ডার্ক-ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি: স্ট্যান্ডার্ড-মডেল

স্ট্যান্ডার্ড-মডেল হলো পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা যেখানে মৌলিক কণা এবং তাদের মধ্যকার বিভিন্ন কার্যপ্রণালীর গাণিতিক ব্যাখ্যা করা হয়। স্ট্যান্ডার্ড-মডেলের প্রায় প্রতিটি ভবিষ্যদ্বাণী এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে, আর তাই একে পদার্থবিজ্ঞানের সফলতম শাখা হিসাবের গণ্য করা হয়। দেখা যাক এই স্ট্যান্ডার্ড-মডেল ডার্ক-ম্যাটার সম্পর্কে কি বলে।

মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু পরমাণু দিয়ে তৈরি। যেকোনো পরমাণু একটি নিউক্লিয়াস এবং এক বা একাধিক ইলেক্ট্রন দিয়ে গঠিত। পরমাণুর ভর নির্ভর করে নিউক্লিয়াসের ওপর এবং আকার নির্ভর করে ইলেক্ট্রনের ওপর। নিউক্লিয়াসের উপাদান হলো প্রোটন এবং নিউট্রন। প্রোটন একক ধনাত্মক চার্জযুক্ত, নিউট্রন চার্জ নিরপেক্ষ, এবং ইলেক্ট্রন একক ঋণাত্মক চার্জযুক্ত। একটি পরমাণুর প্রোটন এবং ইলেক্ট্রন সংখ্যা সমান, তাই স্বাভাবিক অবস্থায় একটি পরমাণু চার্জ নিরপেক্ষ। প্রোটিন এবং ইলেক্ট্রন তাদের চার্জ সম্পর্কিত তথ্যের আদান-প্রাদান করে ফোটনের মাধ্যমে। ফোটনের কাজ হলো চার্জ বহন করা, যদিও ফোটন নিজেই চার্জহীন। এবং একটা ফোটন কখনো অন্য ফোটনের সাথে কোনো ধরণের কার্যকলাপে জড়ায় না। এই ফোটনদের আমরা প্রকৃতিতে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল রূপে দেখি। পারমাণবিক কাঠামোতে ইলেক্ট্রন এবং প্রোটন আটকে থাকার কারণ এই বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল।

আমাদের জানা মতে, ইলেক্ট্রন একটি মৌলিক কণা, অর্থাৎ ইলেক্ট্রনকে ভেঙ্গে ক্ষুদ্রতর কণা পাওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে, প্রোটন এবং নিউট্রন মৌলিক কণা নয়। এদের ভেঙ্গে ক্ষুদ্রতর পাওয়া যায়, এই কণাদের বলে কোয়ার্ক। কোয়ার্ক মৌলিক কণা। প্রোটন এবং নিউট্রন দুই ধরণের কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত, আপ-কোয়ার্ক এবং ডাউন-কোয়ার্ক। আপ-কোয়ার্কের চার্জ +২/৩ এবং ডাউন-কোয়ার্কের -১/৩। প্রোটনে রয়েছে দুটি আপ-কোয়ার্ক এবং একটি আপ-কোয়ার্ক, তাই প্রোটনের মোট চার্জ +১। অন্যদিকে, নিউট্রনে রয়েছে একটি আপ-কোয়ার্ক এবং দুটি ডাউন-কোয়ার্ক, ফলে নিউট্রনের মোট চার্জ শূন্য।

quarks
হ্যাড্রন পরিবার: ব্যারিয়ন এবং পাইয়ন।

প্রোটন এবং নিউট্রন হলো কোয়ার্কদের আবদ্ধ কাঠামো। কোয়ার্কদের এই আবদ্ধ কাঠামোর কারণ হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বল, নাম প্রবল-নিউক্লিয়ার বল (Strong nuclear force)। এই প্রবল-নিউক্লিয়ার বলের প্রকাশ ঘটে গ্লুয়ন কণার মাধ্যমে। গ্লুয়ন ফোটনের মতোই মৌলিক কণা। তিনটি কোয়ার্ক অনবরত গ্লুয়ন আদান-প্রদানের মাধ্যমে প্রোটন এবং নিউট্রন মতো কাঠামো ধরে রাখে। এই কাঠামোদের আবদ্ধ বলার কারণ হলো, কোয়ার্কদের কোনোভাবেই এই কাঠামো থেকে আলাদা করা যায় না। আমরা জানি, বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল বিপরীত-বর্গের নীতি বা 1/r^2 অনুসরণ করে, তাই ফোটনেরা দূরত্বের সাথে সাথে শক্তি হারাতে থাকে। অন্যদিকে, প্রবল-নিউক্লিয়ার বল r^2 নীতি অনুসরণ করে, এর মানে হলো, দূরত্বের সাথে সাথে গ্লুয়নদের শক্তি বাড়তে থাকে। গ্লুয়নদের ব্যাপারটা অনেকটা রাবারের ফিতার মতো, রাবারের ফিতাকে  টেনে লম্বা করার সাথে সাথে রাবারের প্রতিরোধ বাড়তে থাকে। বেশি শক্তি প্রয়োগ করা হলে একসময় ফিতা ছিঁড়ে যাবে এবং আমরা পাবো দুটি রাবারের ফিতা। একইভাবে যদি প্রোটন বা নিউট্রনের কোয়ার্কদের ধরে রবারের ফিতার মতো বিপরীত দিকে টানা হয় তবে, কোয়ার্কদের মধ্যকার গ্লুয়নদের শক্তি বাড়তে থাকবে। গ্লুয়নের শক্তি একটি নির্দিষ্ট মানে পৌঁছালে এই শক্তির কিছু অংশ নতুন কোয়ার্কে পরিণত হবে। এর ফলাফল হলো, কোয়ার্কদের মধ্যকার প্রবল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র ছিঁড়ে যাবে এবং ছিঁড়ে যাওয়া অংশে পাওয়া যাবে নতুন কোয়ার্ক। অর্থাৎ, প্রোটন কিংবা নিউট্রনের কোয়ার্কদের ধরে বেশি টানাটানি করলে আলাদা আলাদা কোয়ার্কের পরিবর্তে পাওয়া যাবে সম্পূর্ণ নতুন প্রোটন বা নিউট্রন।

main-qimg-09dcb63f7b324ffc476bfd112a25a131
হ্যাড্রন কাঠামোতে গ্লুয়নের মাধ্যমে কোয়ার্কগুলো লেগে থাকে রবারের মতো। আলাদা করার চেষ্টা করলে আলাদা আলাদা কোয়ার্কের পরিবর্তে পাওয়া যাবে দুটি হ্যাড্রন, অনেকটা ছিঁড়ে যাওয়া রবারের মতোই।

অন্যদিকে, পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন এবং নিউট্রনদের একসাথে থাকার কারণ হলো ঐ প্রবল-নিউক্লিয়ার বল, তবে একটু ভিন্ন প্রকৃতির। এই ভিন্ন প্রকৃতির প্রবল-নিউক্লিয়ার বলের প্রকাশ ঘটে পাইয়ন (Poin বা 丌) কণার মাধ্যমে। প্রোটন এবং নিউট্রন নিজেদের মধ্যে পাইয়ন কণা আদান প্রদানের মাধ্যমে নিউক্লিয়াস গঠন করে। মনে রাখা দরকার, পাইয়ন বিনিময় ঘটে প্রোটিন এবং নিউট্রনের মাঝে। প্রোটন-প্রোটনের সাথে, কিংবা নিউট্রন নিউট্রনের সাথে কখনো পাইয়ন বিনিময় করে না। তাই একাধিক প্রোটনযুক্ত নিউক্লিয়াস গঠনে নিউট্রনের প্রয়োজন। এই পাইয়ন কোনো মৌলিক কণা নয়, পাইয়ন একটি কোয়ার্ক এবং একটি এন্টি-কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত। পাইয়নের মাধ্যমে প্রকাশিত এই ভিন্ন প্রকৃতির প্রবল-নিউক্লিয়ার বলকে বলে অবশিষ্ট-প্রবল-নিউক্লিয়ার বল (Residual strong force), এবং এই বলক্ষেত্র r^2 নীতি অনুসরণ করে না। এই বলক্ষেত্র বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলক্ষেত্রে চেয়ে প্রায় ১৩৭গুণ বেশি শক্তিশালী, কিন্তু দূরত্বের সাথে সাথে এই বলক্ষেত্রের শক্তি নাটকীয়ভাবে কমতে থাকে। ইউরেনিয়ামের মতো অনেকগুলো প্রোটন এবং নিউট্রন নিয়ে গঠিত বিশাল নিউক্লিয়াসগুলো অস্থিতিশীল হওয়ার এটা একটা কারণ।

nuclear_force
অবশিষ্ট-প্রবল-নিউক্লিয়ার বল কাজ করে প্রোটন এবং নিউট্রনের মাঝে, ফলে একাধিক প্রোটনযুক্ত নিউক্লিয়াস গঠন করা সম্ভব হয়।

কোয়ার্কদের আবদ্ধ কাঠামোকে বলে হ্যাড্রন (Hadron)।  প্রকৃতিতে দুই ধরণের হ্যাড্রন পাওয়া যায়: তিনটি কোয়ার্কযুক্ত (অথবা তিনটি এন্টি-কোয়ার্কযুক্ত কাঠামো) ব্যারিয়ন (Baryon), যেমন: প্রোটন, নিউট্রন। অন্যটি একটি কোয়ার্ক এবং একটি এন্টি-কোয়ার্কযুক্ত কাঠামো, এদের বলে মেসন (Meson), যেমন: পাইয়ন। আমরা যে ৫% সাধারণ পদার্থের কথা বলছিলাম সেগুলো হলো প্রোটন এবং নিউট্রনযুক্ত ব্যারিয়নিক পদার্থ।

54640
প্রোটন এবং নিউট্রনের মাঝে অবশিষ্ট-প্রবল-নিউক্লিয়ার বল প্রকাশ পায় পাইয়নের মাধ্যমে। এই ছবিটা একটু জটিল, রেফারেন্স হিসেবে দেয়া হলো।
Nuclear_Force_anim
প্রোটন এবং নিউট্রনের ভেতর পাইয়ন আদান-প্রদান।

প্রশ্ন হতে পারে, প্রকৃতিতে চার বা চারের অধিক কোয়ার্কযুক্ত হ্যাড্রন পাওয়া যায় না কেনো? এর কারণটা হলো কোয়ার্কদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, এই বৈশিষ্ট্যকে রূপক অর্থে “রং” বলা হয়। কোয়ার্ক হতে পারে লাল, নীল, বা সবুজ রঙের। স্বরণ রাখা উচিত যে, এই “রং” একটি রূপক ধারণা মাত্র। প্রকৃতিতে হ্যাড্রনেরা বর্ণহীন। অর্থাৎ, হ্যাড্রন তৈরি করার নিয়ম হলো, যতগুলো কোয়ার্কই ব্যবহার করা হোক না কেনো কোয়ার্কদের সম্মিলিত রং হতে হবে বর্ণহীন। ব্যারিয়ান বা মেসন কাঠামোর ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বর্ণহীন হ্যাড্রন তৈরি করা সম্ভব নয়।

QCD-colour-field
প্রকৃতিতে হ্যাড্রন বর্ণহীন। এই বর্ণহীন হ্যাড্রন গঠন করা সম্ভব ব্যারিয়নের মাধ্যমে (ওপরে দুটি), কিংবা মেসনের মাধ্যমে (নিচের তিনটি)।

কোয়ার্কদের এই রঙের কারণে গ্লুয়নদেরও রং আছে। প্রকৃতিতে গ্লুয়ন পাওয়া যায় মোট আটটি সেটে (Set), প্রতিটি সেটে রয়েছে একটি গ্লুয়ন এবং একটি এন্টি-গ্লুয়ন। মজার ব্যাপার হলো, একটি গ্লুয়নের একইসাথে একাধিক রং থাকে। যেমন: একটি গ্লুয়ন হতে পারে লাল এবং প্রতি-লাল (Anti Red)), বা নীল এবং সবুজ, ইত্যাদি ইত্যাদি। আগেই বলা হয়েছে যে, কোয়ার্কদের রং তিনটি। সুতরাং, তত্ত্বগতভাবে গ্লুয়নদের নয়টি সেট থাকা উচিত, কিন্তু গাণিতিক এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পাওয়া যায় আটটি।

004
প্রোটনের স্পিন নির্ভর করে কোয়ার্কের ওপর। আর, নিউক্লিয়াসের স্পিন নির্ভর করে প্রোটন এবং নিউট্রনের ওপর।

ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, ফোটন, গ্লুয়ন ইত্যাদি কণাগুলোর মাঝে একটি সম্পর্ক আছে, যেটাকে বলা হয় স্পিন-স্ট্যাটিসটিক্স-কানেকশন। প্রতিটি কণাদের একটি নির্দিষ্ট ঘূর্ণনগতি আছে, একে বলে স্পিন। চার্জ এবং ভরের মতোই স্পিন কণাদের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। পরিমাপ করা হলে স্পিনের মান কোয়ান্টা আকারে পাওয়া যায়, যেমন: ০, ১/২, ১, ৩/২, ২ ইত্যাদি। স্পিন-স্ট্যাটিসটিক্স-কানেকশন অনুসারে “x/২-স্পিনযুক্ত” কণাদের বলে ফার্মিয়ন, এবং “পূর্ণ-স্পিনযুক্ত” কণাদের বলে বোসন। ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউট্রন হলো ১/২-স্পিন কণা বা ফার্মিয়ন। অন্যদিকে, ফোটন, গ্লুয়ন এরা ১-স্পিন কণা বা বোসন। আমরা দেখেছিলাম পাইয়ন একটি কোয়ার্ক এবং এন্টি-কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি, ফলে কোয়ার্ক দুটি একে অন্যের স্পিন বাতিল করে দেয়, তাই পাইয়নের একটি শূন্য-স্পিনযুক্ত কণা বা বোসন।

আমরা এন্টি-কোয়ার্ক এবং এন্টি-গ্লুয়নের কথা বলছিলাম। এরা হলো প্রতিকণা (Antimatter)। ফার্মিয়নদের আলাদা প্রতিকণা থাকে, যেমন ইলেক্ট্রনের আছে পজিট্রন। পজিট্রন হুবুহু ইলেক্ট্রনের মতো, পার্থক্য শুধুই চার্জে, পজিট্রনের চার্জ +১ এবং ইলেক্ট্রনের -১। অন্যদিকে, কিছু বোসন নিজেই নিজের প্রতিকণা। যেমন: ফোটন, ফোটনের প্রতিকণা ফোটন নিজেই। কিছু বোসনের প্রতিকণা ফার্মিয়নদের মতোই আলাদা, যেমন: গ্লুয়ন, গ্লুয়নদের প্রতিকণা হলো এন্টি-গ্লুয়ন। কণা এবং প্রতিকণারা যখন মিলিত হয় তখন তারা একে অপরকে বিনাশ করে এবং এই বিনাশে গামা-রশ্মি নিঃসরিত হয়, গামা হলো উচ্চ শক্তিযুক্ত ফোটন। আগে বলা হয়েছিলো যে, পাইয়নেরা কোয়ার্ক এবং এন্টি-কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। তবে এদের রং ভিন্ন, যেমন: কোয়ার্ক যদি লাল হয় তবে, এন্টি-কোয়ার্ক হবে প্রতি-সবুজ (Anti green) ইত্যাদি, এইজন্যই পাইয়নদের বিনাশ ঘটে না।

স্ট্যান্ডার্ড-মডেলে মোট বারোটি ফার্মিয়ন এবং পাঁচটি বোসন আছে।

spacetime-1
স্ট্যান্ডার্ড-মডেল: ফার্মিয়নদের তিনটি প্রজন্ম। বাঁয়ের কলামটি প্রথম-প্রজন্ম, মাঝেরটা দ্বিতীয়-প্রজন্ম, এবং ডানেরটা তৃতীয়-প্রজন্ম। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের ফার্মিয়নরা ভারী তাই প্রকৃতিতে এরা অত্যন্ত বিরল।

ফার্মিয়নরা দুটি ভাগে বিভক্ত: কোয়ার্ক এবং লেপ্টন। চার্জযুক্ত ইলেক্ট্রন এবং চার্জহীন নিউট্রিনো লেপ্টনের অন্তর্ভুক্ত। ফার্মিয়নদের বলে পদার্থ-কণা, কারণ এরা পদার্থ তৈরি করে, আগেই বলা হয়েছে যে, সাধারণ পদার্থ হলো ব্যারিয়নিক-ম্যাটার। ওপরের ছবিতে ফার্মিয়নদের তিনটি কলামে বিভিক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি কলাম একটি প্রজন্ম নির্দেশ করে। আমাদের মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থ শুধুই প্রথম প্রজন্মের ফার্মিয়ন দিয়ে গঠিত। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের অস্তিত্বের কারণ এখনো নিশ্চিত হওয়া যায় নি। আমরা দেখবো যে, চতুর্থ কিংবা উচ্চতর প্রজন্মের ফার্মিয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই ডার্ক-ম্যাটার কোনো অনাবিষ্কৃত ফার্মিয়ন হতে পারে না। বিভিন্ন প্রজন্মের সমতুল্য ফার্মিয়নদের চার্জ এবং স্পিন একই, পার্থক্য শুধুই ভরে।

ওপরের ছবিতে প্রতিটি প্রজন্মের কোয়ার্ক এবং লেপ্টনদের জোড়ায় জোড়ায় পাওয়া যায়, যেমন: ইলেক্ট্রন এবং ইলেক্ট্রন-নিউট্রিনো, বা আপ-কোয়ার্ক এবং ডাউন-কোয়ার্ক, ইত্যাদি। ধারণা করা হয় যে, প্রকৃতিতে এই যুগল কণাগুলো আসলে একই, কোনো এক অশূন্য বলক্ষেত্রের কারণে কণাগুলোর এই দ্বৈত রূপে প্রকাশ পায়। একে বলে প্রতিসাম্যতার-ভাঙ্গন (Symmetry breaking), গবেষকরা ধারণা করেন এই অশূন্য বলক্ষেত্র হচ্ছে হিগ্গস-বলক্ষেত্র (Higgs field) । হিগ্গস-বলক্ষেত্র অন্য যেকোনো বলক্ষেত্রের মতোই মহাবিশ্বের সর্বাংশে বিস্তৃত। তবে, হিগ্গস-বলক্ষেত্র হলো একমাত্র বলক্ষেত্র যার স্থিতিবস্থা অশূন্যতে, যার মান প্রায় 246GeV। একটি কণা যখন এই হিগ্গস-বলক্ষেত্রের অধীনে বিভিন্ন কার্যকলাপে জড়িয়ে পরে তখন প্রতিসাম্যতার-ভাঙ্গন ঘটে এবং কণাদের বিভিন্ন রূপে দেখা যায়।

spacetime-2
স্ট্যান্ডার্ড-মডেল: বোসনদের কোনো প্রজন্ম নেই। একমাত্র হিগ্গস হলো স্কেলার-বোসন, বাকি সবাই গেজ-বোসন।

এবার দেখা যাক, ফার্মিয়নরা কি কি কার্যকলাপে (বা নিউক্লিয়ার-কার্যালাপে) জড়াতে পারে। আমরা ইলেক্ট্রন এবং প্রোটনের বিদ্যুৎচুম্বকীয় কার্যকলাপ দেখেছিলাম, এই বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের বহনের কাজটি করে ফোটন। আমরা কোয়ার্ক এবং প্রোটন-নিউট্রনের প্রবল-নিউক্লিয়ার কার্যকলাপ দেখছিলাম, যেখানে বল-বাহক ছিলো যথাক্রমে গ্লুয়ন এবং পাইয়ন। আমরা গত পর্বে মাধ্যাকর্ষণের কথা বলেছিলাম, এই মাধ্যাকর্ষণ বলের বাহক হলো গ্র্যাভিটন। যদিও গ্র্যাভিটন এখনো পাওয়া যায়নি, তবে স্ট্যান্ডার্ড-মডেল গ্র্যাভিটনের অস্তিত্ব সম্পর্কে শক্তিশালী ভবিষ্যদ্বাণী করে।

দুর্বল-নিউক্লিয়ার বল (Weak nuclear force) তেজস্ক্রিয় বেটা-ক্ষয়ের জন্য দায়ী। একটি ফার্মিয়ন থেকে ভিন্ন ফার্মিয়নের রূপান্তর ঘটে এই দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলের কারণে। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের বাহিরে স্বাধীন নিউট্রন একটি অস্থায়ী ব্যারিয়ন। প্রায় দশ মিনিটে একটি স্বাধীন নিউট্রনের একটি প্রোটনে রূপান্তনের সম্ভাবনা ৫০%, এই দশ মিনিট হলো নিউট্রনের অর্ধ-জীবন। কিন্তু, এই নিউট্রন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে অত্যন্ত স্থিতিশীল। তবে নিউক্লিয়াসের স্থিতিশীলতার জন্য নিউট্রনের পরিমাণ নির্দিষ্ট হওয়া দরকার। অতিরিক্ত নিউট্রন ভারী মৌলদের তেজস্ক্রিয়তার জন্য দায়ী।

spacetime-1
দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলের প্রভাবে নিউট্রনের নিউক্লিয়ার-ক্ষয়। নিউট্রন প্রথমে প্রোটন এবং W- কণায় পরিণত হয়, প্রায় সাথে সাথে W- রূপান্তরিত হয় ইলেক্ট্রন এবং এন্টি-নিউট্রিনোতে।

বেটা-ক্ষয় এবং ফার্মিয়নদের রূপান্তরের জন্য দায়ী দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলের বাহক W- এবং W+ বোসন। অন্যদিকে, বিদ্যুৎচুম্বকীয় এবং দুর্বল-নিউক্লিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক সৃষ্টিকারী দুর্বল-বৈদ্যুতিক বলের (Weak electric force) বাহক Z বোসন। এই কার্যকলাপগুলোকে দুর্বল বলার কারণ হলো, W এবং Z বোসন অত্যন্ত ভারী, ফলে এই বোসনদের আদান-প্রাদান করতে প্রচুর সময় দরকার। তাই বেটা-ক্ষয় বা দুর্বল-বৈদ্যুতিক কাজের গতি ধীর। অন্যদিকে, ফোটন এবং গ্লুয়ন ভরহীন, ফলে বিদ্যুৎচুম্বকীয় এবং প্রবল-নিউক্লিয়ার কাজের গতি দ্রুত।

সবশেষে, হিগ্গস কণা বা হিগ্গস বোসন। হিগ্গস বোসন একটি শূন্য-স্পিন স্কেলার-বোসন। আমরা একটু আগে যে বোসন কণাদের কথা বলেছি তারা হলো গেজ-বোসন (Gauge boson), কারণ এরা গেজ-প্রতিসাম্যতা অনুসরণ করে। প্রতিটি গেজ-বোসনের প্রযুক্ত বলের একটি নির্দিষ্ট দিক আছে। অন্যদিকে, হিগ্গস কণা গেজ-প্রতিসাম্যতা অনুসরণ করে না, এবং স্কেলার-বোসন হবার কারণে হিগ্গস কণাদের প্রযুক্ত বলের কোনো দিক নেই।

কণাদের এই নিউক্লিয়ার-কার্যালাপ যে রেখাচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয় তাকে বলে ফাইনম্যান-ডায়াগ্রাম। এই ফাইনম্যান-ডায়াগ্রামের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নিয়ম হলো;

(এক) যেকোনো নিউক্লিয়ার-কার্যালাপের আগে ও পরে তিনটি সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকতে হয়। এই সংরক্ষিত সংখ্যাগুলো হলো চার্জ-সংখ্যাকোয়ার্ক-সংখ্যা, এবং লেপ্টন-সংখ্যা
(দুই) রেখাচিত্রের উৎপাদিত কণাকে ঐ একই রেখাচিত্রের যোগান (Input) হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তবে শর্ত হলো, যোগান হিসেবে উৎপাদিত কণাদের প্রতিকণা ব্যবহার করতে হবে। যেমন: উৎপাদিত কণা যদি ইলেক্ট্রন হয়, তবে ব্যবহার করতে হবে পজিট্রন। যেহেতু ফোটন নিজেই নিজের প্রতিকণা তাই ফোটনকে পরিবর্তন ছাড়াই যোগান হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
(তিন) সংরক্ষিত সংখ্যার মতোই ভরবেগ সংরক্ষণ করতে হয়। ভরবেগ হলো কণার স্থিরভর (Rest mass) এবং গতিশক্তির (Kinetic energy) সমষ্টি। এই নিয়মের কারণে, নিম্ন ভরবেগের কণা কখনোই উচ্চ ভরবেগের কণায় পরিণত হতে পারে না। যেমন: নিউট্রন প্রোটনের চেয়ে সামান্য ভারী, ফলে প্রোটন কখনোই নিউট্রনে রূপান্তরিত হতে পারে না।

spacetime-3
এই নিউক্লিয়ার-কার্যালাপটি সঠিক, কারণ এতে লেপ্টন-সংখ্যা, কোয়ার্ক-সংখ্যা, চার্জ-সংখ্যা, এবং ভরবেগ সংরক্ষণ করা হয়েছে।
spacetime-4
এই নিউক্লিয়ার-কার্যালাপটি ভুল, কারণ এতে লেপ্টন-সংখ্যা সংরক্ষণ করা হয়নি।
spacetime-5
এই নিউক্লিয়ার-কার্যালাপটি ভুল, কারণ এতে কোয়ার্ক-সংখ্যা সংরক্ষণ করা হয়নি।
spacetime-6
এই নিউক্লিয়ার-কার্যালাপটি ভুল, কারণ এতে চার্জ-সংখ্যা সংরক্ষণ করা হয়নি।
spacetime-7
এই নিউক্লিয়ার-কার্যালাপটি ভুল, কারণ এতে ভরবেগ সংরক্ষণ করা হয়নি।

এবার আমরা যদি মহাবিশ্বের সূচনালগ্নের দিকে তাকাই, বিশেষ করে মহাবিশ্বের আকার যখন বর্তমানের চেয়ে একশ কোটিভাগের একভাগ ছিলো, তখন মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ছিলো প্রায় তিনশো কোটি ডিগ্রী কেলভিন। এই প্রচন্ড তাপমাত্রায় কণাদের গতিশক্তি ছিলো আলোর কাছাকাছি ফলে তারা নিউক্লিয়াস গঠনের সুযোগই পায়নি। মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র আকার এবং প্রচন্ড গতির কারণে কণারা দ্রুত ও সহজে একে অন্যের সাথে নিউক্লিয়ার-কার্যালাপে জড়িয়ে যেতে পারতো। এই সময় দুটি ধরণের নতুন কণা তৈরি হওয়া সম্ভব ছিলো যেগুলো ডার্ক-ম্যাটার প্রার্থী হতে পারে।

spacetime-1
বিগ-ব্যাংয়ের সূচনালগ্নে তীব্র গতিশক্তিযুক্ত ইলেক্ট্রন এবং পজিট্রনের পক্ষে অত্যন্ত ভারী কিন্তু ধীরগতির x-কণা এবং x-প্রতিকণা তৈরি করা সম্ভব ছিলো। এখানে “x” একটি কাল্পনিক কণা।

(এক) শীতল-কণা: হালকা কণা প্রতিকণা একে অন্যকে বিনাশের মাধ্যমে অত্যন্ত ভারী কণা এবং প্রতিকণা তৈরি করতে পারে। ব্যাপারটা ফাইনম্যান-ডায়াগ্রামের তৃতীয় নিয়মের লঙ্ঘন মনে হতে পারে, কিন্তু মহাবিশ্বের সূচনালগ্নে এটা সম্ভব। কারণ, প্রচন্ড তাপের জন্য কণাদের ভরবেগের সিংহভাগই ছিলো গতিশক্তি। অন্যদিকে, কণা এবং প্রতিকণাদের সংরক্ষিত সংখ্যাগুলোর সমষ্টি শূন্য, তাই এই প্রক্রিয়ায় প্রথম নিয়মও ভঙ্গ হয় না। এই ধরণের ভারী কণাদের বলা হয় শীতল-কণা (Cold particles), কারণ ভর খুব বেশি হওয়াতে এদের গতিশক্তি হয় কম, ফলে এরা অন্যান্য কণাদের মতো দ্রুত নিউক্লিয়ার-কার্যকলাপে জড়াতে পারে না। মহাবিশ্বের শুরুতে তৈরী হওয়া এই ধরণের ভারী কণারা ডার্ক-ম্যাটার হবার সম্ভাবনা খুব বেশি।

প্রশ্ন আসতে পারে, নিউট্রনের মতোই এই ধরণের ভারী কণাদের নিউক্লিয়ার-ক্ষয় হবার কথা, কিন্তু আমাদের জানা মতে ডার্ক-ম্যাটার অত্যন্ত স্থিতিশীল। এর ব্যাখ্যা হতে পারে, ফার্মিয়নদের মতোই ডার্ক-ম্যাটারের হয়তো কোনো সংরক্ষিত সংখ্যা আছে। ধরা যাক, সংরক্ষিত সংখ্যাটি ডার্ক-ম্যাটার-সংখ্যা। এই ডার্ক-ম্যাটার-সংখ্যা কারণেই খুব সম্ভবত ডার্ক-ম্যাটার কণা স্ট্যান্ডার্ড-মডেলের অন্য কোনো কণায় রূপান্তরিত হতে পারে না।

আরো প্রশ্ন হতে পারে, ডার্ক-ম্যাটার কণা এবং প্রতিকণার একে অন্যকে এতো দিনে বিনাশ করে ফেলতো। ডার্ক-ম্যাটার কণা অত্যন্ত ভারী, ফলে এদের নিউক্লিয়ার-কার্যকলাপ অত্যন্ত ধীর। তাই ডার্ক-ম্যাটার কণাদের তাদের প্রতিকণা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। যেহেতু ডার্ক-ম্যাটার প্রবল-নিউক্লিয়ার এবং বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলে সাড়া দেয়না, তাই এদের কণা এবং প্রতিকণারা একেবারে লাগালাগি অবস্থায় না এলে বিনাশ হবার সম্ভাবনা কম। এটাও হতে পারে যে, যে অজ্ঞাত কারণে মহাবিশ্বে প্রতিকণার চেয়ে কণাদের সংখ্যা বেশি, হয়তো একই কারণে ডার্ক-ম্যাটারের প্রতিকণা এবং কণাদের পরিমাণ সমান নয়।

ডার্ক-ম্যাটার প্রার্থী এইধরণের শীতল কণাদের বলে WIMP (Weakly interacting massive particles)। WIMP হলো ধীর ক্রিয়াশীল এবং অত্যন্ত ভারী কণা। এরা প্রবল-নিউক্লিয়ার বা বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলে সাড়া দেয়না, কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ বলে সবসময় এবং দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলে মাঝে মধ্যে সাড়া দেয়। আপাতত স্ট্যান্ডার্ড-মডেলে WIMPয়ের প্রায় সমতুল্য একমাত্র প্রার্থী কণা হলো নিউট্রিনো।

(দুই) তপ্ত-কণা: মহাবিশ্বের সূচনালগ্নে শীতল-কণার মতোই এমন কণা এবং প্রতিকণা তৈরি হবার সম্ভাবনা ছিলো যারা খুব হালকা। হালকা বলে এদের গতি প্রায় আলোর কাছাকাছি। তাই এদের বলে তপ্ত-কণা (Hot particles)। বস্তুত, স্ট্যান্ডার্ড-মডেলে একটি কণা আছে যার বৈশিষ্ট্য হুবুহু তপ্ত কণাদের মতো। কণাটির হলো নিউট্রিনো। নিউট্রিনো অত্যন্ত হালকা, এর গতি আলোরগতির কাছাকাছি। নিউট্রিনো লেপ্টন পরিবারের তাই এরা প্রবল-নিউক্লিয়ার বলে সাড়া দেয়না, নিউট্রিনো চার্জহীন তাই এরা বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলেও সাড়া দেয়না। সমস্যা হলো, নিউট্রিনো গতি আলোর কাছাকাছি, ফলে এরা গ্যালাক্সি বা ক্লাস্টারের মতো কাঠামোতে আবদ্ধ থাকে না। ডার্ক-ম্যাটারের পরিমাণ সাধারণ-পদার্থের পাঁচগুণ, তাই নিউট্রিনো যদি ডার্ক-ম্যাটার হতো তবে সমস্ত পদার্থ মহাবিশ্বের প্রতি অংশে সমানভাবে ছড়িয়ে যেতো, ফলে CMBতে লাল এবং নীল বিন্যাসগুলো দেখা যেতো না। তাই এটা প্রায় নিশ্চিত যে, তপ্ত-কণারা ডার্ক-ম্যাটার হতে পারে না।

ব্ল্যাকহোল, নিউট্রন-নক্ষত্র, শ্বেত-বামন, কিংবা ধূসর-বামন ইত্যাদি অতিকায় মহাজাগতিক বস্তুদের বলে MACHO (Massive compact halo objects)। একসময় এই MACHOদের দায়ী করা হতো গ্যালাক্সি বা ক্লাস্টারের অস্বাভাবিক রোটেশনাল-কার্ভের জন্য। MACHOরা প্রায়শই কোনো আলোকরশ্মি নিঃসরণ করে না, তাই বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গে এরা অদৃশ্য। কিন্তু, MACHOরা গ্র্যাভিটেশনাল-লেন্সিংয়ের জন্য দায়ী। সমস্যা হলো, ডার্ক-ম্যাটার প্রতিস্থাপন করার জন্য প্রয়োজনীয় MACHOদের যে পরিমাণ মাইক্রোলেন্সিং করার কথা, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তার ন্যূনতমও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই, MACHOদের অনেক আগেই ডার্ক-ম্যাটারের প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।

figures_PartI_PP_Cosmo
বিগ-ব্যাংয়ের সূচনালগ্নের সময়কাল: শীতল-কণা বা WIMPদের নিউক্লিয়ার-কার্যালাপ নিউক্লিয়োসিন্থেসিস শুরু হবার বহু আগেই বন্ধ হয়ে যায়। নিউক্লিয়োসিন্থেসিসের শুরুতে বাকি সব কণাদের নিউক্লিয়ার-কার্যালাপ বদ্ধ হয় এবং কণারা নিউক্লিয়াস গঠন করতে শুরু করে।

মহাবিশ্বের সূচনালগ্নে কি পরিমাণ সাধারণ-পদার্থ তৈরি হয়েছিলো সে সম্পর্কে ধারণা দেন করেন জর্জ গ্যামো (George Gamow) এবং রাল্ফ আল্ফার (Ralph Alpher) ১৯৪৮ সালে।  তাদের এই ধারণাকে বলে বিগ-ব্যাং-নিউক্লিয়োসিন্থেসিস (Big bang nucleosynthesis)। বিং-ব্যাংয়ের প্রথম সেকেন্ডে মহাবিশ্বের আকার ছিলো বর্তমান আকারের একশত কোটিভাগের একভাগ, এবং এর তাপমাত্রা ছিলো তিনশত কোটি ডিগ্রী কেলভিন। এই অবস্থায় কণারা নিউক্লিয়াস গঠন করতে পারেনি, বরং কণারা বিভিন্ন প্রকার নিউক্লিয়ার-কার্যলাপে জড়িত ছিলো। প্রায় এক মিনিট পর তাপমাত্রা কিছুটা কমের এলে কণাদের নিউক্লিয়ার-কার্যালাপ বন্ধ হয়ে যায় এবং কণারা নিউক্লিয়াস গঠন করতে শুরু করে। এই এক সেকেন্ড শেষে মহাবিশ্বের প্রতি ছয়টি প্রোটনের বিপরীতে একটি নিউট্রন তৈরি হয়েছিলো। আমরা জানি, নিউক্লিয়াস বিহীন নিউট্রন অস্থায়ী, তাই নিউক্লিয়াস গঠনের আগে মুহূর্তে কিছু নিউট্রন নিউক্লিয়ার-ক্ষয়ের মাধ্যমে প্রোটনে রূপান্তরিত হয়। ফলে, প্রোটন এবং নিউট্রনের অনুপাত দাঁড়ায় ৭:১।

বিগ-ব্যাংয়ের এক মিনিট পরে প্রোটন এবং নিউট্রনগুলো যুক্ত হয়ে ক্ষণস্থায়ী ডিউটেরিয়াম নিউক্লিয়াস গঠন করে। এরপর দুটি ডিউটোরিয়াম নিউক্লিয়াস জোড়া লেগে তৈরি হয় হিলিয়াম-৪ নিউক্লিয়াস। এই হিলিয়াম-৪ নিউক্লিয়াসকে বলে আলফা-কণা এবং এটি একটি অত্যন্ত স্থায়ী নিউক্লিয়াস। একইভাবে, হিলিয়াম-৪ এবং ডিউটেরিয়াম যুক্ত হয়ে লিথিয়াম নিউক্লিয়াস, ডিউটেরিয়াম প্রোটনের সাথে যুক্ত হয়ে হিলিয়াম-৩ নিউক্লিয়াস গঠন করে। এভাবে, মহাবিশ্বের প্রারম্ভিক নিউট্রনগুলোর সবটাই প্রধানত হিলিয়াম-৪ এবং সামান্য ডিউটেরিয়াম, হিলিয়াম-৩ এবং লিথিয়ামে পরিণত হয়।

cmb_scatter
বিগ-ব্যাংয়ের সূচনালগ্নের সময়কাল: নিউক্লিয়োসিন্থেসিসের সময় মহাবিশ্ব ছিলো প্লাসমা। বিগ-ব্যাংয়ের ফোটনেরা এই প্লাসমায় আটক পড়ে গিয়েছিলো, অনেকটা ঘন মেঘের সূর্য আড়াল হবার মতো। রিকম্বিনেশনের শুরুতে ঘোলা প্লাসমা ধীরে ধীরে স্বচ্ছ গ্যাসের পরিণত হতে শুরু করে, ফলে বিগ-ব্যাংয়ের ফোটনেরা মহাবিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

বিগ-ব্যাং-নিউক্লিয়োসিন্থেসিস চলতে থাকে প্রায় তিনলক্ষ আশি হাজার বছর পর্যন্ত। এই সময়ে ইলেট্রন, প্রোটন, এবং বিভিন্ন নিউক্লিয়াস প্লাসমা অবস্থায় ছিলো। বিগ-ব্যাংয়ের বিকিরণজনিত ফোটনগুলো এই চার্জযুক্ত কণাদের সাথে ক্রমাগত ধাক্কা খেতে থাকে, ফলে ফোটনগুলো এই প্লাসমার মধ্যে আটকা পরে যায়। তিনলক্ষ আশি হাজার বছর শেষে মহাবিশ্বের আকার দাঁড়ায় বর্তমান আকারের একহাজার ভাগের একভাগে, এবং তাপমাত্রা কমে দাঁড়ায় তিনহাজার  ডিগ্রী কেলভিনে। এই তাপমাত্রায় প্রোটন এবং নিউক্লিয়াসগুলো ইলেক্ট্রনের সাথে যুক্ত হয়ে হাইড্রোজেন, ডিউটোরিয়াম, হিলিয়াম, লিথিয়াম ইত্যাদি পরমাণু গঠন করে। ফলে মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে প্লাসমা থেকে গ্যাসীয় কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়। এতে প্লাসমায় আটকে পড়া ফোটনগুলো মুক্ত হয়ে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়টাকে বলে রিকম্বিনেশন (Recombination)। রিকম্বিনেশনের সময় ছড়িয়ে পড়া এই বিকিরণকে আজ আমরা বলি CMB। রিকম্বিনেশনের পরপর CMBয়ের তাপমাত্রা ছিলো প্রায় তিন হাজার ডিগ্রী কেলভিন। কিন্তু মহাবিশ্বে সম্প্রসারণের সাথে সাথে এই বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে, ফলে বিকিরণের শক্তি কমতে থাকে। প্রায় ১৪শত কোটি বছর পর আজ এই বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাইক্রোওয়েভ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, এবং এর তাপমাত্রা প্রায় তিন ডিগ্ৰী কেলভিন। তাই একে বলে CMB (Cosmic microwave background)। যা হোক, রিকম্বিনেশনের শুরুতে মহাবিশ্বের সমস্ত ব্যারিয়নিক পদার্থ ছিলো প্রধানত হাইড্রোজেন, কিছু হিলিয়াম-৪, এবং সামান্য ডিউটোরিয়াম, হিলিয়াম-৩ ও লিথিয়াম।

101087b
রেখাগুলো বিগ-ব্যাং-নিউক্লিয়োসিন্থেসিসের সময় তৈরি হওয়া হাইড্রোজেনের সাথে অন্যান্য মৌলের অনুপাত নির্দেশ করে। WMAPয়ের পর্যবেক্ষণ ব্যবহার করে, এই রেখাচিত্র থেকে বিগব্যাংয়ের সময় তৈরি হওয়া ব্যারিয়ন-পদার্থের মোট পরিমাণ নির্ণয় করা হয়।

ওপরের ছবিতে বিগ-ব্যাং-নিউক্লিয়োসিন্থেসিসের সময় হাইড্রোজেনের তুলোনায় হিলিয়াম-৪, ডিউটেরিয়াম, হিলিয়াম-৩, এবং লিথিয়ামের প্রাচুর্যতা বিভিন্ন রেখার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। মহাবিশ্বে হাইড্রোজেনের সাথে এই মৌলগুলোর অনুপাত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়। এই পর্যবেক্ষণের জন্য প্রথমে মহাকাশের কোয়েসারের মতো কোনো দূরবর্তী উজ্জ্বল বস্তু খুঁজে বের করা হয়, যার দৃষ্টিরেখায় (Line of sight) কোনো নক্ষত্র বা MACHO নেই। পর্যবেক্ষণ যন্ত্র এবং কোয়েসারের মধ্যবর্তী বিশাল ফাঁকা অংশে বিগ-ব্যাংয়ের সমসাময়িক প্রচুর আদি গ্যাস পাওয়া যায়। কোয়েসারের আলোকরশ্মি এই আদি গ্যাসের মধ্যে দিয়ে পর্যবেক্ষণ যন্ত্রে পৌঁছানোর সময় গ্যাসের বিভিন্ন মৌলগুলো আলোর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে। ফলে, আলোর বর্ণালীতে অনেক অবসর্পশন-লাইন দেখা যায়, এই অবসর্পশন-লাইনগুলো বিশ্লেষণ করে গ্যাসে উপস্থিত মৌল এবং তাদের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। ওপরে ছবিতে WMAP স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পাওয়া পর্যবেক্ষণ লাল লম্বের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।

spacetime-3
নক্ষত্ররা হাইড্রোজেন জোড়া লাগিয়ে হিলিয়াম এবং উচ্চতর মৌল তৈরি করে। তাই, বিগ-ব্যাং-নিউক্লিয়োসিন্থেসিসের সময় তৈরি হওয়া মৌলদের অনুপাত বের করতে হলে, মহাবিশ্বের এমন অংশ বেছে নিতে হয় যেখানে কোনো নক্ষত্র বা MACHO থাকে না। দূরবর্তী কোয়েসারের বর্ণালী বিশ্লেষণের মাধ্যমে আন্তঃগ্যালাক্টিক গ্যাসে উপস্থিত থাকা বিভিন্ন মৌলের অনুপাত বের করা হয়।

বিগ-ব্যাং-নিউক্লিয়োসিন্থেসিসের ফলাফল থেকে আমরা নিচের সিদ্ধান্তে আসতে পারি;

(এক) বিগ-ব্যাংয়ের পরপর মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ছিলো বিকিরণ নির্ভর (ব্যারিয়ন ও ফোটনের অনুপাত ১০^(-৯))। এই বিকিরণের মূল উৎস ছিলো ফোটন এবং তপ্ত-কণা (যেমন নিউট্রিনো)। ব্যাপারটা এটাই ইঙ্গিত করে যে, প্রকৃতিতে চতুর্থ কিংবা উচ্চ প্রজন্মের কোনো কণা নেই। যদি থাকতো তবে ঐ অজানা প্রজন্মের নিউট্রিনো বিগ-ব্যাংয়ের সমসাময়িক বিকিরণে অংশ নিতো এবং মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ঘটতো দ্রুত। ফলে বিগ-ব্যাং-নিউক্লিয়োসিন্থেসিসের সময় কম হিলিয়াম-৪ উৎপন্ন হতো, এবং WMAPয়ের পর্যবেক্ষণকৃত মানও হতো ভিন্ন। সুতরাং, আমরা নিশ্চিত যে, স্ট্যান্ডার্ড-মডেলে কণাদের তিনটির বেশি কোনো প্রজন্ম নেই। আর তাই, ডার্ক-ম্যাটার কোনো অনাবিষ্কৃত প্রজন্মের ফার্মিয়ন হতে পারে না।

(দুই) বিগ-ব্যাং পরবর্তী গ্যাসের অনুপাত নির্দেশ করে যে, ব্যারিয়নিক পদার্থ ডার্ক-ম্যাটার হতে পারে না। বিশেষ করে হিলিয়াম-৪, বিগ-ব্যাং-নিউক্লিয়োসিন্থেসিস প্রক্রিয়ায় যে পরিমাণ হিলিয়াম-৪ তৈরি হয় সেটা ডার্ক-ম্যাটার হবার জন্য যথেষ্ট নয়। অন্যদিকে, বিগ-ব্যাং-নিউক্লিয়োসিন্থেসিস প্রক্রিয়ায় তৈরি ব্যারিয়নিক পদার্থগুলোই ফ্রীডম্যানের সমীকরণের ৫% বস্তু-ঘনত্ব; যারা পরবর্তীতে গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ, ব্ল্যাকহোলে ইত্যাদিতে পরিণত হয়। তাই আমাদের জানা মহাজাগতিক বস্তুগুলো যে অবস্থাতেই থাকুক না কেনো তারা মহাবিশ্বের মাত্র ৫%।

ডার্ক-ম্যাটার যে বিগ-ব্যাংয়ের সময় তৈরি হয়েছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায় CMB থেকে। আগেই বলা হয়েছে যে, বিগ-ব্যাংয়ের প্রথম মিনিট থেকে রিকম্বিনেশন পর্যন্ত মহাবিশ্ব প্লাসমা অবস্থায় ছিলো। এই প্লাসমার বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যারিয়নগুলো প্রচন্ড তাপে প্রসারিত হতো, এই প্রসারণের সাথে সাথে অঞ্চলগুলোর তাপমাত্রা কমতে শুরু করতো। যখন তাপমাত্রা আশেপাশের চেয়ে কমে যেতো তখন অঞ্চলগুলো সংকুচিত হতে শুরু করতো। এই সংকোচনের সাথে সাথে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটতো, আর তাপমাত্রা আশেপাশের চেয়ে বেশি হয়ে গেলে অঞ্চলগুলো আবার প্রসারিত হতে শুরু করতো। তাপের ওঠা-নামার কারণে ব্যারিয়নদের এই নিয়মিত সংকোচন-প্রসারণকে বলে BAO বা ব্যারিয়নিক-একুইস্টিক-অসিলেশন (Baryonic acoustic oscillations)। অন্যদিকে, ডার্ক-ম্যাটার হলো ভারী কণা, তাপ ওঠা-নামার সাথে সাথে এদের নড়া-চড়া ঘটে অত্যন্ত ধীরে। বলা যায়, ডার্ক-ম্যাটারের ওপর তাপমাত্রার প্রভাব একেবারেই কম। তাই ডার্ক-ম্যাটার কণাগুলো শুধুই মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে একজায়গায় জড়ো হতে থাকে। ডার্ক-ম্যাটারের এই চলন এবং BAO ঘটতো যুগপৎ, কিন্তু এলোমেলোভাবে। দেখা গেলো, ডার্ক-ম্যাটার যখন একটি অঞ্চলে জড়ো হচ্ছে, ঐ অঞ্চলের ব্যারিয়নরা তখন সংকুচিত হচ্ছে, ফলে দুজনেরই ছন্দ এক। অথবা দেখা গেলো, কোনো অঞ্চলের ডার্ক-ম্যাটার যখন জড়ো হচ্ছে, ঐ অঞ্চলের ব্যারিয়নরা তখন প্রসারিত হচ্ছে, ফলে দুজনেরই ছন্দ উল্টো। ডার্ক-ম্যাটারের এই চলনের কারণে BAOয়ের দোলনে (Oscillation) সামান্য পরিবর্তন ঘটে। BAOয়ের এই পরিবর্তন CMBয়ের লাল অঞ্চলগুলোতে নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা গেছে।

BAO-cartoon
শিল্পীর দৃষ্টিতে BAO বা ব্যারিয়নিক-একুইস্টিক-অসিলেশন।

সুতরাং বলা যায় যে, ডার্ক-ম্যাটার কণা যে বিগ-ব্যাংয়ের সময় তৈরি হওয়া শীতল-কণা (বা WIMP) যারা স্ট্যান্ডার্ড-মডেলের অন্তর্ভুক্ত নয়। স্ট্যান্ডার্ড-মডেলের অন্তর্ভুক্ত না হলেও আমাদের কাছে বিকল্প কিছু গাণিতিক মডেল আছে যারা WIMP ধরণের কণার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করার যোগ্যতা রাখে। এর মধ্য সবার আগে আছে স্ট্রিং-তত্ত্ব। স্ট্রিং-তত্ত্ব আবিষ্কারের কারণ ছিলো প্রবল-নিউক্লিয়ার বল ব্যাখ্যা করা। আমরা কোয়ার্কদের হ্যাড্রন কাঠামোকে একটা রবারের সাথে তুলোনা করেছিলাম। মূলত এই রবার রূপক থেকেই স্ট্রিং-তত্ত্বের জনকদের মাথায় স্ট্রিং বা তন্তু শব্দটি এসেছিলো। যদিও এই তত্ত্ব প্রবল-নিউক্লিয়ার বল ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়, কিন্তু পরবর্তীতে এটি শক্তিশালী কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটি তত্ত্ব হিসেবে বিকাশ পায়।

স্ট্রিং-তত্ত্বের ভিত্তি হলো অতিপ্রতিসাম্যতা (Supersymmetry)। স্ট্রিং-তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্বের প্রতিটি কণার অতিপ্রতিসম-কণা আছে (Supersymmetric particles)। আমরা আগে প্রতিকণা দেখেছি, মূল কণার সাথে এদের পার্থক্য শুধু “চার্জে”। অন্যদিকে, অতিপ্রতিসম-কণা থেকে মূল কণার পার্থক্য শুধুই “স্পিনে”। ভালো করে বললে, স্ট্রিং-তত্ত্ব অনুসারে প্রতিটি ফার্মিয়নের একটি বোসন; এবং প্রতিটি বোসনের একটি ফার্মিয়ন অতিপ্রতিসম-কণা আছে। যেমন: ১/২-স্পিনযুক্ত ইলেক্ট্রনের প্রস্তাবিত অতিপ্রতিসম-কণা হলো ১-স্পিনের সিলেক্ট্রন (Selectron, বোসন); ১-স্পিনযুক্ত ফোটনের প্রস্তাবিত ফার্মিয়ন অতিপ্রতিসম-কণা হলো ১/২-স্পিনের ফোটিনো (ফার্মিয়ন)।

spacetime-7
স্ট্রিং-তত্ত্বের প্রস্তাবিত অতিপ্রতিসম-কণা পরিবার (ওপরে)। নিচে, স্ট্যান্ডার্ড-মডেল পরিবার।

যেহেতু অতিপ্রতিসম-কণাদের ভর এবং চার্জ মূল কণাদের সমান, পার্থক্য শুধুই স্পিনে; তাই ইলেক্ট্রন কিংবা ফোটনের মতোই অতিসহজে তাদের অতিপ্রতিসম-কণা খুঁজে পাওয়া কথা। সমস্যা হলো, আজো প্রস্তাবিত কোনো অতিপ্রতিসম-কণা খুঁজে পাওয়া যায়নি। লেপ্টন এবং কোয়ার্কদের প্রতিসাম্যতা ভঙ্গের কথা বলা হয়েছিলো। ধারণা করা হয়, এই প্রতিসাম্যতা ভঙ্গের ব্যাপারটা অতিপ্রতিসম-কণা ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রতিসাম্যতা ভঙ্গের কারণে অতিপ্রতিসম-কণারা অত্যন্ত ভারী কণায় পরিণত হয়। আর প্রকৃতির নিয়ম হলো, ভারী কণাগুলো হয় অতিক্ষুদ্র, যে কণা যতো ভারী সে কণা ততোই ক্ষুদ্র। এইজন্যই ভারী কণাদের খুঁজে পেতে অত্যন্ত শক্তিশালী পার্টিকেল-এক্সেলারেটর দরকার, যেটা ক্ষুদ্র স্থানে প্রচুর শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। আপাতত মানব ইতিহাসে তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী পার্টিকেল-এক্সেলারেটর LHC (Large Hadron Collider) চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই অতিপ্রতিসম-কণাদের খুঁজে বের করতে।

অতিপ্রতিসম-কণা পরিবারের সবচেয়ে হালকা কণাকে WIMPয়ের যোগ্য প্রার্থী হিসেবে ধরা হয়, তাই স্ট্রিং-তত্ত্বে সম্ভাব্য ডার্ক-ম্যাটার কণাদের বলে LSP ( Lightest supersymmetric particle)। কারণটা হলো, সবচেয়ে হালকা বলে এই অতিপ্রতিসম-কণা অন্যকোনো অতিপ্রতিসম-কণায় পরিণত হতে পারে না। ধারণা করা হয়, এই অতিপ্রতিসম-কণা নিউক্লিয়ার-কার্যলাপে নতুন একটি সংরক্ষিত সংখ্যা মেনে চলে; এই সংরক্ষিত সংখ্যাটি হলো অতিসাম্যতা-সংখ্যা (Supersymmetric quantity)। এই অতিসাম্যতা-সংখ্যার কারণে অতিপ্রতিসম-কণাগুলো মূল কণায় রূপান্তরিত হতে পারে না।

প্রতিসম-কণা পরিবারে চারটি কণা আছে যারা চার্জহীন ফার্মিয়ন, এই চারটি প্রতিসম-কণাদের বলে নিউট্রালিনো (Neutralino)। নিউট্রালিনো তৈরি হয় হিগ্গজিনোর (Higgsino, হিগ্গস-বোসনের প্রতিসম-কণা) সাথে ফোটিনো (Photino, ফোটনের প্রতিসম-কণা), এবং হিগ্গজিনোর সাথে জিনোর (Zino, Z-বোসনের প্রতিসম-কণা) কোয়ান্টাম-স্টেট ভাগাভাগির মাধ্যমে। এদের মধ্যে সবচেয়ে হালকা নিউট্রালিনোকেই বলা হয়, LSP।

আমরা এতোক্ষণ যে ডার্ক-ম্যাটার কণার কথা বলছিলাম তারা সবাই ফার্মিয়ন, অর্থাৎ, WIMP একটি ফার্মিয়ন। ডার্ক-ম্যাটার কণার দ্বিতীয় শক্তিশালী প্রার্থী হলো একটি বোসন, নাম এক্সিয়ন (Axion)। এক্সিয়ন সৃষ্টির প্রক্রিয়া একদম ভিন্ন। ধারণা করা হয়, বিগ-ব্যাংয়ের সময় এক্সিয়ন-বলক্ষেত্র একটি অশূন্য মানে অবস্থান করছিলো। এই বলক্ষেত্রটি প্লাসমার অন্যকোনো কণাদের সাথে নিউক্লিয়ার-কার্যলাপে জড়ায়নি। পরবর্তীতে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এই এক্সিয়ন-বলক্ষেত্রটি ভেঙ্গে পড়ে। এই ভেঙ্গে পড়া বলক্ষেত্রের শক্তি অতি হালকা এবং গতিশূন্য এক্সিয়ন-কণায় রূপান্তরিত হয়। গাণিতিকভাবে এক্সিয়ন ডার্ক-ম্যাটার সমপরিমাণের ভর তৈরি করে। কিন্তু সমস্যা হলো, আজো এই এক্সিয়ন কণা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তৃতীয় WIMP প্রার্থী হলো LKP বা (Lightest Kaluza-Klein Particle)। এই গাণিতিক মডেলে ধারণা করা হয় যে, স্থানকাল বাস্তবে পঞ্চ-মাত্রিক, এতে রয়েছে চারটি স্থানমাত্রা এবং একটি সময়মাত্রা। অতিরিক্ত স্থানমাত্রাটি অতিক্ষুদ্র এবং কুঁচকানো। স্ট্যান্ডার্ড-মডেলের প্রতি কণার ভরবেগের একটা নূন্যতম অংশ বা কোয়ান্টা এই অতিরিক্ত স্থান-মাত্রায় বিস্তৃত। LKP মডেল অনুসারে, এই অতিরিক্ত স্থানমাত্রায় সাধারণ কণাদের নূন্যতম ভরবেগ LKP-কণা হিসেবে প্রকাশ পায়। LKP মডেলটি এখনো পরীক্ষণের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

WIMPয়ের সবচেয়ে কম জনপ্রিয় প্রার্থী হলো নির্বীজ বা স্টেরাইল-নিউট্রিনো (Sterile neutrino)। সাধারণ নিউট্রিনো মাধ্যাকর্ষণ এবং দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলে সাড়া দেয়। কিন্তু, স্টেরাইল-নিউট্রিনো মাধ্যাকর্ষণ বাদের অন্যকোনো বলে সাড়া দেয়না। এইজন্যই এদের বলে নির্বীজ। তবে, সাধারণ নিউট্রিনো মতোই স্টেরাইল-নিউট্রিনোর WIMP হবার সম্ভাবনা কম। স্টেরাইল-নিউট্রিনো এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।

আগের পর্ব: আইনস্টাইনের মহাবিশ্ব
পরের পর্ব: ডার্ক-এনার্জি

অবলম্বনে: “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “Dark Matter, Dark Energy: The Dark Side of the Universe” by “Sean Carroll”