অপরিবর্তনশীল নয়। তাই সাধারণ-আপেক্ষিকতার সাথে সাথে নিউটনের “স্থির স্থান” ধারণাটিরও বিদায় ঘটে।
মজার ব্যাপার হলো, সাধারণ-আপেক্ষিক তত্ত্ব মাত্র এক লাইনের একটি সমীকরণ, যার মাত্র তিনটি অংশ আছে। নিচে সমীকরণটি দেয়া হলো। সবচেয়ে বাঁয়ে অংশটি হলো একটি 4×4 ম্যাট্রিক্স, যেটা স্থানকাল কি পরিমাণ বাঁকানো সেটা নির্দেশ করে। স্থানকাল যদি বাঁকানো না হয় তবে ম্যাট্রিক্সটির প্রতিটি উপাদান হবে শূন্য। সবচেয়ে ডানের অংশটি হলো “ভর” এবং “শক্তির” সমষ্টি যেটা স্থানকালকে বাঁকিয়ে ফেলার জন্য দায়ী। আর মাঝের অংশটি একটি ধ্রুবক।
![soacetime-4](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/soacetime-4.png)
আগেই বলা হয়েছিলো যে, আইনস্টাইনের মহাবিশ্বে স্থানকালকে বাঁকিয়ে ফেলা সম্ভব। আর এই বক্রতা হতে পারে তিন ধরণের।
ধনাত্মক-বক্রতা: যেকোনো গোলাকার পৃষ্টের বক্রতা হলো এই ধরণের। ধনাত্মক-বক্রতাযুক্ত পৃষ্টে যেকোনো ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি হবে ১৮০°য়ের বেশি। ত্রিভুজ যত বড় হবে তিন কোণের সমষ্টিও ১৮০°য়ের চেয়ে ততো বেশি হবে। যে মহাবিশ্বের স্থানকাল ধনাত্মক-বক্রতারযুক্ত তাকে বলে বদ্ধ-মহাবিশ্ব (Closed universe)।
ঋণাত্মক-বক্রতা: এই ধরণের বক্রতার ভালো উদাহরণ হলো: ঘোড়ার চড়ার স্যাডেল। ঋণাত্মক-বক্রতাযুক্ত পৃষ্টে যেকোনো ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি হবে ১৮০°য়ের কম। ত্রিভুজ যত বড় হবে তিন কোণের সমষ্টিও ১৮০°য়ের চেয়ে ততো কম হবে। যে মহাবিশ্বের স্থানকাল ঋণাত্মক-বক্রতাযুক্ত তাকে বলে খোলা-মহাবিশ্ব (Open universe)।
সমতল: এই ধরণের পৃষ্টের বক্রতা শূন্য। যেকোনো সমতলে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি হবে ১৮০°।
![spacetime-2](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spacetime-2.png)
যদি স্থানকালের বক্রতা নির্ণয় করা যায়, তবে সাধারণ-আপেক্ষিকতার সমীকরণ থেকে নিশ্চিতভাবে মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থ এবং শক্তির পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব। কিংবা উল্টোটি; অর্থাৎ যদি মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থ এবং শক্তির পরিমাণ নির্ণয় করা যায়, তবে স্থানকালের বক্রতা সাধারণ-আপেক্ষিকতা থেকে নির্ণয় করা সম্ভব। এই উপলব্ধি থেকেই ১৯২২ সালে রুশ পদার্থবিদ আলেক্সজেন্ডার ফ্রীডম্যান আইনস্টাইনের সমীকরণটিকে একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন। ফ্রীডম্যান প্রস্তাব করেন যে, স্থানকালের বক্রতা দুইভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে:
জ্যামিতিক: স্থানকালের বক্রতা হতে পারে জ্যামিতিক, যেটা আমরা আগেই আলোচনা করেছি।
সম্প্রসারণশীল বা সংকোচনশীল: আমরা জানি আইনস্টাইনের মহাবিশ্ব সসীম। তাই স্থানকালের বক্রতা প্রকাশ করা যেতে পারে স্থানকালের সংকোচন বা প্রসারণের মাধ্যমে। অর্থাৎ, আইনস্টাইনের মহাবিশ্বে স্থানকাল হতে পারে সংকোচনশীল, বা সম্প্রসারণশীল, কিংবা স্থির আয়তনের।
বিশের দশকের প্রথম দিকে কেউই জানতো এই দুটি ধরণের বক্রতার পরিমাপ কি হতে পারে। ফ্রীডম্যানের সমীকরণটি ছিলো এরকম;
![spacetime-4](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spacetime-4.png)
ফ্রীডম্যানের সমীকরণের বাঁয়ে ρ (গ্রিক অক্ষর “রো”) নির্দেশ করে মহাবিশ্বের শক্তি ঘনত্ব, আমরা জানি “শক্তি” এবং “ভর” একই জিনিস, তাই ρ সমস্ত পদার্থ এবং শক্তির পরিমাণ নির্দেশ করে। অন্যদিকে, H হলো স্থানকালের সম্প্রসারণশীলতার পরিমাপ, যাকে বলা হয় হ্যাবল-ধ্রুবক। এবং K হলো স্থানকালের বক্রতার জ্যামিতিক পরিমাপ।
ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, স্থানকাল যে সংকোচনশীল বা সম্প্রসারণশীল হতে পারে সেটা আইনস্টাইন বিশ্বাস করতে পারেননি। তাই আইনস্টাইন পরবর্তীতে সাধারণ-আপেক্ষিক সমীকরণে যুক্ত করেন Λ (ল্যামডা), এতে স্থানকাল হয়ে পরে স্থির আয়তনের। Λ-কে বলা হয় মহাজাগতিক-ধ্রুবক। ১৯২৫ সালে মার্কিন-ইতালীয় মহাকাশবিদ এডউইন-হ্যাবল মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীলতা প্রমাণ করেন, ফলে ফ্রীডম্যানের সমীকরণে হ্যাবল-ধ্রুবক রয়ে যায় অক্ষত।
![efe2](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/efe2.jpg)
নিচে এডউইন হ্যাবলের সমীকরণ দেয়া হলো। আমাদের মহাবিশ্বে Hয়ের বর্তমান মান ৭২কিলোমিটার/সেকেন্ড/মেগাপ্যারাসেক, এবং এই মান নির্ণয় করেন মার্কিন-কানাডীয় মহাকাশবিদ উইন্ডি-ফ্রীডম্যান (Wendy Freedman)।
![spacetime-5](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spacetime-5.png)
প্যারাসেক হলো দূরত্বের একক। ১প্যারাসেক = তিন আলোকবর্ষ (প্রায়), সুতরাং ১মেগাপ্যারাসেক = তিরিশ লক্ষ আলোকবর্ষ। H = ৭২কিলোমিটার/সেকেন্ড/মেগাপ্যারাসেক, কথাটার মানে হলো: ১মেগাপ্যারাসেক দূরের গ্যালাক্সিগুলো ৭২কিলোমিটার/সেকেন্ড গতিতে আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে; একইভাবে ২মেগাপ্যারাসেক দূরের গ্যালাক্সিগুলোর ১৪৪কিলোমিটার/সেকেন্ড গতিতে, ইত্যাদি। আর এই গতির কারণ হলো স্থানকালের সম্প্রসারণশীলতা।
অন্যদিকে, স্থানকালের জ্যামিতিক বক্রতা নির্ণয়ে ব্যবহার করা হয় CMB (Cosmic Microwave Background)। CMB হলো বিগ-ব্যাংয়ের ফসিল বিকিরণ। বিগ-ব্যাংয়ের প্রায় ৪লক্ষ বছর পর্যন্ত মহাবিশ্ব ছিলো আলোর জন্য অভেদ্য। এই ৪লক্ষ বছর পর বিভিন্ন চার্জযুক্ত কণাগুলো পরমাণু গঠন করতে শুরু করে, সাথে সাথে মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হতে শুরু করে, এবং বিগ-ব্যাংয়ের বিকিরণ সমানভাবে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে যেতে শুরু করে। এই বিকিরণ যখন কোনো পদার্থের ওপর আপতিত হয়, তখন পদার্থের ইলেক্ট্রন বিকিরণের ফোটনকে বিক্ষিপ্ত করে, ফলে বিকিরণ কিছু শক্তি হারায়, CMBতে এই বিকিরণ দেখায় লাল। তাই CMBয়ের লাল দাগগুলো মহাবিশ্বে পদার্থের উপস্থিতি এবং নীল দাগগুলো মহাবিশ্বের পদার্থশূন্য অঞ্চল নির্দেশ করে।
![ilc-5yr-hh-125](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/ilc-5yr-hh-125.jpg?w=680)
CMBয়ের উজ্জ্বলতম লাল দাগগুলো যদি আড়াআড়াভাবে ১°য়ের বেশি হয় তবে স্থানকাল হবে ধনাত্মক-বক্রতাযুক্ত এবং মহাবিশ্ব হবে বদ্ধ। ১°য়ের চেয়ে কম হলে স্থানকাল হবে ঋণাত্মক-বক্রতাযুক্ত এবং মহাবিশ্ব হবে খোলা। আর, ১°য়ের সমান হলে স্থানকাল হবে সমতল। ২০১৩ সালে WMAP স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত CMB তথ্য বিশ্লেষণে করে মাত্র ০.৪% প্রান্তিক-ত্রুটিযুক্ত ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এই ফলাফল অনুসারে আমাদের মহাবিশ্ব সমতল।
এবার, উইন্ডি-ফ্রীডম্যানের “H” এবং WMAP থেকে “K” যদি ফ্রীডম্যানের সমীকরণে বসানো হয় তবে আমরা মহাবিশ্বের সমস্ত জিনিসের পরিমাণ নির্ণয় করতে পারবো। সমস্যা হলো, বাস্তব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্বের সমস্ত জিনিসের যে পরিমাণ পাই সেটা ফ্রীডম্যানের চেয়ে ৭০% কম! আগেই বলা হয়েছিলো, বিকিরণ বা পদার্থ কোনোটাই আইনস্টাইনের মাধ্যাকর্ষণকে ফাঁকি দিতে পারে না। তাই, ধারণা করা হয় এই ৭০% লুকোনো জিনিস বিশেষ ধরণের শক্তি যেটা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড-মডেলের মধ্যে পড়ে না। মহাবিশ্বের এই লুকোনো শক্তিকে আমরা বলি ডার্ক-এনার্জি।
অন্যদিকে, হিসাব মেলানো ৩০% জিনিসগুলোর মধ্যেও রয়েছে বিশাল ঘাপলা। ঘাপলাটা শুরু ১৯৩০ সালে, তবে আমরা শুরু করবো সত্তরের দশক থেকে। আমরা জানি, সৌরজগতে সূর্যকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে দ্রুত আবর্তিত হয় বুধগ্রহ এবং সবচেয়ে ধীরে প্লুটো। কারণটা হলো, সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ বল; প্লুটোর ওপর সূর্যের প্রযুক্ত মাধ্যাকর্ষণ বল বুধের চেয়ে অনেক কম তাই প্লুটোর আবর্তন গতিও বুধের চেয়ে কম। মাধ্যাকর্ষণের সাথে আবর্তনের এই সম্পর্ককে একটা রেখাচিত্রের মাধ্যমে দেখানো যায়, যাকে বলে রোটেশনাল-কার্ভ (Rotational curve)। সৌরজগতে রোটেশনাল-কার্ভ নিখুঁতভাবে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ এবং বিভিন্ন গ্রহদের আবর্তন গতি ব্যাখ্যা করে।
সত্তরের দশকে মার্কিন মহাকাশবিদ ভেরা রুবিন (Vera Rubin) অনেকগুলো গ্যালাক্সির রোটেশনাল-কার্ভ বিশ্লেষণ করেন। তিনি তার বিশ্লেষণে বেছে নেন গালাক্সিগুলোর একেবারে শেষে প্রান্তের নক্ষত্রদের। আমাদের উপস্থিত জ্ঞান বলে যে, গ্যালাক্সির শেষ প্রান্তে মাধ্যাকর্ষণ বল স্বল্প তাই এই প্রান্তীয় নক্ষত্রদের আবর্তন গতি হবে অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু, রুবিনের রোটেশনাল-কার্ভ বলে অন্য কথা। রুবিনের বিশ্লেষণ অনুসারে গ্যালাক্সির প্রান্তীয় নক্ষত্রগুলোর আবর্তন গতি গ্যালাক্সির অভ্যন্তরীণ নক্ষত্রগুলোর সমান। হিসেব করে দেখা গেছে, নক্ষত্রগুলোর এই আবর্তন গতি জন্য প্রয়োজনীয় মাধ্যাকর্ষণ বল তৈরিতে যে পরিমাণের পদার্থ দরকার, গ্যালাক্সিদের সাধারণ পদার্থ তারচেয়ে পাঁচগুণ কম। এখানে সাধারণ পদার্থ বলতে: গ্যাস, নক্ষত্র, ব্ল্যাকহোলসহ সেই সমস্ত বস্তু বোঝানো হয়েছে যাদের অস্তিত্ব বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়। অর্থাৎ, ফ্রীডম্যানের সমীকরণে যেই ৩০% হিসাব আমরা মেলাতে পেরেছি তার ২৫%য়েরই কোনো হদিস আমরা জানি না। এই ২৫%কে আমরা বলি ডার্ক-ম্যাটার। ডার্ক-ম্যাটার মাধ্যাকর্ষণ থেকে লুকোতে পারে না, কিন্তু যেকোন বিদ্যুৎচুম্বকীয় বর্ণালীতে এরা অদৃশ্য।
গ্যালাক্সিদের বৈচিত্রতা অনেক। কিছু গ্যালাক্সি স্প্যাইরাল ধরণের, কিছু এলিপ্টিক্যাল। কিছু গ্যালাক্সি বিশাল, কিছু বামন প্রকৃতির। এই ভিন্নতার কারণে গ্যালাক্সিরা মহাবিশ্বের আদর্শ নমুনা হতে পারে না। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ডার্ক-ম্যাটার বলতে আসলে কিচ্ছু নেই, রুবিনের রোটেশনাল-কার্ভ হয়তো গালাক্সিদের এমন কোনো বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে যেটা আমরা এখনো ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারিনি। তাই আমাদের উচিত এমন একটা কাঠামো পর্যবেক্ষণ করা যেটা সঠিকভাবে মহাবিশ্বকে প্রতিনিধিত্ব করে। এরকম একটি কাঠোমো হলো গ্যালাক্সি-ক্লাস্টার।
![spacetime-6](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spacetime-6.jpg)
একটা গ্যালাক্সির আকৃতি অনেকটা থালার মতো, তাই এর রোটেশনাল-কার্ভ নির্ণয় করা সহজ। কিন্তু, গ্যালাক্সি-ক্লাস্টারের আকার ঘনকের মতো। তাই গ্যালাক্সি-ক্লাস্টারের রোটেশনাল-কার্ভ নির্ণয়ের জন্য নিউটোনিয়ান পদ্ধতিতে ক্লাস্টারের বিভিন্ন গ্যালাক্সির আবর্তন গতি নির্ণয় করা হয়। ১৯৩০ সালের দিকে মার্কিন পদার্থবিদ ফ্রিৎজ জুইকি (Fritz Zwicky) কোমা-ক্লাস্টারের রোটেশনাল-কার্ভ বিশ্লেষণে দেখেন যে, ক্লাস্টারের প্রান্তীয় গ্যালাক্সিগুলোর আবর্তন গতি ক্লাস্টারের অভ্যন্তরীণ গ্যালাক্সিগুলোর সমান। অর্থাৎ, রুবিন এবং জুইকির ফলাফল হুবুহু এক।
একটা গ্যালাক্সির সাধারণ পদার্থের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই হলো মুক্ত হাইড্রোজেন গ্যাস। একাধিক গ্যালাক্সি যখন একটি ক্লাস্টার তৈরি করে তখন এই গ্যাসগুলো তীব্র মাধ্যাকর্ষণজনিত চাপে উত্তপ্ত হয় এবং এক্স-রে বিকিরণ করতে থাকে। ব্যাপারটা বুলেট-ক্লাস্টারের মাধ্যমে দেখানো যাক:
![spactime-7](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spactime-7.jpg?w=680)
ওপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বুলেট-ক্লাস্টারের দুটি গোলাকার কাঠামো আছে, যেগুলো প্রধানত গ্যালাক্সি দিয়ে গঠিত। কিন্তু, এক্স-রে তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ক্লাস্টারের সমস্ত হাইড্রোজেন গ্যাস পাওয়া যাবে গোলক দুটির বাহিরে, ক্লাস্টারের কেন্দ্রে। এই হাইড্রোজেন গ্যাস পুরো ক্লাস্টারের সাধারণ পদার্থের মোট ভরের দুই তৃতীয়াংশ।
![spacetime-8](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spacetime-8.jpg?w=680)
ওপরের ছবিটার একটাই ব্যাখ্যা, ক্লাস্টার তৈরির সময় গ্যালাক্সিগুলো অতীতে একে অন্যদের ভেদ করে চলে যায়। যেহেতু, গ্যালাক্সিগুলো মাঝে প্রচুর ফাঁকা জায়গা থাকে, তাই গ্যালাক্সিগুলো বাধাহীনভাবে একে অন্যদের অতিক্রম করে এবং গোলাকার কাঠামো দুটি তৈরি করে। কিন্তু, একই সময় গ্যালাক্সিদের গ্যাসীয় অংশগুলো একে অন্যের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, এবং গতি হারিয়ে ক্লাস্টারে কেন্দ্রে জমা হতে থাকে।
![spacetime-9](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spacetime-9.jpg?w=680)
ডার্ক-ম্যাটারের হিসাবে আনলে আমরা ওপরের ছবি পাবো। ছবি থেকে বোঝাই যাচ্ছে, বুলেট-ক্লাস্টারে কেন্দ্র গ্যাস, মধ্যবর্তী কাঠামো গ্যালাক্সি, এবং বাহিরের ফাঁপা কাঠামো ডার্ক-ম্যাটার দিয়ে তৈরি। একক গ্যালাক্সির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সত্যি। যদিও একটি গ্যালাক্সি দেখতে থালার মতো, ডার্ক-ম্যাটারকে হিসাবে আনলে গ্যালাক্সির আকার হবে বিশাল একটা ফাঁপা গোলকের মতো।
মহাবিশ্বের সাধারণ পদার্থ নির্ণয়ে ব্যবহার করা হয়: অপ্টিক্যাল, এক্স-রে, ইনফ্রারেড, কিংবা গামা টেলিস্কোপ। অন্যদিকে, ডার্ক-ম্যাটার বৈদ্যুৎচুম্বকীয় বলে সাড়া দেয় না। কিন্তু, সাধারণ পদার্থের মতোই ডার্ক-ম্যাটার মাধ্যাকর্ষণে সাড়া দেয়। তাই ডার্ক-ম্যাটারের অস্তিত্ব নির্ণয়ে ব্যবহার করা হয় গ্র্যাভিটেশনাল-লেন্সিং। যে বিশেষ গ্র্যাভিটেশনাল-লেন্সিং পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয় তার নাম মাইক্রোলেন্সিং। যখন কোনো গ্যালাক্সি-ক্লাস্টারকে পর্যবেক্ষণ করা হয় তখন ক্লাস্টারের পেছনে থাকা অন্যান্য দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো থেকে আসা আলোকরশ্মি ক্লাস্টারের মাধ্যাকর্ষণের কারণে বেঁকে যায় (নিচের ছবির মতো)।
![spacetime-11](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spacetime-11.jpg)
দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোকরশ্মি ক্লাস্টারের মাধ্যাকর্ষণের কারণে বেঁকে যাওয়া ব্যাপারটা নিচে ব্যাখ্যা করা হলো।
![spacetime-10](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spacetime-10.jpg?w=680)
![spacetime-1](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spacetime-1.jpg?w=680)
মাইক্রোলেন্সিং পদ্ধতিতে এরকম অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লেন্সিং প্রভাব হিসেবে করে একটি ক্লাস্টারে মাধ্যাকর্ষণ বল পরিমাপ করা হয়। এরপর এই মাধ্যাকর্ষণের জন্য দায়ী সমস্ত সাধারণ-পদার্থ এবং ডার্ক-ম্যাটারের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। এই পরিমাণ থেকে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বর্ণালী থেকে পাওয়া সাধারণ পদার্থ বাদ দিলেই পাওয়া যায় ডার্ক-ম্যাটারের পরিমাণ। সম্প্রতি নাসা তাদের COSMOS বা Cosmic Evolution Surveyতে তাদের সমস্ত অপ্টিক্যাল, এক্স-রে, ইনফ্রারেড, এবং গামা টেলিস্কোপগুলো দিয়ে মহাকাশের একটি ক্ষুদ্র অংশকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ডার্ক-ম্যাটারের ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করে। মহাকাশের ঐ অংশটি ছিলো চাঁদের চেয়ে মাত্র আটগুণ বড়। নিচে নাসা’র প্রকাশিত ছবিগুলো দেয়া হলো।
![spactime-12](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spactime-12.jpg?w=680)
![spacetime-13](https://abuhayat.files.wordpress.com/2016/08/spacetime-13.jpg?w=680)
যে ডার্ক-ম্যাটার এবং ডার্ক-এনার্জির কথা এতোক্ষণ বলা হলো তার উৎপত্তি আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা থেকে। সুতরাং, এগুলো আমাদের অজ্ঞানতার ফসল নয়। এবং এই পর্যায়ে নিশ্চিত যে, ডার্ক-ম্যাটার এবং ডার্ক-এনার্জির কোনোটাই পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে সফলতম শাখা স্ট্যান্ডার্ড-মডেলের মধ্যে পড়ে না।
অবলম্বনে: “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “Dark Matter, Dark Energy: The Dark Side of the Universe” by “Sean Carroll”