দর্শন বনাম বিজ্ঞান: যুক্তির অসারতা বনাম তথ্য ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড-ভিউ

আসলেই কি তাই!

স্টিভেন ওয়েইনবার্গের মতে দর্শন “ক্ষতিকর”, স্টিফেন হকিং-এর মতে “মৃত”, নিল ডি-গ্রাস টাইসনের মতে “বিভ্রান্তিকর”। দর্শন সম্পর্কে বেশিরভাগ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান প্রচারকদের দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা ভিন্ন নয়।

বিজ্ঞানের জন্ম দর্শন থেকে, বিজ্ঞানকে একসময় বলা হতো ন্যাচারাল-ফিলোসফি। বিজ্ঞানের সীমানা নির্ধারণও করেছেন এজন দার্শনিক (কার্ল পপার)। কিন্তু, গত দুইশো বছরে বিজ্ঞানের যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়, সে তুলনায় দর্শন একদমই এগোয়নি। ফলে, বিজ্ঞান ও দর্শন -এই দুইয়ের ভেতর মিলের চেয়ে অমিল এতো বেশি যে, কেউই বিজ্ঞানকে এখন দর্শনের অংশ মনে করে না।

প্রশ্ন হলো ব্যক্তিগত, সামাজিক, বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে কোনটি বেশি দরকার -বিজ্ঞান নাকি দর্শন?

দর্শনের মূল ভিত্তি ফর্মাল লজিক (যুক্তিবিদ্যা)। এই ফর্মাল লজিকের জনক এরিস্টটল, এজন্য অনেক দার্শনিকের মতে পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট ব্যক্তি ছিলেন “এরিস্টটল”। লজিক্যাল ফ্যালাসি বলতে যা বোঝায়, সেগুলো এই ফর্মাল লজিকের সাথে সম্পর্কিত। দর্শন ব্যবহার করা হয় মূলত অন্টোলজি (ontology), মেটাফিজিক্স (metaphysics), ও এথিক্স (ethics) চর্চায়। (অতি সরল ভাবে) অন্টোলজির কাজ হলো কোনো জিনিসের “বাস্তব রূপ (reality)” সম্পর্কে ধারণা দেয়া, যেমন -ইলেক্ট্রন দেখতে কেমন? এটা অন্টোলজিক্যাল প্রশ্ন। মেটাফিজিক্সের কাজ কোনো জিনিসের “বৈশিষ্ট্য (attribute)” বর্ণনা করে, যেমন -পজিটিভ চার্জযুক্ত কণাদের আকর্ষণ করা ইলেক্ট্রনের একটা ধর্ম। অন্যদিকে, এথিক্স কোনো জিনিসের “মূল্য (value)” সম্পর্কে ধারণা দেয়।

অন্যদিকে, বিজ্ঞানের ভিত্তি হলো ডেটা বা তথ্য। বিজ্ঞান ব্যবহার করা হয় এপিস্টেমলজি (epistemology) চর্চায়। (অতি সরল ভাবে) এপিস্টেমলজির কাজ হলো কোনো জিনিস সম্পর্কে “জ্ঞান (knowledge)” প্রতিষ্ঠা করা। একসময় এপিস্টেমলজির চর্চায় বিজ্ঞান ছাড়াও অন্যান্য প্ৰক্ৰিয়া ব্যবহার করা হতো (যেমন -জাদুবিদ্যা, ঐশীবিদ্যা); কিন্তু , (আগেই বলা হয়েছে) গত দুশো বিজ্ঞানের এতোই অগ্রগতি হয়েছে যে, এখন বিজ্ঞান ও এপিস্টেমলজি -দুটি প্রায় সমার্থক।

যেখানে দর্শন কোনো জিনিসের রিয়ালিটি বর্ণনা দেয়, সেখানে বিজ্ঞান বর্ণনা করে ফ্যাক্ট (fact)। যেমন -ইলেক্ট্রন একটি গোলক; কারণ, শূন্যস্থানে ইলেক্ট্রন সবদিকে সমান বল প্রয়োগ করে -দার্শনিকভাবে এটা একটা সঠিক বর্ণনা। অন্যদিকে, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ইলেক্ট্রন একটি আকারহীন কণা। কারণ, ইলেক্ট্রনের ওপর গবেষণালব্ধ তথ্য অনুসারে -আমাদের চতুর্মাত্রিক মহাবিশ্বে ইলেক্ট্রন একটি মাত্রাহীন কণা। এ দুটোর মধ্যে কোন বর্ণনাটি সঠিক? দর্শন নাকি বিজ্ঞানের? আমার মনে হয় না যে, বিজ্ঞান যে সঠিক এটা নিয়ে কোনো দ্বিমত আছে। বলে রাখা ভালো, কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে গ্রহণ না করার পেছনে আলবার্ট আইনস্টাইন “যুক্তি” দিয়েছিলেন, কিন্তু, কোনো “তথ্য” দেননি। অর্থাৎ, আইনস্টাইনের অস্বীকৃতির ভিত্তি ছিলো পুরাই দর্শন (অন্টোলজি)। পরবর্তীতে এক্সপেরিমেন্টাল “তথ্য” প্রমান করে যে, আইনস্টাইনের “যুক্তি” ভুল ছিলো (লজিক্যাল ফ্যালাসি ছাড়াই)। তাই, ওয়েইনবার্গ বা ডি-গ্রাস টাইসন কেন দর্শনকে ক্ষতিকর, বিভ্রান্তিকর বলেছেন সেটা সহজেই বোঝা যায়।

দর্শনের দুটি বড় সমস্যা হলো, প্রথমত -দর্শনের মাধ্যমে “জ্ঞান” প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কোনো জিনিসের সত্যতা (fact) যাচাই করা দর্শনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত -দর্শনের ভিত্তিগুলো যেমন “বাস্তবতা”, “বৈশিষ্ট্য”, ও “মূল্য” এগুলো মানব কেন্দ্রিক। অর্থাৎ, ভিনগ্রহের কোনো দার্শনিক কখনোই মানব দার্শনিক ভিত্তিগুলোর সাথে একমত হবে না। এমনকি, শিম্পাঞ্জিদের দর্শন (যদি থেকে থাকে) কখনোই মানব দর্শনের সমতুল্য হবে না। অন্যদিকে, বিজ্ঞান হলো ইউনিভার্সাল। যেমন -ইলেক্ট্রন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এবং ভিনগ্রহের বিজ্ঞানীদের ইলেক্ট্রন-জ্ঞান একই হতে বাধ্য।

এবার প্রশ্ন হলো, (যুক্তি -দর্শন ছাড়াই) শুধু তথ্য (বিজ্ঞান) ভিত্তিক চিন্তাধারা কিভাবে সম্ভব?

বিজ্ঞানের ভিত্তি তথ্য। আমরা বসাবাস করছি বিগ ডেটার যুগে। এই সময়টাতে দার্শনিক হবার চেয়ে বৈজ্ঞানিক হওয়াটা অনেক সহজ। শুধু বিজ্ঞানই নয়, অর্থনীতি থেকে রাষ্ট্রীয় নীতির সবকিছুই এখন তথ্য ভিত্তিক। বিগ ডেটার ব্যাপকতা এতো বেশি যে, মহাকাশের তথ্য পাওয়া জন্য টেলিস্কোপ ব্যবহার করার মতোই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য সিআইএ/এনএসএ-এর মতো সংগঠন ব্যবহার করে (একটা এক্সট্রিম উদাহরণ)। বলা যেতে পারে, পশ্চিমা দেশগুলো রাষ্ট্রীয় নীতি মূলত বিজ্ঞান ভিত্তিক, অন্তত, এদের কোনো ভাবেই দার্শনিক নীতি বলা বলা যায় না।

প্রাথমিকভাবে, তথ্য ভিত্তিক সিদ্ধান্ত দুইভাবে নেয়া যেতে পারে। পরিসংখ্যানের ভাষায় এদের বলে – inferential বনাম বেসিয়ান (bayesian)। দুটির মধ্যে পার্থক্য খুব সহজ -ধরুন আপনি একটি ক্যান্ডি-চকোলেটের দোকানে গেলেন, যেখানে ১০০ ধরণের ট্রিট রয়েছে। inferential পরিসংখ্যান অনুসারে, আপনাকে সব ধরণের ট্রিট একটু একটু করে খেয়ে দেখতে হবে। এরপর আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন কোন চকোলেটটি আপনার বেশি ভালো লেগেছে। inferential পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয় বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে, ব্যক্তি পর্যায়ে এর প্রয়োগ খুব কঠিন (একশো ধরণের চকোলেট এক বসায় খাওয়াটা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়!)। অন্যদিকে, বেসিয়ান মতে, আপনি দু-তিনটি ট্রিট খেয়ে দেখবেন এবং এদের মধ্যে একটিতে বেছে নেবেন। পরবর্তী কেনাকাটার সময় নতুন কিছু ট্রিট চেখে দেখবেন, যদি পছন্দ হয়, তবে নতুন চকোলেট পছন্দ করবেন। বেসিয়ান সিদ্ধান্ত নেবার ভিত্তি হলো -নতুন নতুন তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তের পুনর্মূল্যায়ন করা।

ব্যক্তি পর্যায়ে বেসিয়ান চিন্তাভাবনার আরেকটা উদহারণ হলো -কেউ যদি “ঈশ্বরবাদী” হয়, সেটা তার আয়ত্তাধীন তথ্যের প্রতিফলন। পরবর্তীতে যদি কোনো নতুন তথ্য সৃষ্টিতত্ত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়, সেক্ষেত্রে, ঐ ব্যক্তি তার বিশ্বাসকে “সন্দিহান” পর্যায় অবনমন করতে পারে। কিন্তু, এটাই শেষ কথা নয়। ভবিষ্যতে যদি আরো নতুন তথ্য যোগ হয়, যেটা সৃষ্টিতত্ত্বকে সমর্থন করে, তাহলে তার বিশ্বাসকে পুনরায় “ঈশ্বরবাদী” পর্যায়ে উন্নয়ন করা যেতে পারে। উল্টোভাবে, ভবিষ্যৎ তথ্য যদি সৃষ্টিতত্ত্বের বিপরীতে যায়, তাহলে “সন্দিহান” থেকে পুরোপুরি “নির্ধার্মিক” হওয়া যেতে পারে। মূল কথা হলো, দার্শনিক যুক্তিতর্ক আপনাকে একই বিশ্বাসে (ঈশ্বরবাদী বা নির্ধার্মিকতা) চিরকাল আটকে রাখবে; কিন্তু, বেসিয়ান প্রক্রিয়ায় আপনি যেকোনো সময় আপনার বিশ্বাস পরিবর্তন করতে পারেন।

বড় পরিসরে বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার একটা উদাহরণ হতে পারে -পররাষ্ট্র নীতি। কোল্ড-ওয়ারের সময় ভন নুম্যান (John von Neumann) পারমাণবিক আক্রমণ ও তার ফলাফল বিশ্লেষণে গেম-থিওরি ব্যবহার করেন। এই বিজ্ঞানভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতির ফসল হলো ম্যাড (mad = mutually assured destruction)। এরমানে হলো, (একে অন্যকে পাল্লা দিয়ে) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুজনই বিপুল পরিমানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে এবং নিজের পারমাণবিক আক্রমণের সক্ষমতা বড়াই করে বেড়াবে। কিন্তু, কোনো রাষ্ট্রই “প্রথম” পারমাণবিক আক্রমণ চালানোর সাহস পাবে না। নুম্যানের বিশ্লেষণ ছিলো নিখুঁত, বিশ্বের সিংগভাগ পারমাণবিক বোমা ও ওয়ার-হেড তৈরি করা হয় কোল্ড-ওয়ারের সময়; কিন্তু, এদের এটাও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়নি।

রোনাল্ড রেগান প্রশাসন গেম-থিওরিকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায়। সিআইএ-এর গোপন তথ্য অনুসারে, আশির দশকে সোভিয়েত অর্থনীতি ভেঙে পড়তে শুরু করে। সোভিয়েত পতন তরান্বিত করতে রেগান মার্কিন সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির ঘোষণা দেন, সেই সাথে স্টার-ওয়ার-এর মতো আজগুবি প্রজেক্টের কথাবার্তা শুরু করেন। যথারীতি, যুক্তরাষ্ট্রের ফাঁদে পা দেয় সোভিয়েত জান্তা, সামরিক খরচে পাল্লা দিতে গিয়ে নব্বই দশকে সোভিয়েত অর্থনীতি পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে যায় এবং সেই সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়।

সুতরাং, ব্যক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্র -তথ্যই যদি সবকিছুর ভিত্তি হয়, তাহলে যুক্তির ব্যবহারিক উপযোগিতা কোথায়? সম্ভবত নেই।