পদার্থের মৌলিক কণা “পরমাণু”। এই পরমাণু কাঠামো মূলত নির্ভর করে নিউক্লিয়াস ও নিউক্লিয়াস চারিদিকে অবস্থিত ইলেক্ট্রনের ওপর। প্রবলশক্তির প্রভাবে (strong nuclear force) নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রন লাগালাগি অবস্থায় থাকে। কিন্তু, ইলেক্ট্রনদের ব্যাপার একদম আলাদা। কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে ইলেক্ট্রনেরা নিউক্লিয়াস থেকে দূরে জটিল ত্রিমাত্রিক স্থানে তরঙ্গ আকারে অবস্থান করে। এই জটিল ত্রিমাত্রিক স্থানকে সাধারণ অর্থে কক্ষপথ (অরবিট) বলা হয়। এই কক্ষপথ শব্দটার সাথে গ্রহ-নক্ষত্রদের কক্ষপথের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতিটি কক্ষপথের একটি নির্দিষ্ট শক্তিস্তর (Energy Level) থাকে । এই কক্ষপথগুলোতে ইলেক্ট্রন কণা আকারে থাকতে পারেনা, তাদের থাকতে হয় তরঙ্গ আকারে। ইলেক্ট্রনদের এই তরঙ্গ আকৃতি ব্যাখ্যা করা হয় শ্রোডনিগারের তরঙ্গ সমীকরণ দিয়ে। মনে রাখা দরকার, ইলেক্ট্রনেরা কক্ষপথে আবর্তন করেনা, তারা স্রেফ কক্ষপথ অবস্হান করে। ইলেক্ট্রনরা কি অবস্হায় কক্ষপথে অবস্হান করবে সেটা নির্ভর করে চারটি পূর্ণসংখ্যার উপর, এদের বলে কোয়ান্টাম সংখ্যার। এদের প্রথম তিনেটি এসেছে শ্রোডনিগারের সমীকরণের থেকে আর শেষটি আসে পর্যবেক্ষণ এসেছে। সংখ্যাগুলো হলো.
n = প্রিন্সিপল সংখ্যা (যেটা আমরা আগে দেখছি)
l = কক্ষপথজনিত কৌনিক ভরবেগ
m = চুম্বকীয় সংখ্যা
s = স্পিন
এই চারটি সংখ্যা একত্রে একটা ইলেক্ট্রনের কোয়ান্টাম অবস্থা নির্দেশ করে। উল্ফগ্যাং পাউলি সর্বপ্রথম ধারণা দেন যে, একই শক্তিস্তর বা কক্ষপথে একাধিক ইলেক্ট্রনের এই চারটি কোয়ান্টাম সংখ্যা কখনো এক হবে না। একে বলে পাউলির বর্জন-নীতি। অন্য ভাবে বললে, একই শক্তিমাত্রায় একাধিক ইলেক্ট্রন কখনো একই কোয়ান্টাম অবস্থা থাকতে পারেনা।
ইলেক্ট্রন হলো ফার্মিয়ন বা ম্যাটার (পদার্থ) কণা, পাউলির বর্জন-নীতি যেকোনো মৌলিক বা অমৌলিক ফার্মিয়নদের জন্য প্রযোজ্য। অন্যদিকে, গেজ-বোসন হলো শক্তি কণা, এরা পাউলির বর্জন-নীতি অনুসরণ করেনা। ফলে, আপনি যদি অগণিত গেজ-বোসন কণাদের (যেমন ফোটন) পরম শূন্য তাপমাত্রায় রাখেন, তবে এরা সহজেই একই শক্তিস্তরে একই কোয়ান্টাম অবস্থা চলে আসবে। এই অদ্ভুত ঘটনাকে বলে, বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূতকরণ। এটাকে অদ্ভুত বলার কারণ হলো, এই ধরণের ঘনীভূত অবস্হায় বোসনরা এমন সুসঙ্গত (Coherent) আচরণ করে যে, এদের মনেই হয়না আলাদা আলদা কণা। বরং মনে হয়, সবাই মিলে যেন একটি কণায় পরিণত হয়েছে। ওদিকে, ফার্মিয়নদের ব্যাপার ভিন্ন, আপনি যদি ওদের পরম শূন্য তাপমাত্রায় চিরকাল রেখে দেন, তবে চিরকাল ধরেই ওরা পাউলির বর্জন-নীতি মেনে চলবে। তাপমাত্রার দিয়ে ফার্মিয়নদের কোয়ান্টাম সুসঙ্গত অবস্হায় আনা যায় না। পাউলির বর্জন-নীতি মেনে চলা জন্যই ফার্মিয়নরা পদার্থ।
থট এক্সপেরিমেন্ট: যদি বলা হয় পদার্থকে অপদার্থে পরিণত করতে, কিভাবে সম্ভব?
সূর্যের কথায় আসা যাক, সৃষ্টির শুরুতে সূর্যের মূল পদার্থ ছিলো হাইড্রোজেন। টাইপ-২ সুপারনোভারা মাধ্যমে ছিটকে আসা সূর্য নামক গ্যাসপিণ্ডটি ছিলো প্রচণ্ড উত্তপ্ত। হাইড্রোজেনের ইলেক্ট্রনগুলো সূর্যের প্রচণ্ড তাপ শোষণ করে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন হয় এবং তারা নিউক্লিয়াসে শক্তিস্তরগুলো ছেড়ে বের হয়ে আসে। ফলে, সূর্য হয়ে গেল ইলেক্ট্রন ও প্রোটনের (হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস) মহাসাগর। পদার্থের এই অবস্হাকে বলে প্লাসমা। সূর্য ছিলো একটা বিশাল হাইড্রোজেন প্লাসমাপিণ্ড, যখানে অথৈ ইলেক্ট্রনের মাঝে প্রোটনগুলো হাবুডুবু খাচ্ছিলো। হাবুডুবু খাচ্ছিলো বললে ভুল হবে, ইলেক্ট্রনের চেয়ে ভারী হবার কারণে এরা আসলে ডুবে যায় এবং সূর্যের কেন্দ্রে গিয়ে জমা হতে থাকে। সূর্যপৃষ্ট থেকে সুর্যকেন্দ্রে আসতে প্রোটনদের কয়েক মিলিয়ন বছর লেগে যায়। যখন পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রোটন সুর্যকেন্দ্রে এসে জমা হয়, তখন তারা একে অন্যের প্রবলশক্তি বলয়ে মধ্যে আসতে চায় এবং জোড়া লাগতে চায়। সমস্যা হলো, প্রোটনেরা সমচার্জযুক্ত তাই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকর্ষণের কারণে তারা একে অপরকে কাছে আসতে পারে না। সমচার্জযুক্ত প্রোটনদের এই বিকর্ষণকে বলে কুলোম্ব-বেষ্টনী (coulomb barrier)। কিন্তু, সূর্যের এতো তাপ ছিলো না যে প্রোটনরা এই কুলোম্ব-বেষ্টনী উপেক্ষা করবে। যেই পদ্ধতিতে স্বল্প তাপে প্রোটনেরা এই কুলোম্ব-বেষ্টনী অতিক্রম করে তার নাম কোয়ান্টাম-টানেলিং। কোয়ান্টাম-টানেলিং বিষয়টা এরকম, ইলেক্ট্রনদের মতোই প্রোটন ও নিউট্রনরা পরমাণুর নিউক্লিয়াসে তরঙ্গ অবস্হায় থাকে। এই প্রোটন তরঙ্গদের কুলোম্ব-বেষ্টনী অতিক্রম করার মতো যথেষ্ট শক্তি থাকে না। এবার কুলোম্ব-বেষ্টনীকে এক বিশাল শক্তিপ্রাচীরের সাথে তুলোনা করুন। প্রকৃতিতে শক্তি কখনো নিরবিচ্ছিন্ন আকারে আসে না, এরা আসে গুচ্ছ বা কোয়ান্টা আকারে। তাই এই শক্তিপ্রাচীরও কনক্রীটের দেয়ালের মতো নিরেট পানিরোধী নয়। বরং এই শক্তিপ্রাচীর অনেকটা পাথরের ওপর পাথর জমিয়ে তৈরি করা একটা প্রাচীর। আর প্রোটন তরঙ্গ অনেকটা পানির স্রোতের মতো এই পাথরের প্রাচীরে আছড়ে পরে আর পাথরের ফাঁক চুইয়ে প্রাচীরের অন্যদিক দিয়ে বেড়িয়ে যায়। ফলে, এই শক্তিপ্রাচীর প্রোটন তরঙ্গদের আটকাতে পারেনা। এইভাবেই, প্রোটনরা কোয়ান্টাম-টানেলিং-এর মাধ্যমে অনায়েসে কুলোম্ব-বেষ্টনীর ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকর্ষণকে পেরিয়ে একে অন্যের কাছাকাছি চলে আসে এবং জোড়া লাগাতে শুরু করে। খেয়াল করুন, প্রোটনরা যদি তরঙ্গ না হয়ে কণা হতো তাহলে ব্যাপার হতো একদম অন্যরকম, প্রোটনরা হতো উড়ন্ত ছোট ছোট পাথরের মতো, যারা কিনা প্রাচীরের পৃষ্টে আছড়ে পরতো আর প্রাচীরের বড় বড় পাথরের ফাঁকে আটকে যেতো। ফলে প্রোটনরা কখনোই পাথরের প্রাচীর ভেদ করে অন্যপ্রান্তে যেতে পারতো না। যা হোক, এই প্রোটন-প্রোটন জোড়া লাগাকে বলে প্রোটন-প্রোটন-ফিউসন (এটা এক ধরণের হাইড্রোজেন ফিউসন)। যখন এই প্রোটন-প্রোটন-ফিউসন শুরু হলো, সূর্য প্রথমবারের মতো জ্বলে উঠলো।
সূর্যে পদার্থ প্লাসমা আকারে থাকে আর প্লাসমার ভরজনিত মাধ্যাকর্ষণ আছে। প্রশ্ন হলো, সূর্য কিভাবে প্লাসমার মাধ্যাকর্ষণজনিত সংকোচন প্রতিহত করে? ব্যাপারটি আদর্শ গ্যাস নীতির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু এখন ইলেক্ট্রন ও প্রোটনদের তরঙ্গের বদলে কণা হিসেবে ধরতে হবে। প্রোটন-প্রোটন-ফিউসন প্লাসমাকে উত্তপ্ত করে ও গতিশক্তি (kinetic energy) দেয়। প্লাসমারা এই তাপজনিত গতিশক্তি মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং মাধ্যাকর্ষণের সংকোচন প্রতিহত করে। হিলিয়াম-ফিউসনে নির্গত শক্তি হাইড্রোজেন-ফিউসনের চেয়ে বেশি, সূর্য তার জীবনের শেষ পর্যায়ে যখন হিলিয়াম-ফিউসন শুরু করবে, তখন অতিরিক্ত তাপ প্লাসমার গতিশক্তি অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবে। ফলে সূর্য আয়তন বেড়ে যাবে এবং সূর্য লাল দানবে পরিণত হবে। একসময় হিলিয়াম-ফিউসন শেষ হলে সূর্য ভর স্বল্পতার জন্য পরবর্তী ধাপ কার্বন-ফিউসনে যেতে পারবে না। সূর্যের মৃত্যু শুরু হবে তাপ হারানো মাধ্যমে, ক্রমাগত তাপ হারানো ফলে প্লাসমার গতিশক্তি হ্রাস পাবে এবং মাধ্যাকর্ষণ এই প্লাসমাকে সংকুচিত করতে থাকবে।
প্লাসমার সংকোচনে ইলেক্ট্রনেরা প্রথমে নিচের শক্তিস্তরগুলো পূরণ করে ফেলে। প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণের কারণের সবচেয়ে ওপরের শক্তিস্তরের থাকা ইলেক্ট্রনগুলো আরো ওপরের শক্তিস্তরের যেতে পারে না, আবার পাউলির বর্জন-নীতির কারণে নিচের শক্তিস্তরেও আসতে পারেনা। ওদিকে নিচের শক্তিস্তরের চাপা পরা ইলেক্ট্রনগুলোও একই অবস্থা, পাউলির বর্জন-নীতির কারণে তারা না পারে ওপরে উঠতে না পারে নিচে নামতে। অর্থাৎ, ইলেক্ট্রনেরা যার যার শক্তিস্তরে আটকা পরে যায়। যেহেতু ইলেক্ট্রনেরা এক শক্তিস্তর থেকে আরেক শক্তিস্তরে লাফাতে পারেনা, তাই শক্তির আদান প্রদান হয় না। এরপরও যদি মাধ্যাকর্ষণ বাড়তে থাকে ও প্লাসমার সংকোচনে চলতে থাকে, তবে ইলেক্ট্রনগুলো গতি বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে প্রায় আলোরগতির কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ইলেক্ট্রনগুলো লাগালাগি করে থাকার কারণে নিজেদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ জড়ায় না, ফলে ইলেক্ট্রনগুলো গতিশক্তি হারায় না। ইলেক্ট্রনগুলোর এই গতিশক্তি তার আটকে পরা শক্তিস্তরেই সীমাবদ্ধ থাকে। ইলেক্ট্রনের এই অবস্হাকে বলে ডিজেনেরেটেড-ইলেক্ট্রন (degenerate electron) বা ডিজেনেরেটেড-ইলেক্ট্রন-গ্যাস, আর এই প্রক্রিয়াকে বলে ইলেক্ট্রন-ডিজেনেরেসি (electron degeneracy)। এই অবস্হা যে কোনো ফের্মিয়নের হতে পারে, তাই এদের বলে ফের্মি-গ্যাস। প্লাসমার মতোই এই ডিজেনেরেটেড-ইলেক্ট্রন-গ্যাসের প্রচন্ড গতিশক্তি মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করে। ডিজেনেরেটেড-ইলেক্ট্রন-গ্যাসের এই প্রচন্ড গতিশক্তিজনিত চাপকে বলে ইলেক্ট্রন-ডিজেনেরেসি-প্রেসার । তবে, ইলেক্ট্রন-ডিজেনেরেসি-প্রেসারের একটা সীমা আছে, এই সীমাকে বলে চন্দ্রশেখর সীমা, যেটা মান ১.৪৪ সৌরভর। নক্ষত্রে ভর যদি ১.৪৪ সৌরভরে কম হয়, তবে ইলেক্ট্রন-ডিজেনেরেসি-প্রেসার মাধ্যাকর্ষণকে থামিয়ে দেয় এবং মৃত নক্ষত্র পরিণত হয় সাদা বামনে। ইলেক্ট্রন-ডিজেনেরেসি-প্রেসার ও মাধ্যাকর্ষণ এই দুই শক্তি ভারসাম্যে আসার সময় প্রচুর পরিমাণের শক্তি নক্ষত্রের ভেতর চাপা পরে যায়। এই শক্তি ধীরে ধীরে অনেক সময় ধরে বিকীর্ণ হয়, তাই যদিও মৃত, তবুও সাদা বামনদের জীবিত নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল দেখায়। আর নক্ষত্রে ভর যদি ১.৪৪ সৌরভরে বেশি হয়, তবে ইলেক্ট্রন-ডিজেনেরেসি-প্রেসার মাধ্যাকর্ষণকে থামাতে পারে না। এই অবস্হায় ইলেক্ট্রন তিনটি কাজ করতে পারে। প্রথমত, ইলেক্ট্রনকে আলোর চেয়ে বেশি গতিতে ছুটতে হবে, কিন্তু, এটা পদার্থবিজ্ঞানে নিষিদ্ধ। দ্বিতীয়ত, বোসনদের মতো পাউলি বর্জন-নীতি উপেক্ষা করতে হবে, অর্থাৎ, এই কোয়ান্টাম অবস্থার ইলেক্ট্রনগুলোকে একই শক্তিস্তরে চলে আসতে হবে, কিন্তু, এটাও ফের্মিয়নদের জন্য নিষিদ্ধ। সুতরাং, শেষ উপায় হলো, ইলেক্ট্রনগুলোকে প্রোটনের সাথে জোড়া লেগে নিউট্রন তৈরি করা, এটা পদার্থবিজ্ঞানে সিদ্ধ এবং ইলেক্ট্রনেরা সেটাই করে। এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর উচ্চ গতিশক্তির নিউট্রিনো তৈরি হয়।
কিন্তু, মাধ্যাকর্ষণ এখানেই থেমে যায় না। মাধ্যাকর্ষণ এবার নক্ষত্রের সমস্ত নিউট্রনগুলোকে একই শক্তিস্তরে একই কোয়ান্টাম অবস্থায় আনার চেষ্টা করে। ফলে, ইলেক্ট্রনের মতোই নিউট্রনও একসময় ডিজেনেরেটেড-ম্যাটারে পরিণত হয়। এই নিউট্রনদের বলে ডিজেনেরেটেড-নিউট্রন। ইলেক্ট্রনের চেয়ে নিউট্রন অনেকগুণ ভারী। ফলে নিউট্রনের গতিশক্তি বাড়াতে মাধ্যাকর্ষণকে ইলেক্ট্রনের চেয়েও অনেকগুণ বেশি চাপ দিতে হয়। এই কারণে ডিজেনেরেটেড-ইলেক্ট্রন-প্রেসারের চেয়ে ডিজেনেরেটেড-নিউট্রন-প্রেসার অনেক অনেক শক্তিশালী। ডিজেনেরেটেড-ইলেক্ট্রনদের মতোই ডিজেনেরেটেড-নিউট্রনের গতি যখন আলোরগতি অতিক্রম করার চেষ্টা করে তখনই ডিজেনেরেটেড-নিউট্রন-প্রেসার ভেঙ্গে পরে। এটা হলো ডিজেনেরেটেড-নিউট্রন-প্রেসারের সীমা, এর নাম টোলম্যান-ওপেনহেইমার-ভলকফ সীমা। চন্দ্রশেখর সীমার মতো টোলম্যান-ওপেনহেইমার-ভলকফ সীমা অতোটা নির্ভুল নয়। ধরণা করা হয়, এটা ৩ থেকে ৫ সৌরভরের কাছাকাছি।
যা হোক, যতক্ষণ নক্ষত্র টোলম্যান-ওপেনহেইমার-ভলকফ সীমা পেরিয়ে না যায়, ডিজেনেরেটেড-নিউট্রন-প্রেসার মাধ্যাকর্ষণকে থামিয়ে দেয়। এই দুই শক্তির প্রচণ্ড সংঘর্ষে যে শক-ওয়েভ তৈরি হয় তাকে বলে টাইপ-১এ সুপারনোভা। টাইপ-১এ সুপারনোভায় মূলত কার্বন নিঃসরণ ঘটে, কারণ নক্ষত্রগুলো তাদের সৌরভের কারণে কার্বন-ফিউসনে যেতে পারেনা। এই টাইপের সুপারনোভায় হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম নিঃসরণ হয় না, তাই নতুন নক্ষত্রও সৃষ্টি হয় না। টাইপ-১এ সুপারনোভার প্রধান বৈশিস্ট হলো, যেকোনো টাইপ-১এ সুপারনোভার উজ্জ্বলতা সমান। তাই এদেরকে মহাবিশ্বের স্ট্যান্ডার্ড-ক্যান্ডেল বলে। কোনো গ্যালাক্সিতে টাইপ-১এ সুপারনোভা হোল তার উজ্জ্বলতার তুলোনা করে গ্যালাক্সিটির দূরত্ব বের করা হয়।
এবার ধরুন এক বিশাল নক্ষত্র, যার ভর ৮ সৌরভর বা তারও বেশি। প্রথমে তারা হাইড্রোজেন ফিউসন করবে। হাইড্রোজেন ফিউসনে তৈরি ভারী হিলিয়াম নিউক্লিয়াস নক্ষত্রের কেন্দ্রে তলিয়ে যাবে, সেখানে যথেষ্ট হিলিয়াম জমা হলে শুরু হবে হিলিয়াম-ফিউসন। হিলিয়াম-ফিউসনে তৈরি কার্বনের নিউক্লিয়াস হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের চেয়ে ভারী বলে নক্ষত্রের কেন্দ্রে জমা হতে থাকবে। আর যথেষ্ট পরিমাণ কার্বন জমা হলে শুরু হবে কার্বন -ফিউসন। এভাবে চলতে থাকবে নিয়ন-ফিউসন, অক্সিজেন-ফিউসন এবং সবশেষে সিলিকন-ফিউসন। সিলিকন-ফিউসনে তৈরি লৌহ সবচেয়ে ভারী তাই লৌহ নক্ষত্রের কেন্দ্রে জমা হতে থাকবে। পুরো নক্ষত্র জুড়ে ফিউসন চলতে থাকবে অনেকটা পেঁয়াজের খোসার মতো। বাহিরের স্তরে হাইড্রোজেন, তারপর হিলিয়াম, কার্বন, নিয়ন, অক্সিজেন, সিলিকন আর কেন্দ্রে লৌহ। এই নক্ষত্র তখনি সমস্যায় পরে যখন তার কেন্দ্রে যথেষ্ট লৌহ জমা হয় এবং নক্ষত্র আয়রন-ফিউসন শুরু করতে চেষ্টা করে। আয়রন-ফিউসন হলো এন্ডো-থার্মাল বা তাপ শোষক ধরণের ফিউসন। আয়রন-ফিউসন কেন্দ্রের তাপ শুষে নিতে শুরু করে, ফলে নক্ষত্রের কেন্দ্র শীতল হতে থাকে। প্লাসমার গতিশক্তি কমে যায়, মাধ্যাকর্ষণ নক্ষত্রকে সংকুচিত করতে থাকে। ওদিকে সিলিকন-ফিউসন ক্রমাগত লৌহ জমাতে থাকে আর আয়রন-ফিউসন সেগুলোকে জোড়া লাগাতে চেষ্টা করে, ফল স্বরূপ নক্ষত্রের তাপমাত্রা আরো কমে যায়। এই চক্র ততক্ষণ চলে যতক্ষণ না নক্ষত্রের লৌহ-কেন্দ্র চন্দ্রশেখর সীমা অতিক্রম করে। খেয়াল করুন, এখানে নক্ষত্রের লৌহ-কেন্দ্রের চন্দ্রশেখর সীমা লঙ্ঘনের কথা বলা হয়েছে, পুরো নক্ষত্রের কথা বলা হয়নি। যখনই লৌহ-কেন্দ্র ১.৪৪ সৌরভর অতিক্রম করবে, ডিজেনেরেটেড-ইলেক্ট্রন-প্রেসার আর কেন্দ্র-ধস (core collapse) থামাতে পারবেনা। ফলে, ইলেক্ট্রন ও প্রোটন জোড়া লেগে নিউট্রন তৈরি করবে। প্রচুর পরিমাণ উচ্চ গতিযুক্ত নিউট্রিনো বিপুল শক্তি নিয়ে বেরিয়ে যাবে। প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণ এই নিউট্রনগুলোকে ডিজেনেরেটেড-ম্যাটারে পরিণত করে। আর এই ডিজেনেরেটেড-নিউট্রন-প্রেসার কেন্দ্র-ধস ঠেকিয়ে দেয়। ডিজেনেরেটেড-নিউট্রন-প্রেসার ও মাধ্যাকর্ষণজনিত কেন্দ্র-ধসের মধ্যকার এই ধাক্কা সৃষ্টি করে প্রচণ্ড শক্তিশালী শক-ওয়েভ। শক-ওয়েভ ও নিউট্রিনো বিকিরণ দুয়ে মিলে নক্ষত্রের প্রায় সমস্ত পদার্থ মহাকাশে ছুড়ে দেয়। আর এটাই হলো টাইপ-২ সুপারনোভা। টাইপ-২ সুপারনোভা বৈশিষ্ট হলো, ছুড়ে দেয়া হাইড্রোজেন নতুন নক্ষত্র তৈরি করে। আর প্রচণ্ড তাপে ছিটকে যাওয়া বিভিন্ন মৌলগুলো জোড়া লেগে পর্যায় সারণীর অন্যান্য প্রাকৃতিক মৌল তৈরি করে। টাইপ-২ সুপারনোভার জন্যই বলা হয় “We all made of stars”।
সুপারনোভার পর নক্ষত্রে রয়ে যাওয়া ডিজেনেরেটেড-নিউট্রন-প্রেসারের কারণে তৈরি হয় নিউট্রন-নক্ষত্রে। মাধ্যাকর্ষণের জন্য ডিজেনেরেটেড-নিউট্রন-প্রেসার ভেঙ্গে ফেলা কঠিন কিন্তু, অসম্ভব নয়। নিউট্রন-নক্ষত্র যখন টোলম্যান-ওপেনহেইমার-ভলকফ সীমা অতিক্রম করে তখন তার সমস্ত পদার্থগুলো সিঙ্গুলারিটিতে হারিয়ে যায়। যাকে আমরা বলি ব্ল্যাকহোল। প্রশ্ন হলো, কি হয় ডিজেনেরেটেড-নিউট্রনদের? আমরা ঘটনা-দিগন্তের ওপারের কিছুই দেখতে পাই না। কিন্তু, যদি কল্পনাকে প্রসারিত করা হয়, তাহলে ব্যাপারটা এরকম হবার কথা,
নিউট্রনরা হলো ব্যারিয়ন, এরা তৈরি হয় একটি আপ-কোয়র্ক ও দুটি ডাউন-কোয়র্ক থেকে। কোয়র্ক হলো ফের্মিয়ন অর্থাৎ, তারা পাউলির বর্জন-নীতি অনুসরণ করে। এই তিনটি কোয়র্ক নিজেদের মধ্যে গ্লুয়োন কণা দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে নিউট্রন গঠন করে (গ্লুয়োন একধরণের গেজ-বোসন)। ডিজেনেরেটেড-নিউট্রন-প্রেসারের ভেঙ্গে পরার সাথে সাথে কোয়র্কও ডিজেনেরেটেড-ম্যাটারে পরিণত হওয়ার কথা। এবং ডিজেনেরেটেড-কোয়র্কের উচিত মাধ্যাকর্ষণকে থামিয়ে দেয়া। মনে হতে পারে, কোয়র্ক নিউট্রনের চেয়ে হালকা তাই ডিজেনেরেটেড-কোয়র্ক-প্রেসার যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। কিন্তু, লক্ষ্য করার বিষয়টি হলো, ডিজেনেরেটেড-কোয়র্ক তৈরি হবার সময় আসলে যেটা তৈরি হয় সেটা হলো কোয়র্ক-গ্লুয়োন-প্লাসমা। গ্লুয়োন-ফিল্ড হলো আমাদের জানা সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তিবলয়। গ্লুয়োন কণারা r^২ নীতি অনুসরণ করে, মানেটা হলো, গ্লুয়োন-ফিল্ডকে যতোই টানবেন রবারের মতো দ্বিগুণ শক্তিতে সংকুচিত হতে চাইবে। আবার, যতোই সংকুচিত করবেন স্প্রিং-এর মতো দ্বিগুণ শক্তিতে প্রসারিত হতে চাইবে। তাই, কোয়র্ক-গ্লুয়োন-প্লাসমা ও মাধ্যাকর্ষণের সংঘর্ষে “বিগ-ব্যাং”-এর মতো অবস্থা সৃষ্টি করার কথা। পার্টিকেল-এক্সাসেলারেটর গুলোতে প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষে অতি অল্প সময়ের জন্য এই কোয়র্ক-গ্লুয়োন-প্লাসমা তৈরি করা যায়। এইজন্য আমরা “বিগ ব্যাং” সৃষ্টির দাবি করি। “বিগ ব্যাং”-এর মূল উপাদান তিনটি, সিঙ্গুলারিটি, কোয়র্ক-গ্লুয়োন-প্লাসমা, ও শক-ওয়েভ (বা বিস্ফোরণ)। অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, ডিজেনেরেটেড-নিউট্রন-প্রেসার ভেঙ্গে পরার সাথে সাথে এই তিনটি উপাদানই পাওয়া যায়। কিন্তু, নিউট্রন-নক্ষত্র ধসের সময় আমরা নতুন মহাবিশ্ব সৃষ্টি হতে দেখিনা, বরং দেখি ব্ল্যাকহোল তৈরি হতে। কিন্তু কেনো? উত্তরটা আপনাদের কল্পনার ওপর ছেড়ে দিলাম।
এবার প্রথম প্রশ্নে ফিরে আসি, কিভাবে পদার্থের অপদার্থকরণ সম্ভব?
ডিজেনেরেটেড-ম্যাটারকে বলা যেতে পারে পদার্থের পঞ্চম রূপ, প্লাসমা থেকে এর পার্থক্য হলো, প্লাসমারা শক্তি আদান-প্রদান করতে পারে কিন্তু, ডিজেনেরেটেড-ম্যাটার সেটা পারে না। সুতরাং, আপনি যদি, পদার্থকে অপদার্থ বানাবার চেষ্টা করেন তবে প্রক্রিয়াটা হবে অনেকটা এরকম,
পদার্থ —> ডিজেনেরেটেড-ম্যাটার
ডিজেনেরেটেড-ম্যাটার = ডিজেনেরেটেড-ইলেক্ট্রন —> ডিজেনেরেটেড-নিউট্রন —> (কোয়র্ক-গ্লুয়োন-প্লাসমা + সিঙ্গুলারিটি + বিং-ব্যাং)
(কোয়র্ক-গ্লুয়োন-প্লাসমা + সিঙ্গুলারিটি + বিগ ব্যাং) –> ব্ল্যাকহোল বা নতুন মহাবিশ্ব —> নতুন পদার্থ