বিজ্ঞান একটি শক্তিশালী ইন্ডাকশন (induction) প্রক্রিয়া। ইন্ডাকশনের মানে হলো, সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ থেকে একটি সর্বজনীন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো (specific to general)। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইন্ডাকশনের এই সর্বজনীনতা (generalization) সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে; কিন্তু, এরমানে এই নয় যে ইন্ডাক্টিভ সিদ্ধান্ত (conclusion) ভুল। বিজ্ঞানের ইন্ডাক্টিভ বৈশিষ্ট্য এসেছে দর্শন থেকে; তবে, দর্শনের সব ইন্ডাকশন বৈজ্ঞানিক নয়।
কার্ল পপারের ফ্যালসিফিকেশন (Falsification) নীতির একটি অনুমান হলো ঠিক উল্টো -পপারের মতে বিজ্ঞান একটি ডিডাকশন (deduction) প্রক্রিয়া। ডিডাকশনের মানে হলো, একটি সর্বজনীন সিদ্ধান্ত থেকে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো (general to specific)। ডিডাকশনের সমস্যা হলো, সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত যদি ভুল প্রমাণিত হয় তবে সর্বজনীন সিদ্ধান্তও ভুল।
আমরা যতদূর জানি, বিজ্ঞান কখনোই ডিডাক্টিভ হতে পারে না। যেমন -বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টে প্রমাণিত যে, আইনস্টাইনের সাধারণ-আপেক্ষিকতা একটি “সঠিক” তত্ত্ব। সাধারণ আপেক্ষিকতা যদি ডিডাক্টিভ তত্ত্ব হতো, তাহলে স্থানকালের যেকোনো অবস্থাতেই তত্ত্বটি প্রযোজ্য হতে বাধ্য। কিন্তু, আমরা জানি -ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে সাধারণ-আপেক্ষিকতা ব্যবহার করা যায় না (এজন্য দরকার কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটি থিওরি)। সুতরাং, ডিডাকশন অনুসারে সাধারণ-আপেক্ষিকতা পুরোপুরি “ভুল”। সৌভাগ্যের বিষয় হলো -বিজ্ঞান যেহেতু ইনডাকশন, তাই কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটি থিওরি না হলেও সাধারণ-আপেক্ষিকতা একটি সঠিক তত্ত্ব। বিজ্ঞানের সব তত্ত্বই বিভিন্ন পর্যায়ের approximation। যেমন -নিউটনের ইউনিভার্সাল-গ্র্যাভিটেশন তত্ত্বটিও সঠিক; তবে, আইনস্টাইনের তুলনায় কম approximate।
বিজ্ঞান যেমন শুধুই ইনডাকশন, অনেক তত্ত্বই আছে যেগুলো শুধুই ডিডাকশন। সব সৃষ্টিতত্ত্বই ডিডাক্টিভ ধর্মী। শত চেষ্টা করলেও, ইনডাকশন থেকে সৃষ্টিতত্ত্বের সর্বজনীন সিদ্ধান্তে (যেমন -স্রষ্টা বা higher purpose-এর অস্তিত্ব) পৌঁছানো সম্ভব নয়। উদাহরণ -প্রাণীজগতের বৈচিত্র্যতার ওপর গবেষণা করলে সরাসরি বিবর্তনের দিকে পৌঁছুতে হবে (স্রষ্টার দিকে নয়)। কিংবা, মহাবিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি ইঙ্গিত দেয় বিং-ব্যাং -এর দিকে (higher purpose -এর দিকে নয়)। এজন্যই, সৃষ্টিতত্ত্বে প্রথমেই “স্রষ্টা” বা “higher purpose”-এর অস্তিত্বকে সর্বজনীন ধরে নিতে হয়, এবং সেখান থেকে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে হয় (যেমন -প্রাণীজগতের বৈচিত্র্যতা এসেছে কোনো বুদ্ধিমান মহাসত্তা থেকে)। সমস্যা হলো, ডিডাকশনে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত ভুল মানে পুরো সর্বজনীনতাই ভুল। তাই, সর্বজনীন সিদ্ধান্ত ভুল প্রমান করে এমন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত (যেমন -বিবর্তন) গ্রহণ করা সৃষ্টিতত্ত্বের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্যই বিজ্ঞান ও ধর্ম একসাথে মেশে না, এবং (cognitive dissonance -ছাড়া) কোনো ধার্মিকের পক্ষে বিবর্তন গ্রহণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং, (কার্ল পপারের) বিজ্ঞানকে ডিডাকশন দাবি করাটা অনেকটা তেল ও জল দুটোই একই জিনিস দাবি মতো ব্যাপার।
ফ্যালসিফিকেশন নীতি প্রস্তাবের পেছনে পপারের আরেকটি অনুমান ছিলো যে -মানুষ স্বভাবতই পক্ষপাতদুষ্ট (বায়াস), তাই কোনো গবেষণার সময় বিজ্ঞানীরা মনে মনে কিছু তত্ত্বকে সত্য বলে ধরে নেন -অর্থাৎ, পপারের দাবি -বিজ্ঞানীরা যে তত্ত্ব পরীক্ষা করেন করেন সেটা আসলে কোনো সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব, নয় বরং অনেকগুলো তত্ত্বের সমষ্টি। বিজ্ঞান যেহেতু সমালোচনা ধর্মী (critical), তাই পপার ধারণা দিয়েছিলেন যে, গবেষণার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের এই আগাম (prior) অনুমানগুলোকেও সঠিক যুক্তি-কাঠমোর মধ্যে আনা দরকার। এজন্যই, ফ্যালসিফিকেশন নীতিতে সব বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই সর্বজনীন ধরা হয়। এবং, পর্যবেক্ষণে ভুল প্রমাণিত হলে পুরো তত্ত্বই ভুল। বিজ্ঞানের ক্রিটিক্যালিটি ও বিজ্ঞানীদের উপরোক্ত পক্ষপাতদুষ্টতাই ছিল পপারের বৈজ্ঞানিক ডিডাকশনিজম প্রস্তাবের মূল কারণ।
প্রথমত- বিজ্ঞানে কোনো সর্বজনীন তত্ত্ব নেই, অন্তত আজো পাওয়া যায়নি। (আগেই বলা হয়েছে) বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো বিভিন্ন স্তরের approximation। TOE (theory of everything)-এর মতো সর্বজনীন তত্ত্ব এখনো বিজ্ঞানীদের ধরাছোঁয়ার বাহিরে। শুধু তাই নয়, এ ধরণের তত্ত্ব আদৌ সম্ভব কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
দ্বিতীয়ত- কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব (যতই approximate হোক না কেন) যখন প্রমাণিত হয়, তখন আমরা “জ্ঞান” অর্জন করি। বিজ্ঞানের অবদান হলো “জ্ঞান” প্রতিষ্ঠা করা (epistemology)। তাই, কোনো গবেষণায় বিজ্ঞানীরা যখন কোনো তত্ত্বকে অনস্বীকার্য (সত্য) ধরে নেন, এর মানে হলো, গবেষণায় “বিদ্যমান(existing) জ্ঞান” সংযুক্ত করা। এবং গবেষণায় “বিদ্যমান জ্ঞান” যোগ করাটা পক্ষপাতদুষ্টতা না। সুতরাং, ফ্যালসিফিকেশন নীতির পেছনে যে পক্ষপাতদুষ্টতার যে দাবি করা হয়েছে তার কোনো ভিত্তি নেই। বরং উল্টো, যে সব পক্ষপাতদুষ্টতার বিজ্ঞানের “ক্রিটিক্যালটি”-এর জন্য হুমকি তার কোনোটাই পপার বিবেচনা করেননি।
গবেষণার ক্ষেত্রে যে ধরনের পক্ষপাতদুষ্টতা দেখা যায়, সেটা হলো ডেটার “সুবিধাজনকভাব” ব্যবহার (পি-হ্যাকিং/ডেটা-ড্রেজিং), যার উৎস একাডেমিক প্রণোদনা। একাডেমিক ক্যারিয়ার টিকিয়ে রাখার জন্য গবেষকদের একের পর এক গবেষণাপত্র বের করতে হয়; শুধু প্রকাশ করলেই চলে না, গবেষণার বিষয় হতে হয় “হট-টপিক”। এই প্রতিষ্ঠানিক চাপ সমসাময়িক গবেষণাগুলোতে পি-হ্যাকিং -এর জন্য দায়ী (বিস্তারিত “Rigor Mortis”by Richard F. Harris)। অর্থাৎ, এই পক্ষপাতদুষ্টতা প্রতিষ্ঠানগত, ব্যক্তি পর্যায়ে নয়।
অন্যদিকে, মানবীয় পক্ষপাতদুষ্টতার ওপর উল্লেখ করার মতো গবেষণা করেছেন ডেনিয়েল কার্নম্যান ও এমোস ট্রেভস্কি। কার্নম্যান ও ট্রেভস্কির মতে, মানুষের মস্তিস্ক দুইভাবে সিদ্ধান্তে (decision) পৌঁছাতে পারে, প্রথমটি হলো: কগনেটিভ-বায়াস (বিদ্যমান প্যাটার্ন অনুসরণ করা) ও হুরেসটিক্স (heuristics, rule-of-thumb ব্যবহার করা)। দ্বিতীয়টি হলো: বিশ্লেষণ (analytics) -এক্ষেত্রে মস্তিস্ক হিসাবনিকাশ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কার্নম্যানের ভাষায়, প্রথমটি- “সিস্টেম-১” (fast thinking) ও পরেরটি- “সিস্টেম-২” (slow thinking) চিন্তাধারা।
যেহেতু হিসাবনিকাশ করতে হয় না, তাই সিস্টেম-১ মস্তিষ্কের জন্য খুব সহজ এবং একটি কাজ করে খুব দ্রুত। জীবন-মরণ পরিস্থিতিতে সিস্টেম-১ অত্যাবশ্যক। কিন্তু, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সিস্টেম-১ -এর ফসল হলো পদ্ধতিগত ত্রুটি (systematic error)। মানে হলো, একেকটি কগনেটিভ-বায়াস একেক রকমের সিদ্ধান্তগত ভুল তৈরি করে।। সাইকোলজিতে কগনেটিভ-বায়াস, হুরেসটিক্স এবং এদের ত্রুটিদের ওপর যথেষ্ট গবেষণা হয়েছে (হচ্ছে)। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পক্ষপাতদুষ্টতার জন্য দায়ী এই সিস্টেম-১ চিন্তাভাবনা। মানুষ খুব অল্প সময়ই সিস্টেম-২ ব্যবহার করে। এজন্যই দাবি করা হয় যে, মানুষ স্বভাবতই rational প্রাণী নয়। বিহেভিওরাল ইকোনমিক্স ও ডিসিশন মেকিং শাখায় কার্নম্যান ও ট্রেভস্কির উপরোক্ত গবেষণার ব্যাপক ব্যবহার আছে। কার্নম্যানের মতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সিস্টেম-২ নিযুক্ত করার উপায় হলো পরিসংখ্যান ব্যবহার করা (statistical thinking)। আমি আগের পোস্টে বলেছিলাম, বেসিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্সের কথা। বেসিয়ান ডিসিশন-মেকিং প্ৰক্ৰিয়া একটি সিস্টেম-২ প্ৰক্ৰিয়া।
মজার ব্যাপার হলো, কিছু কিছু বিশ্লেষণ ধর্মী লজিক্যাল চিন্তাভাবনার (তবে সব লজিক/যুক্তি নয়) পূর্বশর্ত হলো সিস্টেম-২ প্রয়োগ করা (কগনেটিভ-বায়াস মুক্ত হওয়া )। যে ব্যক্তি কগনেটিভ-বায়াস মুক্ত নয় তার পক্ষে লজিক্যাল-ফ্যালাসি এড়ানো অসম্ভব। এরমানে এই না যে, লজিক্যাল ফ্যালাসি ও কগনেটিভ বায়াস একই জিনিস। ব্যাপার হলো, অনেক ক্ষেত্রেই সিস্টেম-১ চিন্তাধারা দিয়েও যুক্তিবাদী বিতর্ক করা সম্ভব। তাই, কোনো যুক্তি দেয়ার আগে যাচাই করা উচিত এর পেছনে কোনো কগনেটিভ-বায়াস আছে কিনা।
আপনি যদি ডেটা ভিত্তিক চিন্তাভাবনা করতে পারেন, তবে আপনি নিশ্চিত rational। এবং, একজন rational ব্যক্তি ধারাবাহিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। অন্যদিকে, শুধু লজিকাল ফ্যালাসির ভিত্তিক চিন্তাভাবনা করলে, কোনো ব্যক্তি হয়তো লজিক্যাল হতে পারেন; কিন্তু, কগনেটিভ-বায়াসের কারণে উনি rational নাও হতে পারেন।