ম্যাস-এক্সটিঙ্কশন

পার্মিয়ান-ম্যাস-এক্সটিঙ্কশন ছিলো পৃথিবীর জীবনকালে তৃতীয় ও সবচেয়ে ভয়াবহ বিলুপ্তির ইতিহাস। এটা পার্মিয়ান-ট্রায়াসিক-ইভেন্ট নামেও পরিচিত। বিলুপ্তিটি ঘটে প্রায় ২৫১ মিলিয়ন বছর আগে, তখন পৃথিবীর বয়স ছিলো চার বিলিয়নের একটু বেশি। পার্মিয়ান বিলুপ্তিকালের ব্যাপ্তি ছিলো প্রায় ৮০ হাজার বছর এবং এই সময়টিতে পৃথিবীর সমস্ত জীবজগতের প্রায় ৯৫% প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে। এখানে পৃথিবীর ৯৫% গাছপালা ও প্রাণীদের মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে না। এই ৯৫% হলো প্রজাতি বা জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি। অর্থাৎ, এই হারিয়ে যাওয়া প্রজাতিগুলোকে আর কখনোই ফিরে পাওয়া যাবে নয়। পার্মিয়ান-ম্যাস-এক্সটিঙ্কশনের কারণ ও ঘটনার ধারাবাহিকতা মোটামুটি পরিষ্কার, এই বিপর্যয়টি হয় তিনটি ধাপে।

ছবি ১: ভূতাত্ত্বিক সময়ের ব্যাপ্তি।

পার্মিয়ান সময়টাতে পৃথিবীর সব মহাদেশ একসাথে ছিলো, যার নাম প্যানঞ্জিয়া। ম্যাস-এক্সটিঙ্কশন শুরু হয় দক্ষিণ সাইবেরিয়ার নোরিলস্ক অঞ্চলের (যেটা সাইবেরিয়ান-ট্রাপ নামে পরিচিত) ভয়াবহ অগ্নুৎপাত থেকে, সময়টা পার্মিয়ানের শেষের দিকে। এই অগ্ন্যুৎপাতে ম্যাগমার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণের সালফারডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেনঅক্সাইড, ও কার্বনডাইঅক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে যায়। অক্সাইডগুলোর যথাক্রমে সালফিউরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড, ও কিছু কার্বনিক অ্যাসিড হিসেবে বৃষ্টির সাথে নেমে আসে। এই অ্যাসিড বৃষ্টি প্যানঞ্জিয়ার বিশাল বনাঞ্চল ধ্বংস করে দেয়। গাছপালার অভাবে প্যানঞ্জিয়ার অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর গতিপথ এলোমেলো হয়ে যায়, ধীরে ধীরে নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে ফেলে। ফলে, প্রথমেই নদীর ওপর নির্ভরশীল জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি শুরু হয়।

ছবি ২: প্যানঞ্জিয়া, পার্মিয়ান সময়কালের অতিকায় মহাদেশ।

পাশাপাশি, বায়ুমণ্ডলে রয়ে যাওয়া কার্বনডাইঅক্সাইড পুরো পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় ৮ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বাড়িয়ে দেয়। অ্যাসিড বৃষ্টির পরপরই শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী অনাবৃষ্টি ও শুষ্ক আবহাওয়া। ক্ষতিগ্রস্ত বনাঞ্চল পুনুরুদ্ধার তো দূরের ব্যাপার, জলবায়ুর এই পরিবর্তনের জন্য উল্টো বাকি বনাঞ্চলও বিলীন হতে শুরু করে। প্যানঞ্জিয়ার এই ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে প্রায় ৪০ হাজার বছর ধরে। এই সময়টাতে পৃথিবীর স্থলভাগের বেশিরভাগ উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এরপর সমুদ্রের পালা। পার্মিয়ান সমুদ্র (বা মহাসাগরের) নাম টেথিস। কার্বনডাইঅক্সাইড জনিত  গ্রীনহাউজের সামুদ্রিক প্রতিক্রিয়া একটু ভিন্ন। সমুদ্রপৃষ্ঠ বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে থাকে, তাই অক্সিজেন সমুদ্রপৃষ্ঠের পানিতে দ্রবীভূত হবার সুযোগ পায়। এই অক্সিজেন বহনকারী পানি পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর শীতল আবহাওয়ায় ঠান্ডা ও ভারী হয়ে গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যায়, যা গভীর সমুদ্রে বসবাসকারী প্রাণীদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য।

সমুদ্রের অক্সিজেন সঞ্চালন একটি  চক্রাকার প্ৰক্ৰিয়া, অনেকটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কনভেয়ার-বেল্টের মতো, যার কার্যকারিতা নির্ভর করে দুটো জিনিসের ওপর: বায়ুমণ্ডলীয় অক্সিজেনের পরিমাণ ও বিষুব-মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রার পার্থক্য। গভীর সমুদ্রের স্বল্প অক্সিজেনযুক্ত পানি বিষুবীয় অঞ্চলের উষ্ণ আবহাওয়ার প্রভাবে গরম ও হাল্কা হয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠে ভেসে ওঠে। ফলে, এই পানি অক্সিজেন দ্রবীভূত করার সুযোগ পায়, একই সাথে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণ স্রোতের টানে মেরু অঞ্চলে গিয়ে তলিয়ে যায়। অন্যদিকে, অক্সিজেন নিয়ে মেরুতে তলিয়ে যাওয়া পানি গভীর সামুদ্রিক শীতল স্রোতের সাথে বিষুবীয় অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছে, উষ্ণ হয়ে আবার সমুদ্রপৃষ্টে ভেসে ওঠে।

ছবি ৩: ইন্ডাস্ট্রিয়াল কনভেয়ার-বেল্টের মতো সামুদ্রিক স্রোতের গতিপথ, যেটা গভীর সমুদ্রে অক্সিজেন পৌঁছাতে সাহায্য করে।
ছবি ৪: বর্তমান উষ্ণ ও শীতল স্রোতের গতিপথ। বৈশ্বিক উষ্ণতা এই গতিপথ বিঘ্নিত করবে।

অক্সিজেনের পাশাপাশি সাইবেরিয়ান-ট্রাপের অগ্ন্যুৎপাতে নির্গত বিপুল পরিমাণ কার্বনডাইঅক্সাইড টেথিস সমুদ্রের পানিতে মিশতে থাকে। এতে সমুদ্রের পানিতে কার্বনডাইঅক্সাইডের সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে। সমস্যা হলো, পানিতে কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে ক্যালসিয়াম-কার্বোনেটের পরিমাণ কমে যায়। সামুদ্রিক শামুক, ঝিনুক ইত্যাদিরা তাদের খোলস বানানোর জন্য এই ক্যালসিয়াম-কার্বোনেটের ওপর নির্ভর করে। ফলে, বিলুপ্তিকরণের প্রথম দিকেই টেথিসে খোলসযুক্ত প্রাণীদের বিলুপ্তি শুরু হয়। প্রায় পাঁচ হাজার বছর সময় লাগে টেথিসের প্রবলপ্রাচীর পুরোপুরি ধসে যেতে।

অন্যদিকে, ৮ডিগ্রী বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর প্রভাবে তাপমাত্রার পার্থক্য নির্ভর সামুদ্রিক অক্সিজেন সঞ্চালন প্রক্রিয়াও একসময় থেমে যায়। ফলে, গভীর সুমদ্রে অক্সিজেন শূন্যতা তৈরি হতে থাকে এবং সেখানকার জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্ত হতে শুরু করে।

টেথিস ও প্যানঞ্জিয়ার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের পজিটিভ-ফিডব্যাক। মিথেন একটি অত্যন্ত কার্যকর গ্রিনহাউজ গ্যাস, এর কার্যকারিতা কার্বনডাইঅক্সাইডের চেয়েও তিরিশ গুণ বেশি। ধারণা করা হয় যে, পৃথিবীতে যত পরিমাণ কয়লা ও পেট্রোলিয়ামের আছে তারচেয়েও বেশি পরিমাণের মিথেন সমুদ্রগর্ভে মিথেন-ক্ল্যাথোরেট  বা মিথেন-হাইড্রেট হিসেবে জমা আছে।

ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্রপৃষ্ঠ পৃথিবীর বহিস্থ খোলসের অংশ। এই খোলস কঠিন ও পাথুরে, এর আনুষ্ঠানিক নাম টেক্টনিক-প্লেট। টেক্টনিক-প্লেট দুই ধরণের হতে পারে: ভারী ব্যাসল্ট পাথরের তৈরি ওসিয়ানিক-প্লেট যেটা সমুদ্রপৃষ্ঠ তৈরি করে। অন্যটি অপেক্ষাকৃত হাল্কা গ্রানাইটের তৈরি কন্টিনেন্টাল-প্লেট যেটা স্থলভাগ বা মহাদেশ তৈরি করে। পৃথিবীর খোলস একাধিক চলনশীল ওসিয়ানিক-প্লেট ও কন্টিনেন্টাল-প্লেট দিয়ে গঠিত। এই টেক্টনিক-প্লেটগুলোর মিলনস্থলকে বলে ভূতাত্ত্বিক ফল্টলাইন। এই ফল্টলাইনগুলোর পরিণতি কেমন হতে পারে সেটা নির্ভর করে, কি ধরণের টেক্টনিক-প্লেট কিভাবে মিলিত হচ্ছে এই দুইয়ের ওপর। যেমনঃ টেক্টনিক-প্লেট দুটো যদি কন্টিনেন্টাল-প্লেট হয় এবং তাদের মিলন যদি মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়, তবে কন্টিনেন্টাল-প্লেট  দুটি একইসাথে উপর দিকে ওঠে এবং পর্বতমালা তৈরি করে। ঠিক এভাবেই, ইন্ডিয়ান-প্লেট ও ইউরেশিয়ান-প্লেটের সংঘর্ষে হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্ট হয়। অন্যদিকে, টেক্টনিক-প্লেট দুটোর একটি যদি কন্টিনেন্টাল-প্লেট ও অন্যটি যদি ওসিয়ানিক-প্লেট হয় তাহলে ওসিয়ানিক-প্লেট পৃথিবীর অর্ধগলিত ম্যান্টেলে তলিয়ে যায় এবং কন্টিনেন্টাল-প্লেট হাল্কা হবার কারণে ওসিয়ানিক-প্লেটের ওপর উঠে যায়, ফলে ফল্টলাইন বরাবর গভীর সামুদ্রিক গিরিখাতের সৃষ্টি হয়।

ছবি ৫: ওসিয়ানিক-প্লেট ও কন্টিনেন্টাল-প্লেটের মুখোমুখি সংঘর্ষ। ফলাফল, গভীর সামুদ্রিক গিরিখাত।

আমরা যে মিথেন-ক্ল্যাথোরেটের কথা বলেছিলাম, সেটা জমা হয় এই কন্টিনেন্টাল-প্লেট ও ওসিয়ানিক-প্লেটের ফল্টলাইনে। মিথেন-ক্ল্যাথোরেট মূলত বরফের তৈরি অস্থিতিশীল কঠিন কাঠামো। বরফের তৈরি বলে এটা তাপমাত্রা প্রতি সংবেদনশীল। অর্থাৎ, সমুদ্রের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেলে এই বরফের গলে গিয়ে মিথেন গ্যাস হিসেবে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে।

ছবি ৬: মিথেন ভূপৃষ্ঠে বরফ বা পার্মাফ্রস্টে আটকে যায়। ধীরে ধীরে কন্টিনেন্টাল-প্লেটের সরণের মাধ্যমে সমুদ্রগর্ভে গিয়ে জমা হতে থাকে।

পার্মিয়ান-ম্যাস-এক্সটিঙ্কশনের শেষের ৪০ হাজার বছর পর্যন্ত এই গ্রীনহাউজ পজিটিভ-ফিডব্যাক চলতে থাকে। কার্বনডাইঅক্সাইডের কারণে বেড়ে যাওয়া ৮ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড ধীরে ধীরে টেথিসকে উষ্ণ করে, ফলে অস্থিতিশীল মিথেন-হাইড্রেট ভেঙে মিথেন বেরিয়ে আসে। কিন্তু, এখানেই পজিটিভ-ফিডব্যাক শেষ নয়। যেহেতু মিথেন একটি দাহ্য গ্যাস, তাই মুক্ত মিথেন বায়ুমণ্ডলীয় অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয় এবং কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এই মিথেন নিঃসরণের কারণে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা আরো ৮ডিগ্রী বেড়ে যায়।

যাহোক, কার্বনডাইঅক্সাইডের এই অভিশাপ শেষ হয় ৮০ হাজার বছরে এবং পরিত্রাণ পেতে সময় লাগে আরো তিরিশ মিলিয়ন বছর। অর্থাৎ, পার্মিয়ান-ম্যাস-এক্সটিঙ্কশন শেষ হবার আরো তিরিশ মিলিয়ন বছর পর, ট্রায়াসিকের মাঝামাঝিতে পৃথিবীতে নতুন উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল থেকে নতুন বায়োস্ফিয়ার গড়ে ওঠে।

এবার আসা যাক বর্তমানে, পৃথিবীর সাত বিলিয়ন এবং ক্রমবর্ধমান মানব জনগোষ্ঠী যে গতিতে বনজ সম্পদ নিধন করছে সেটাকে পার্মিয়ান অ্যাসিড বৃষ্টির সাথে তুলনা করলে হয়তো খুব একটা ভুল হবে না। অন্যদিকে এক হিসাবে অনুসারে, ১ ট্রিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা (১.৭ ± ০.৪) ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেড বাড়াতে পারে এবং শিল্পায়নেয় বদৌলতে মানব নিঃসরিত কার্বনের পরিমাণ প্রতি বছর প্রায় দশ বিলিয়ন টন। সংখ্যাটা বেশি বলে মনে না হলেও, জেনে রাখা ভালো যে: পার্মিয়ন-ম্যাস-এক্সটিঙ্কশন ঘটেছিলো মাত্র ৮ডিগ্রী তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য এবং এই তাপমাত্রায় পৌঁছাতে প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন টন বায়ুমণ্ডলীয় কার্বনই যথেষ্ট। বলাই বাহুল্য যে, মানুষ কার্বনের চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী বিভিন্ন প্রকার গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে।

স্টিভেন-পিঙ্কার তার বই Enlightenment Now: The Case for Reason, Science, Humanism, and Progress তে লিখেছেন: ২০১৭ পর্যন্ত, এনথ্রোপোজেনিক-গ্লোবাল-ওয়ার্মিং বা মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা ওপর সুনির্দিষ্টভাবে ৬৯,৪০৬টি পিয়ার-রিভিউড সায়েন্টিফিক আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। এরমধ্যে মাত্র চারটি ছিলো বিপক্ষে। অর্থাৎ, ঐ চারটি আর্টিকেলের দাবি ছিলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মানব সৃষ্ট নয়। কিন্তু, আর্টিকেল চারটির কোনোটাই তাদের দাবির স্বপক্ষে সন্তোষজনক সাক্ষপ্রমাণ উপস্থাপন করেনি। এটা এই ইঙ্গিত করে যে, মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়টা নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে কোনো মতানৈক্য নেই।

প্রশ্ন হলো, পার্মিয়ান বিলুপ্তির কারণ নিয়ে যদি কোনো সন্দেহ না থাকে, সেই সাথে মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও বনাঞ্চল উজারিকরণ নিয়ে যদি মতানৈক্য না থাকে, তাহলে মানুষ কেন আরেকটি নিশ্চিত ম্যাস-এক্সটিঙ্কশন এড়ানোতে যথেষ্ট উদ্যোগী নয়? (এলিজাবেথ-কোলবার্টের ভাষায় সিক্সথ-এক্সটিঙ্কশন)

স্টিভেন-পিঙ্কার বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা সমস্যাটা রাজনৈতিকভাবে স্ট্র্যাজেডি-অফ-কমনের মতো, যেখানে ফ্রি-রাইডিংয়ের সম্ভাবনা প্রবল। অর্থাৎ, কার্বন নিঃসরণ বন্ধে কোনো না কোনো দেশকে উন্নয়নে ছাড় দিতে হবে, এই সুযোগে অন্য কিছু দেশ হয়তো শিল্পায়নের চাকা আরো জোরে ঘোরাতে শুরু করবে। এই ছাড়-দেয়া বনাম সুযোগ-নেওয়া একটা কঠিন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। কিন্তু, এই দ্বন্দ্ব একটি কঠিন বাস্তবতাকে এড়িয়ে যায়। পার্মিয়ান-ম্যাস-এক্সটিঙ্কশনে পৃথিবীর প্রায় ৯৫% প্রজাতি বিলুপ্ত হয়। অর্থাৎ, বিলুপ্তি হয় আস্ত প্রজাতির এবং তার প্রতিটি সদস্যের। কোনো প্রজাতির বেশিভাগ জনগাষ্ঠীর অন্তৰ্ধানকে বিলুপ্তি বোঝায় না। এরমানে হলো, সিক্সথ-এক্সটিঙ্কশনে যদি মানুষ বিলুপ্ত হয় তবে পুরো মানব প্রজাতিই বিলুপ্ত হবে, কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা জাতি নয়। অথচ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব দেখে মনে হয় যেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ফলে কিছু মানবগোষ্ঠী কষ্ট পাবে আর বাকিদের কিছুই হবে না! এটাতো  বিলুপ্তির সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। যতোই কতৃত্বমনস্ক হোক না কেন, এটা মানব মস্তিষ্কের কল্পনার বাহিরে যে: মানুষ একটি প্রজাতি এবং এই প্রজাতিটি যেকোনো সময় পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হতে পারে।

প্রভাবশালী প্রজাতিদেরও যে বিলুপ্তি ঘটে পারে তার আরেকটা বাস্তব উদাহরণ দেয়া যাক। ট্রায়াসিক সময়কালের শেষে দিকে ডাইনোসর ও স্তন্যপায়ী প্রজাতির আবির্ভাব ঘটে। এই সময়টাতে ডাইনোসর বা  স্তন্যপায়ী কোনোটাই পৃথিবীর বায়োস্ফিয়ারে প্রভাবশালী ছিলো না। ট্রায়াসিক শেষ হয় আরেকটি বিলুপ্তিকরণ ঘটনার মাধ্যমে, যেটা ফোর্থ-এক্সটিঙ্কশন বা ট্রায়াসিক-জুরাসিক-ম্যাস-এক্সটিঙ্কশন নাম পরিচিত। ট্রায়াসিকের শেষের দিকে ভূগর্ভস্থ ম্যাগমার চাপে প্যানঞ্জিয়া ভেঙে যেতে শুরু করে। কন্টিনেন্টাল-প্লেটের সরণের কারণে ধীরে ধীরে লরেশিয়া (ইউরেশিয়া ও নর্থ-আমেরিকান কন্টিনেন্টাল-প্লেট যৌথভাবে) ও গোন্ডোয়ানা (বাকি কন্টিনেন্টাল-প্লেটগুলো একসাথে) মাঝে দুরুত্ব বাড়তে থাকে, যেটা পরবর্তীতে আটলান্টিক মহাসাগরের জন্ম দেয়। এই ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন ব্যাপক অগ্নুৎপাত ঘটায়, যেটা পরবর্তী CAMP (Central Atlantic Magmatic Province) তৈরি করে।

ছবি ৭: তিনটি ম্যাস-এক্সটিঙ্কশনের জন্য দায়ী অগ্নুৎপাতের স্থল। পার্মিয়ান: সাইবেরিয়ান-ট্রাপ, ট্রায়াসিক-জুরাসিক: CAMP, ক্রেটাসাস: ডেকান-ট্রাপ।

এই CAMP কার্যালাপ কিভাবে ট্রায়াসিক-জুরাসিক-ম্যাস-এক্সটিঙ্কশন ঘটায় তার বিস্তারিত এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। তবে, এই বিলুপ্তিকরণ পরপরই ডাইনোসরেরা প্রভাবশালী প্রাণী হিসাবে আবির্ভুত হয়। পরবর্তী দুই সময়কাল, জুরাসিক ও ক্রেটাসাসে ডাইনোসরদের চালাঞ্জ করার মতো কোনো প্রাণীই ছিলো না। ডাইনোসরদের দৌরাত্বে স্তন্যপায়ীরা লুকিয়ে ছাপিয়ে কোনোভাবে টিকে ছিলো। টাইমমেশিনে করে যদি জুরাসিক পৃথিবীতে যাওয়া যেতো, তাহলে যতদূর দৃষ্টি যেতো সবখানেই ডাইনোসর, শুধুই ডাইনোসর পাওয়া যেতো। স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, ও অন্যান্যদের খুঁজতে পাওয়াটাই হতো কষ্ট। এই প্রতাপশালী ডাইনোসর প্রজাতিগুলো যে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে সেটা হয়তো কল্পনাই করা যেতো না।

ডাইনোসরদের বিলুপ্তি ঘটে ক্রেটাসাস-পেলিওজিন-ম্যাস-এক্সটিঙ্কশনের মাধ্যমে, এর অন্য নাম ক্রেটাসাস-টারশিয়ারি বা K-T ইভেন্ট বা ফিফ্থ-এক্সটিঙ্কশন। এই বিলুপ্তিকরণ পার্মিয়ানের মতোই পরিষ্কার ঘটনা। আজ থেকে প্রায় ৬৫.৫ মিলিয়ন বছর আগে, প্রায় ছয় মাইল ব্যাসের একটি গ্রহাণু মেক্সিকোর ইউক্যাটান উপসাগরে আছড়ে পড়ে।

শুরুতেই দুটি তুলোনা দেয়া যাক, মাউন্ট-এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫.৫ মাইল, কিন্তু ঐ গ্রহাণু ছিলো আকারে মাউন্ট-এভারেস্টের চেয়েও আধা মাইল বড়। এর আঘাতে প্রায় (৬.২ x ১০^৭) টন টিএনটি সমপরিমাণের শক্তি বেরিয়ে যায়। মানুষের তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা ছিলো সাবেক সোভিয়েত-উনিয়নের তৈরি জার্ বোমা, যার ক্ষমতা ছিলো ৫০ মিলিয়ন টন টিএনটি। ঐ গ্রহাণুর সমপরিমাণ শক্তি পেতে হলে দুই মিলিয়ন জার্ বোমার এক সাথে বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে। গ্রহাণুটি আঘাতে প্রায় ১১২ মাইল চাওড়া গর্ত তৈরি হয়, যার নাম চিক্সজুল্যাব ক্রেটার। গ্রহাণুর আঘাতে নির্গত শক্তি নিমিষেই প্রায় ৬২ কিউবিক-কিলোমিটার পাথর বাষ্পীভূত করে ফেলে এবং তীব্র ভূকম্পনের কারণে পুরো পৃথিবীই ধাতব টেবিল-ঘন্টার মতো বাঁজতে থাকে। গ্রহাণুটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রী কোণে। আরেকটু অল্প কোণে প্রবেশ করলে গ্রহাণুটি হয়তো পৃথিবীতে আছড়ে পড়তো না, সেক্ষেত্রে হয়তো ডাইনোসরেরা এখনো টিকে থাকতো।

ছবি ৮: পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সময় প্রবেশ কোণ কম হলে পানিতে আড়াআড়িভাবে ছোড়া চ্যাপ্টা পাথরের মতোই লাফিয়ে গ্রহাণু বায়ুমণ্ডল থেকে বেরিয়ে যায়।

যারা প্রাথমিক আঘাত থেকে বেঁচে যায়, তাদের মুখোমুখি হতে হয় পৃথিবীর ৬০০ মিলিয়ন বছর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সুনামির সাথে। পাশাপাশি, তীব্র তাপে বাতাসের অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পুড়ে নাইট্রোজেনঅক্সাইডে তৈরি করে, যা অ্যাসিড বৃষ্টির আকারে উদ্ভিদকুলের বিনাশ করে। সেইসাথে, বিপুল পরিমাণ চুনাপাথর বাষ্পীভূত হয়, যা বাতাসে পুড়ে কার্বনডাইঅক্সাইড উৎপন্ন করে। কয়েক মিলিয়ন টন অতিসূক্ষ ধূলিকণা বায়ুমণ্ডলে ভেসে বেড়ায় কয়েক মাস ধরে এবং সূর্যালো মহাশূন্যে প্রতিফলিত করতে থাকে। ফলে, পৃথিবী শীতল হতে শুরু করে, শুরু হয় ক্রেটাসাস-নিউক্লিয়ার-শীতকাল।

এই গ্রহাণুর আঘাতের পাশাপাশি ভারতীয় ডেকান-ট্রাপ অঞ্চলের অগ্নুৎপাতও ক্রেটাসাস-পেলিওজিন-ম্যাস-এক্সটিঙ্কশনের বিপর্যয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় (ছবি ৭)। এই বিপর্যয়ে প্রায় ৫০% স্থলজ ও ৮০-৯০% জলজ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়। স্থলজ প্রজাতিদের মধ্যে যাদের ওজন ২৫ কেজির বেশি ছিলো, তাদের মধ্যে কিছু সরীসৃপ বাদে বাকি সবাই বিলুপ্ত হয়। ডাইনোসরের মধ্যে বেঁচে যায় শুধু তারাই, যারা আকারে ছোট ছিলো সেই সাথে যারা উড়তে পারতো, যাদের থেকে পাখিদের উদ্ভব ঘটে। স্তন্যপায়ীরা তখনও আকারে ছিলো ছোট এবং ডাইনোসরদের ভয়ে সর্বভূকের মতো জীবনধারণ করতো। সম্ভবত, এমন খাদ্যাভ্যাসই ছিলো এই কঠিন সময়টাতে স্তন্যপায়ীদের টিকে থাকার রহস্য।

যদিও গুণগত দিক থেকে মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতার সাথে ছয় মাইল গ্রহাণুর আঘাতের পার্থক্য আছে, তবুও ক্রেটাসাস-পেলিওজিন-ম্যাস-এক্সটিঙ্কশনের শিক্ষণীয় বিষয় হলো: বায়োস্ফিয়ারের ওপর পূর্ণ কতৃত্ব কোনো প্রজাতির টিকে থাকার নিশ্চয়তা দেয় না। ডাইনোসরেরা বহু মিলিয়ন বছর ধরে জলে, স্থলে, আকাশে পৃথিবীর পুরো বায়োস্ফিয়ারকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলো। ডাইনোসরদের প্রজাতিগত বৈচিত্র্যতা ছিলো ব্যাপক। অথচ, ম্যাস-এক্সটিঙ্কশনের সময় পাখিদের পূর্বপুরুষ ছাড়া অন্য কেউই টিকতে পারেনি। অন্যদিকে, মানুষ শুধু একটি প্রজাতি এবং মানবসভ্যতার যাত্রা শুরু হয় মাত্র পাঁচ হাজার বছর আগে। মানুষের মতো বৈচিত্র্যহীন প্রজাতি যদি বায়োস্ফিয়ারের প্রতি যত্নশীল না হয়, তাহলে সিক্সথ-এক্সটিঙ্কশনে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়বে মানুষ নিজেই।