হিগ্গস-বোসন এবং হিগ্গস-ফিল্ড: সুপারসিমেট্রি

energybigbang
মহাবিশ্বের শুরুর ক্ষণটিকে বলে প্ল্যাঙ্ক-ইপক। ধারণা করা হয়, প্ল্যাঙ্ক-ইপকের সময়ে মহাবিশ্বে শুধু একটি বলক্ষেত্র ছিলো, যাকে সাধারণ অর্থে বলা হয় “সুপার-ফোর্স”। মহাবিশ্ব বিকাশের বিভিন্ন সময়ে এই সুপার-ফোর্স ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পেতে শুরু করে। মহাবিশ্বের বর্তমান সময়ে সুপার-ফোর্সকে চারটি মৌলিক বলক্ষেত্র হিসেবে দেখা যায়: প্রবল-নিউক্লিয়ার, দুর্বল-নিউক্লিয়ার, বিদ্যুৎচুম্বকীয়, এবং মাধ্যাকর্ষণ।

গাণিতিকভাবে যেসব বলক্ষেত্রের প্রভাব দূরত্বের সাথে সাথে 1/r^2 নীতিতে কমতে থাকে তারা দূরগামী বলক্ষেত্র। এবং যেসব বলক্ষেত্রের প্রভাব দূরত্বের সাথে সাথে e^(-r/L) নীতিতে কমতে থাকে তারা স্বল্পগামী বলক্ষেত্র। দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র এই e^(-r/L) নীতি অনুসরণ করে। এখানে, e হলো ওয়েলার-ধ্রুবক, ফলে e^(-r/L) রাশিটি দূরত্ব (r) বাড়ার সাথে সাথে তীব্র-গতিতে (Exponentially) কমতে থাকে। দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্রের e^(-r/L) নীতি অনুসরণের কারণ হিগ্গস-ফিল্ড। স্থানকালের যেকোনো বিন্দুতে হিগ্গস-ফিল্ডের মান 246GeV। মহাবিশ্বের শূন্যস্থানে যেখানে অন্যান্য ফিল্ডের মান শূন্য সেখানেও হিগ্গিস-ফিল্ডের মান 246GeV। বলা যায়, পুরো মহাবিশ্ব হিগ্গস-ফিল্ডের ঘন কুয়াশায় জড়িয়ে আছে, আর যেই বলক্ষেত্র এই কুয়াশায় আটকা পড়ে গেছে সেটা হলো দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র। তবে, হিগ্গিস-ফিল্ডকে এই দৃষ্টিতে কাল্পনিক ইথারের (Aether) থাকে তুলোনা করাটা একেবারেই ভুল। কারণ, আপেক্ষিকতার দৃষ্টিতে ইথারকে স্থির বা রেস্ট-ফ্রেম হিসেবে গণ্য করা যায়, তাই ইথারের ভেতরে চলমান বস্তুর গতিকে ইথারের সাথে তুলোনা করা চলে। এটাই ছিলো মাইকেলসন এবং মুরলেইয়ের বিখ্যাত ইথার-এক্সপেরিমেন্টের মূল ভিত্তি। অন্যদিকে, হিগ্গস-ফিল্ড একটি কোয়ান্টাম-ফিল্ড, অর্থাৎ যে কণারা হিগ্গস-কণার সাথে নিউক্লিয়ার-কার্যলাপে জড়ায়, শুধু তারাই এই হিগ্গস-ফিল্ডের উপস্থিতি বুঝতে পারে। এজন্যই হিগ্গস-ফিল্ডকে রেস্ট-ফ্রেম হিসাবে ব্যবহার করা যায় না।

Screen Shot 2016-08-21 at 9.00.27 PM
শূন্যস্থানে অন্যান্য কোয়ান্টাম-ফিল্ডের মান যেখানে শূন্য, সেখানে হিগ্গস-ফিল্ডের মান 246GeV।

হিগ্গস-ফিল্ডের মাধ্যমে গেজ-সিমেট্রি ভাঙ্গনের ধারণাটি সর্বপ্রথম দেন জাপানী বংশোদ্ভূত মার্কিন পদার্থবিদ ইয়োশিরো-নাম্বু (Yoichiro Nambu) ১৯৬০ সালের দিকে। তার এই ধারণাকে বলে হিগ্গস-মেকানিজম। ১৯৬১ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ জেফ্রি-গোল্ডস্টোন (Jeffrey Goldstone) একটি উপপাদ্য প্রস্তাব করেন যেটা গোল্ডস্টোন-থিওরেম নামে পরিচিত। গোল্ডস্টোন-থিওরেমের মূল কথা ছিলো, গেজ-সিমেট্রি অক্ষত থাকলে ভরহীন গেজ-বোসন পাওয়া যায়, এবং গেজ-সিমেট্রি ভেঙে গেলে গোল্ডস্টোন-বোসন নামের ভিন্ন ধরণের ভরহীন বোসন পাওয়া যাবে। অর্থাৎ, গোল্ডস্টোন-থিওরেম অনুসারে, গেজ-সিমেট্রি থাকুক বা না থাকুক ভরহীন বোসন কোনোভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়। নাম্বুর হিগ্গস-মেকানিজমের সবচেয়ে বড় বাধা ছিলো এই গোল্ডস্টোন-থিওরেম।

গোল্ডস্টোন-থিওরেমের বাধা সর্বপ্রথম পেরুতে পারেন পদার্থবিদ ফিলিপ-অ্যান্ডার্সন ১৯৬৩ সালে, অ্যান্ডার্সন ছিলেন একজন কনডেন্সড-ম্যাটার বিশেষজ্ঞ। তিনি লক্ষ্য করেন যে, হিগ্গিস-বোসন এবং সুপারকন্ডাক্টিভিটির ভৌত-প্রক্রিয়া প্রায় একই। অ্যান্ডার্সনই সর্বপ্রথম স্থানকাল বিস্তৃত অশূন্য-ফিল্ডের ধারণাটি হিগ্গস-মেকানিজমে সন্নিবেশিত করেন। সমস্যা হলো, অ্যান্ডার্সন কনডেন্সড-ম্যাটার-ফিজিক্সের দৃষ্টিকোণ থেকে আপেক্ষিকতা ছাড়াই হিগ্গস-মেকানিজমকে প্রস্তাব করেছিলেন। আর তাই, পার্টিকেল-ফিজিক্সের জগতে তার প্রস্তাবটি আলোর মুখ দেখেনি।

I15-04-Higgs
অ্যান্ডার্সনই সর্বপ্রথম লক্ষ্য করেন যে, সুপারকন্ডাক্টরের কুপার-পেয়ার এবং হিগ্গস-বোসনের বৈশিষ্ট্য প্রায় একই।

অ্যান্ডার্সনের পর ১৯৬৪ সালে, দুটি বেলজিয়ান পদার্থবিদ এংলেয়ার (Francois Englert) এবং ব্রাউট (Robert Brout) যৌথভাবে হিগ্গস-মেকানিজমকে অনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করেন।

ব্রিটিশ পদার্থবিদ পিটার-হিগ্গিস ১৯৬৫ সালে ধারণা দেন যে, গোল্ডস্টোন-থিওরেম গেজ-সিমেট্রির ওপর পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে তিনি হিগ্গিস-মডেল প্রস্তাব করেন, যেখানে হিগ্গিস-বোসনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিলো।

পিটার হিগ্গসের কয়েক মাস পরেই তিন পদার্থবিদ টম-কিব্বেল (Tom Kibble), জেরাল্ড-গুয়ানিক  (Gerald Guralnik), এবং কার্ল-রিচার্ড-হাগেন (Carl Richard Hagen) প্রায় একইরকম  হিগ্গস-মেকানিজম প্রস্তাব করেন।

এরপর, ১৯৭১ সালে ডাচ পদার্থবিদ গেরার্ড-তুফ (Gerard T Hooft) হিগ্গস-মেকানিজমের সর্বশেষ বাধাটি অতিক্রম করেন। তুফ হিগ্গস-মেকানিজমের গাণিতিক ফ্রেমওয়ার্কে রিনর্মালাইজেশন পদ্ধতি (Renormalization) যুক্ত করেন। ফলে, হিগ্গস-মেকানিজমের গাণিতিক বিশ্লেষণ থেকে পরিমাপযোগ্য মান পাওয়া সম্ভব হয়।

হিগ্গস-মেকানিজমের পেছনে লেগে থাকা প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য ছিলো, গেজ-সিমেট্রি থেকে স্বল্পগামী বলক্ষেত্র পাওয়া। তবে, সবারই দৃষ্টি ছিলো প্রবল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্রের দিকে। সত্তরের দশকের শুরুতে মার্কিন পদার্থবিদ স্টিভেন-ওয়াইনবার্গ হিগ্গস-মেকানিজম থেকে প্রবল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু, সুবিধা করতে না পেরে ওয়াইনবার্গ মনোযোগ দেন দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্রের দিকে। তিনি হিগ্গস-মেকানিজম প্রয়োগ করেন গ্ল্যাশোর গেজ-সিমেট্রির ওপর। এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ১৯৬৭ সালে ওয়াইনবার্গ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যার নাম ছিলো “A Theory of Lepton”। এই “A Theory of Lepton” পর্দাথবিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র।

গেজ-সিমেট্রির ওপর অশূন্য হিগ্গস-ফিল্ড ব্যবহার করে ওয়াইনবার্গ যে শুধু বিশুদ্ধ উপায়ে ভরযুক্ত W/Z বোসন পেয়েছিলেন তাই নয়। দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্রের প্যারিটি-ভায়োলেশন এবং মৌলিক কণাদের ভরের উৎপত্তির কারণও ওয়াইনবার্গ নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করেন।

যেসব কণাদের স্পিন ঘড়ির কাঁটার দিকে তাদের বলে বাঁ-হাতি। আর ঘড়ির কাঁটার বিপরীত স্পিনযুক্ত কণাদের বলে ডান-হাতি। ওয়াইনবার্গ প্রস্তাব দেন যে, দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্রের প্রভাব শুধুমাত্র বাঁ-হাতি কণা এবং ডান-হাতি প্রতিকণাদের ওপর প্রযোজ্য। বাঁ-হাতি এবং ডান-হাতি কণা-প্রতিকণাদের প্রতি দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্রের এই বৈষম্যের কারণেই পি-সিমেট্রির লঙ্ঘন বা প্যারিটি-ভায়োলেশন ঘটে।

left_handed_right_handed
কণার স্পিন যদি গতি বরাবর ঘড়ির কাঁটার দিকে হয়, তবে কণাটি বাঁ-হাতি। অন্যতায়, কণাটি ডান-হাতি।

একটি স্থির কণা বাঁ-হাতি নাকি ডান-হাতি সেটা নির্ণয় করা বেশ জটিল। যেমন: একটি স্থির কণাকে সামনে থেকে যদি বাঁ-হাতি মনে হয়, তবে পেছন মনে হবে ডান-হাতি। এর উল্টোটিও সত্যি। প্রশ্ন হলো, তাহলে দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র কিভাবে বাঁ-হাতি ও ডান-হাতি কণা-প্রতিকণাদের মধ্যে পার্থক্য বুঝেতে পারে? ওয়াইনবার্গের প্রস্তাব অনুসারে, হিগ্গস-ফিল্ডের অনুপস্থিতিতে প্রকৃতির প্রতিটি ফার্মিয়ন ভরশূন্য। আপেক্ষিকতা অনুসারে, যেকোনো ভরশূন্য কণার গতি আলোরগতির সমান। ভরশূন্য কণাদের গতির সম্মুখ বরাবর যে স্পিনের পাওয়া যায় সেটাই কণাদের আসল পরিচয় নির্দেশ করে। এভাবেই দুর্বল-বলক্ষেত্র ভরশূন্য ফার্মিয়নদের গতি এবং স্পিনের দিক থেকে বাঁ-হাতি কণা এবং ডান-হাতি প্রতিকণাদের চিনতে পারে।

কিন্তু, প্রকৃতিতে আমরা ভরশূন্য ফার্মিয়ন কণা দেখতে পাই না, কারণটা হলো হিগ্গস-ফিল্ড। ফার্মিয়নেরা যখন আলোরগতিতে অশূন্য হিগ্গস-ফিল্ডের ভেতর দিয়ে যাবার চেষ্টা করে, তখন ফার্মিয়নেরা হিগ্গস-ফিল্ডের সাথে নিউক্লিয়ার-কার্যালাপে জড়িয়ে পড়ে। এই নিউক্লিয়ার-কার্যালাপের শক্তিমত্তা বিভিন্ন ফার্মিয়নদের জন্য বিভিন্ন। ব্যাপারটিকে নিচের সমীকরণের মাধ্যমে দেখানো যায়।

ফার্মিয়নদের ভর = (হিগ্গস-ফিল্ডের মান) x (নিউক্লিয়ার-কার্যালাপের শক্তিমত্তা)

প্রকৃতিতে বিভিন্ন ফার্মিয়নদের ভর ভিন্ন ভিন্ন হবার কারণ হলো, হিগ্গস-ফিল্ডের সাথে তাদের নিউক্লিয়ার-কার্যালাপের শক্তিমত্তার ভিন্নতা। ওপরের সম্পর্ক থেকে কণাদের ভর পরিমাপ করা ছাড়াও, হিগ্গিস-বোসনের ভরেরও ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব।

গত পর্বে বলা হয়েছিলো যে, গ্ল্যাশো তার গেজ-সিমেট্রি থেকে W-, W+, Z, এবং ফোটন পেয়েছিলেন। গ্ল্যাশোর গেজ-সিমেট্রি হলো, SU(2)। ওয়াইনবার্গের পরবর্তীতে এই গেজ-সিমেট্রির ওপর হিগ্গস-ফিল্ডযুক্ত করেন। গ্ল্যাশোর গেজ-সিমেট্রি মূলত দুর্বল-নিউক্লিয়ার এবং বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলক্ষেত্র দুটোকেই একীভূত করে ফেলে, এই একীভূত বলক্ষেত্রকে বলে ইলেক্ট্রো-উইক বলক্ষেত্র (Electroweak force )। একই সময়ে পাকিস্তানী পদার্থবিদ আব্দুস-সালাম কেমব্রিজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জন-ওয়ার্ডের অধীনে স্বাধীনভাবে ইলেক্ট্রো-উইক বলক্ষেত্রের গাণিতিক মডেল তৈরি করে। প্রকৃতির দুটি মৌলিক বলক্ষেত্রকে একীভূত করার এই অসামান্য অবদানের জন্য গ্ল্যাশো, ওয়াইনবার্গ, এবং আব্দুস সালাম ১৯৭৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পদক পান।

ইলেক্ট্রো-উইক বলক্ষেত্রের ভবিষ্যদ্বাণীর জের ধরে ১৯৭৩ সালে উইক-নিউট্রাল-কারেন্ট আবিষ্কৃত হয়। উইক-নিউট্রাল-কারেন্ট হলো Z বোসনের মাধ্যমে সম্পাদিত দুর্বল-নিউক্লিয়ার-কার্যালাপ, যা স্পষ্টতই Z বোসনের উপস্থিতি প্রমান করে। এর দশ বছর পর, ১৯৮৩ সালে সার্নে (CERN) সরাসরি W/Z বোসন আবিষ্কৃত হয়।

পদার্থ ফার্মিয়ন দিয়ে তৈরি, এবং ফার্মিয়নদের ভর আসে হিগ্গস-ফিল্ড থেকে। মজার ব্যাপার হলো, পদার্থের মোট ভরের পুরোটাই কিন্তু ফার্মিয়ন থেকে পাওয়া যায় না। যেমন: একটি প্রোটনের ভর 938MeV (1MeV = দশলক্ষ eV)। একটি প্রোটন দুটি আপ-কোয়ার্ক এবং একটি ডাউন-কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। আপ-কোয়ার্কের ভর 2MeV এবং ডাউন-কোয়ার্কের ভর 5MeV। সুতরাং, একটি প্রোটনের ফার্মিয়নিক ভর মাত্র 9MeV, যেটা প্রোটনের মোট ভরের একশোভাগের একভাগেরও কম। বাকি সমস্ত ভর আসে ক্রোমো-ডায়নামিক বা প্রবল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র থেকে। ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক।

একটা হাইড্রোজেন পরমাণু গঠিত হয় একটি ইলেক্ট্রন এবং একটি প্রোটন থেকে। কিন্তু, একটি ইলেক্ট্রন এবং একটি প্রোটনের সম্মিলিত ভর একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের চেয়ে বেশি। ইলেক্ট্রন এবং প্রোটন চার্জযুক্ত কণা, এদের ভরের একটা অংশ আসে এই চার্জজনিত বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলক্ষেত্র থেকে। এই ইলেক্ট্রন এবং প্রোটন যখন একটি হাইড্রোজেন পরমাণু গঠন করে, তখন এদের বিপরীতধর্মী চার্জ একে অন্যকে নিরপেক্ষ করে ফেলে। ফলে, হাইড্রোজেন পরমাণুর সামগ্রিক বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলক্ষেত্র শূন্য হয়ে পড়ে, এবং তাই চার্জজনিত ভর পরমাণুর সাথে যুক্ত হয়না।

একটি কোয়ার্ককে হ্যাড্রন কাঠামোর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলে কোয়ার্কের সাথে যুক্ত ক্রোমো-ডাইনামিক বা গ্লুয়ন বলক্ষেত্রের শক্তি হয়ে পড়ে অসীম। কিন্তু, হ্যাড্রন কাঠমোর ভেতর কোয়ার্কদের গ্লুয়নগুলো একে অন্যের অসীম শক্তিকে নিরপেক্ষ করে ফেলে। আর এইজন্যই হ্যাড্রন কাঠামোর বাহির থেকে গ্লুয়ন বলক্ষত্রের উপস্থিতি বোঝা যায় না, অনেকটা থিয়েটারের ভারী পর্দার ওপারে মঞ্চকুশলীদের মতো। যদি কোনোভাবে হ্যাড্রনের ভেতরে ঢুকতে যেতো তবে গ্লুয়নদের প্রবল শক্তিমত্তা দেখতে সম্ভব হতো। তবে ব্যাপারটা হলো, হ্যাড্রনের ভেতরে গ্লুয়নেরা নিজেদের শক্তিকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ করতে পারে না। রয়ে যাওয়া অতিসামান্য কিছু গ্লুয়ন শক্তিকে আমরা বলি প্রোটনের ক্রোমো-ডাইনামিক ভর। সুতরাং স্পষ্ট করে বললে;

প্রোটনের ভর = ক্রোমো-ডাইনামিক্যাল ভর + ফার্মিয়নিক ভর;

কণাদের শক্তি তিন ধরণের: ভর, গতিশক্তি (কাইনেটিক এনার্জি), এবং বিভবশক্তি (পটেনশিয়াল এনার্জি)। অন্যদিকে, যেই কোয়ান্টাম-ফিল্ড থেকে কণাদের উৎপত্তি ঘটে সেই ফিল্ডগুলোর শক্তিও তিন ধরণের: গতিশক্তি, বিভবশক্তি, এবং গ্র্যাডিয়েন্ট। কণাদের উৎপত্তির কারণ ফিল্ডের কম্পন থেকে, এই কম্পন ফিল্ডে গতিশক্তি তৈরি করে। এবং এই গতিশক্তি ঢেউয়ের মতো ফিল্ডে ছড়িয়ে পড়ে। কম্পন ছড়িয়ে পড়ার সময় স্থানকালের বিভিন্ন বিন্দুতে ফিল্ডের গতিশক্তির তারতম্যকে বলে গ্র্যাডিয়েন্ট।

কোনো ফিল্ড থেকে উদ্ভুত কণার ভর নির্ভর করে ফিল্ডের বিভবশক্তির ওপর। শূন্যস্থানে ফার্মিয়নিক এবং গেজ-ফিল্ডগুলোর বিভবশক্তি শূন্য, তাই মূল ফিল্ড থেকে পাওয়া ফার্মিয়ন এবং গেজ-বোসনদের সহজাত ভর শূন্য। অন্যদিকে, হিগ্গস-ফিল্ডের বিভবশক্তি 246GeV, আর তাই হিগ্গস-কণার সহজাত ভর রয়েছে, যার মান 125GeV।

I15-04-Higgsfield
বাঁয়ে: শূন্যস্থানে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলক্ষেত্রের বিভবশক্তি শূন্য। ডানে: শূন্যস্থানে হিগ্গস-ফিল্ডের বিভবশক্তি অশূন্য, তবে এই বিভবশক্তি ঋণাত্মক।

হিগ্গস-ফিল্ড বাদে অন্যান্য কোয়ান্টাম-ফিল্ডের স্থিতিবস্থা শূন্যতে, এই স্থিতিবস্থায় ফিল্ডগুলো মোটশক্তি এবং বিভবশক্তি দুটোই শূন্য। অন্যদিকে, হিগ্গস-ফিল্ডের স্থিতিবস্থা 246GeVতে, এই 246GeV হলো হিগ্গস-ফিল্ডের বিভবশক্তি। এই বিভবশক্তিতে হিগ্গস-ফিল্ডের মোটশক্তি সর্বনিম্ন হয়। আমরা যদি হিগ্গস-ফিল্ডের মান 246GeV থেকে শূন্যতে আনার চেষ্টা করি, তবে আমাদের শক্তি খরচ করতে হবে। অর্থাৎ, হিগ্গস-ফিল্ডের বিভবশক্তি শূন্য হলে মোটশক্তি হবে অশূন্য। এক হিসাব অনুসারে, একটি পিং-পং বলের সমান আয়তনের হিগ্গস-ফিল্ডের মান শূন্যতে করতে পৃথিবীর মোট ভরের সমতুল্য শক্তি দরকার। এথেকে বোঝা যাচ্ছে যে, হিগ্গস-ফিল্ডের বিভবশক্তি আসলে ঋণাত্মক, আর এজন্যই শূন্যতে পৌঁছতে শক্তির দরকার হয়।

ধারণা করা হয় কসমোলজিক্যাল-কনস্ট্যান্ট সমস্যায় হিগ্গস-ফিল্ডের ঋণাত্মক বিভবশক্তির ভূমিকা হয়েছে। শূন্যস্থানে কোয়ান্টাম-ফ্লাকচুয়েশন জনিত শক্তিকে বলে ভ্যাকুয়াম-এনার্জি। এই ভ্যাকুয়াম-এনার্জির প্রত্যাশিত মান ধনাত্মক, প্রায় ১০^(১১৮) আর্গ/ঘনসেন্টিমিটার, কিন্তু পর্যবেক্ষিত মান ঋণাত্মক, প্রায় ১০^(-৮)আর্গ/ঘনসেন্টিমিটার। ধারণা করা হয় যে, শূন্যস্থানের বিভিন্ন ভার্চুয়াল-কণাদের ওপর হিগ্গস-ফিল্ডের ঋণাত্মক বিভবশক্তির প্রভাবে ভ্যাকুয়াম-এনার্জির প্রত্যাশিত এবং পর্যবেক্ষিত মানের মধ্যে এতো পার্থক্য দেখা যায়।

২০১২ সালের জুলাইতে হিগ্গস-বোসন আবিষ্কার ঘোষণার মাধ্যমে কণা-তত্ত্বের স্ট্যান্ডার্ড-মডেলটি আনুষ্ঠানিক পূর্ণতা পায়। কিন্তু, এই হিগ্গস-কণাই স্ট্যান্ডার্ড-মডেলের সবচেয়ে বড় খুঁতটি প্রকাশ করে, থাকে বলে ক্রমোন্নতি-শ্রেণীকরণ-সমস্যা বা হাইয়ারর্কি-প্রবলেম (Hierarchy Problem)।

আমরা দেখেছিলাম যে, কিভাবে ওয়াইনবার্গ, আব্দুস-সালাম, এবং গ্ল্যাশো বিদ্যুৎচুম্বকীয় এবং দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র দুটোকে একীভূত করেছিলেন। তাদের এই একীভূতকরণ সম্ভব হয়েছিলো হিগ্গস-ফিল্ডের 246GeV বা প্রায় 10^(2) শক্তিমাত্রায়। হিগ্গস-ফিল্ডের এই 10^(2) শক্তিমাত্রায় হিগ্গস-কণার ভর 125GeV। অর্থাৎ, ইলেক্ট্রোউইক-ইন্টারঅ্যাকশনের ক্ষেত্রে হিগ্গস-ফিল্ডের শক্তি এবং হিগ্গস-বোসনের  ভর প্রায় কাছাকাছি।

বর্তমানে পদার্থবিদরা চেষ্টা করছেন বিদ্যুৎচুম্বকীয়, দুর্বল-নিউক্লিয়ার, এবং প্রবল-নিউক্লিয়ার এই তিনটি বলক্ষেত্রকে একীভূত করার। এই একীভূতকরণের নাম দেয়া হয়েছে GUT (Grand Unification Theory)। যে শক্তিমাত্রায় এই তিন বলক্ষেত্রের একীভূতকরণ সম্ভব তার মান, 10^(16) GeV। এই GUT তত্ত্বের সাথে যদি মাধ্যাকর্ষণ যুক্ত করা হয়, তবে পাওয়া যাবে বহু প্রত্যাশিত TOE (Theory of Everything)। TOEয়ের জন্য দরকার 10^(19) GeV শক্তিমাত্রা, এই শক্তিমাত্রাকে বলে প্ল্যাঙ্ক -স্কেল। গাণিতিক ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে এই প্ল্যাঙ্ক -স্কেল শক্তিমাত্রায় স্থানকাল বিদীর্ণ হয়ে গ্র্যাভিটন কণা পরিণত হয়। এই প্ল্যাঙ্ক -স্কেল এতোই বিশাল একটা সংখ্যা যে, প্ল্যাঙ্ক -স্কেলের সমান শক্তিশালী পার্টিকেল-এক্সেলারেটর তৈরি করা বর্তমান প্রযুক্তিতে অসম্ভব। আর তাই, গ্র্যাভিটন কণা আবিষ্কারের সম্ভাবনা আপাতত নেই।

54636
বিভিন্ন শক্তিমাত্রায় বিভিন্ন মৌলিক বলক্ষেত্রের একীভূতকরণ।

একটি হিগ্গস-বোসনকে যদি শূন্যস্থানে রেখে দেয়া হয়, তবে হিগ্গস-বোসনটি বিভিন্ন ভার্চুয়াল কণাদের সাথে নিউক্লিয়ার-কার্যালাপে জড়িয়ে পড়বে। বিভিন্ন শক্তিমাত্রায় এই নিউক্লিয়ার-কার্যালাপগুলোর পরিবর্তন ঘটে, যেটা হিগ্গস-বোসনের ভরকে সরাসরি প্রভাবিত করে। এই নিউক্লিয়ার-কার্যালাপগুলোর পরিবর্তনকে হিসেবে আনার গাণিতিক পদ্ধতিকে বলে, কোয়ান্টাম-কারেকশন। GUT শক্তিমাত্রায় কোয়ান্টাম-কারেকশনের ফলে হিগ্গস-বোসনের ভর হওয়ার কথা 10^(16) GeVয়ের কাছাকাছি, এবং প্ল্যাঙ্ক-স্কেলের ক্ষেত্রে 10^(19) GeVয়ের কাছাকাছি। কিন্তু, পর্যবেক্ষণ বলে অন্য কথা, শক্তিমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে মৌলিক বলক্ষেত্রগুলো একীভূত হতে শুরু করে, কিন্তু হিগ্গস-বোসনের ভর আটকে থাকে 125GeVতে। এটাই হলো হাইয়ারর্কি-প্রবলেম।

300px-Hqmc-vector.svg
ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম: ওপরে: GUT এবং TOEয়ের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে কোয়ান্টাম-কারেকশনের আগে ও পরে হিগ্গস-বোসনের ভরের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। নিচে: সুপারসিমেট্রির ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে কোয়ান্টাম-কারেকশনের আগে ও পরে হিগ্গস-বোসনের ভর সমান।

এই হাইয়ারর্কি-প্রবলেমটির দুটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা রয়েছে।

(এক) হিগ্গস-বোসনের ওপর ভার্চুয়াল-কণাগুলোর প্রভাব বিপরীতধর্মী। এই ব্যাখ্যা অনুসারে, ভার্চুয়াল-কণাগুলোর অর্ধেক হিগ্গিস-বোসনের ভর বৃদ্ধি করে, বাকি অর্ধেক ভর হ্রাস করে। ফলে, কোয়ান্টাম-কারেকশনের সময় ভার্চুয়াল-কণাগুলোর ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক প্রভাবগুলো কাটাকাটির পর হিগ্গস-বোসনের ভর 125GeVতে স্থির হয়।

অথবা, (দুই) কোনো অজ্ঞাত করণের হিগ্গস-বোসনের কোয়ান্টাম-কারেকশন অল্প শক্তিমাত্রাতেই থেমে যায়।

স্ট্যান্ডার্ড-মডেলে হাইয়ারর্কি-প্রবলেমটির কোনো সমাধান নেই। সুপারসিমেট্রি (Supersymmetry) হলো পদার্থবিজ্ঞানে অপেক্ষাকৃত নতুন তত্ত্ব যেখানে প্রথম উপায়ে হাইয়ারর্কি-প্রবলেম সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। বলে রাখা ভালো, সুপারসিমেট্রি এবং সুপারস্ট্রিং-তত্ত্ব দুটি ভিন্ন বিষয়। সুপারসিমেট্রিতে স্ট্রিং-তত্ত্বের দরকার পড়ে না। কিন্তু, স্ট্রিং-তত্ত্বে সুপারসিমেট্রি যোগ করা হলে সুপারস্ট্রিং-তত্ত্ব পাওয়া যায়।

সুপারসিমেট্রিকে সংক্ষেপে বলে SUSY, এর ভিত্তি হলো SU(5) গেজ-সিমেট্রি।। সুপারসিমেট্রি হলো GUT তত্ত্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থী। সুপারসিমেট্রি অনুসারে, স্ট্যান্ডার্ড-মডেলের প্রতিটি ফার্মিয়নের বোসন প্রতিসমকণা রয়েছে, এবং প্রতিটি বোসনের ফার্মিয়ন প্রতিসমকণা রয়েছে। কণা এবং প্রতিকণাদের ভর ও চার্জ সমান, কিন্তু স্পিন ভিন্ন। সুপারসিমেট্রি মতে, শূন্যস্থানে হিগ্গস-বোসনের ওপর ভার্চুয়াল-বোসন প্রতিসমকণাদের প্রভাব ধনাত্মক এবং ভার্চুয়াল-ফার্মিয়ন প্রতিসমকণাদের প্রভাব ঋণাত্মক। শুধু তাই নয়, সুপারসিমেট্রি ভবিষ্যদ্বাণী করে মোট আটটি হিগ্গস-কণার। হিগ্গস-বোসন, হিগ্গস প্রতিসমকণা বা হিগ্গসিনো, এবং হিগ্গসিনো ও অন্যান্য প্রতিসমকণার মিশ্রণ। যেমন: হিগ্গসিনো হলো ১/২-স্পিনের ফার্মিয়ন। অন্যদিকে, ফোটনের প্রতিসমকণা হলো ফোটিনো এবং W-বোসনের প্রতিসমকণা উইনো, দুটোই ১/২-স্পিনের ফার্মিয়ন। হিগ্গসিনো এবং ফোটিনো মিলে তৈরি করে চার ধরণের নিউট্রালিনো ফার্মিয়ন কণা। এবং, হিগ্গসিনো এবং উইনো মিলে তৈরি করে দুই ধরণের চার্জিনো ফার্মিয়ন কণা।

sypersymmetry
ধারণা করা হয়, SU(5) গেজ-সিমেট্রির স্বতঃস্ফূর্ত ভাঙ্গনের কারণে প্রতিসমকণারা বিশাল ভর পেয়ে থাকে। আর বিশাল ভরে কণাদের খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন।

আগেই বলা হয়েছিলো যে, সুপারসিমেট্রির ভিত্তি SU(5) গেজ-সিমেট্রি। SU(5) গেজ-সিমেট্রিকে বলা হয় প্রকৃতির সবচেয়ে মৌলিক প্রতিসাম্যতা। প্রকৃতিতে প্রতিসমকণাদের না পাওয়া কারণ হিসেবে এই SU(5) গেজ-সিমেট্রি ভাঙ্গনকে দায়ী করা হয়। ধারণা করা হয়, প্রকৃতিতে SU(5) গেজ-সিমেট্রির ভাঙ্গন একটি স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা।

অন্যদিকে, স্বল্প শক্তিমাত্রায় হিগ্গস-বোসনের কোয়ান্টাম-কারেকশন থেমে যাওয়া ব্যাখ্যায় প্রস্তাবিত তত্ত্বকে বলে টেকেনিকালার (Technicolor)। টেকেনিকালার তত্ত্বটি প্রায় কোয়ার্কের ক্রোমো-ডাইনামিক্সের মতোই। টেকেনিকালার অনুসারে, প্রতি মৌলিক কণা টেকেনিকোয়ার্ক নামের সাবস্ট্রাকচার বা উপকাঠামো দিয়ে তৈরি। এই সাবস্ট্রাকচারকে বলে প্রিয়ন (Preon)। এই টেকেনিকোয়ার্কগুলো বিভিন্ন বিন্যাসে টেকেনিকালার-বলক্ষেত্রের মাধ্যমে যুক্ত থাকে, এবং ইলেক্ট্রন, কোয়ার্ক, হিগ্গস ইত্যাদি ইত্যাদি কণার জন্ম দেয়। টেকেনিকালার তত্ত্বমতে, যেহেতু হিগ্গস কোনো মৌলিক কণা নয়, তাই এর কোয়ান্টাম-কারেকশনেরও দরকার নেই। সমস্যা হলো, অগণিত পরীক্ষণের মাধ্যমে আজ আমরা প্রায় নিশ্চিত যে, ইলেক্ট্রন বা কোয়ার্কের কোনো প্রিয়ন নেই। অর্থাৎ ইলেক্ট্রন, কোয়ার্ক, হিগ্গসেরা সত্যিকার অর্থেই মৌলিক কণা।

SU(5) গেজ-সিমেট্রি ছাড়াও স্ট্যান্ডার্ড-মডেলের বাহিরের দুটি কালো অধ্যায়ের সাথে হিগ্গস-ফিল্ডের সম্পর্ক রয়েছে: ডার্ক-ম্যাটার এবং ডার্ক-এনার্জি।

ডার্ক-ম্যাটারের অন্যতম ফার্মিয়ন প্রার্থী হলো WIMP। মহাবিশ্বের সাধারণ পদার্থের পরিমাণ প্রায় ৫%, এর কারণ হলো বিগ-ব্যাং-নিউক্লিয়োস্যাস্থেসিসের সময় বেশিরভাগ ব্যারিয়নিক কণারা তাদের প্রতিকণাদের সাথে নিউক্লিয়ার-কার্যালাপে জড়িয়ে পড়ে এবং একে অন্যকে বিনাশ করে ফেলে। এই পারস্পরিক ধ্বংসযজ্ঞ শেষ রয়ে যায় মাত্র ৫% ব্যারিয়নিক কণা, যাদের আমরা বলি সাধারণ পদার্থ। অন্যদিকে, WIMP কণা এবং প্রতিকণাদের পারস্পরিক বিনাশের পরিমাণ ছিলো অপেক্ষাকৃত কম। গাণিতিকভাবে ২৫% ডার্ক-ম্যাটার ব্যাখ্যা করতে WIMP কণা এবং প্রতিকণাদের পারস্পরিক বিনাশের পরিমাণ হুবুহু দুর্বল-নিউক্লিয়ার কার্যালাপের সমান। অর্থাৎ, দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্রের প্রভাবে WIMP কণা এবং প্রতিকণাদের পারস্পরিক বিনাশ শেষে অবশিষ্ট WIMPদের পরিমাণ পর্যবেক্ষিত ২৫% ডার্ক-ম্যাটারের সমান। দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্রের সাথে WIMPয়ের এই সম্পর্ককে বলে WIMP-মিরাকেল। এটা স্পস্টতই ইঙ্গিত করে যে, ডার্ক-ম্যাটার কণার যদি WIMP হয়ে থাকে, তবে নিশ্চিতভাবে WIMP কণার তেজস্ক্রিয় ক্ষয় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ডার্ক-ম্যাটারের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হবে।

Screen Shot 2016-08-22 at 8.30.34 PM
পর্যবেক্ষণ মতে, ডার্ক-ম্যাটার কণার তেজস্ক্রিয়-ক্ষয় Z বোসনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। তবে, হিগ্গস বোসনের মাধ্যমে ডার্ক-ম্যাটার কণার তেজস্ক্রিয়-ক্ষয়ের প্রবল সম্ভাবনা আছে। আর এটা যদি সত্যি হয়, তবে ডার্ক-ম্যাটার কণার ভর হিগ্গসের প্রায় কাছাকাছি।

দুর্বল-নিউক্লিয়ার কার্যালাপ ঘটে W-/W+ এবং Z বোসনের মাধ্যমে। ডার্ক-ম্যাটার যেহেতু বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলক্ষেত্রে সাড়া দেয় না, তাই আমরা চার্জযুক্ত W-বোসনকে হিসেব থেকে বাদ দিতে পারি। অন্যদিকে, চলমান পর্যবেক্ষণ থেকে এটাও প্রায় নিশ্চিত যে, WIMP কণা এবং প্রতিকণারা বিনাশে Z-বোসন পাওয়া যায় না। সুতরাং শেষ ভরসা হলো, হিগ্গস-বোসন। ধারণা করা হয় যে, একটি WIMP কণা এবং প্রতিকণা বিনাশ হয়ে হিগ্গস-বোসনে পরিণত হয়। এই হিগ্গস-বোসন প্রায় সাথে সাথে তেজস্ক্রিয়-ক্ষয়ে পরিণত হয় অন্যান্য সাধারণ কণা-প্রতিকণায়।

Screen Shot 2016-08-22 at 8.25.12 PM
ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম: ডানে: WIMP কণা ও প্রতিকণার বিনাশ ঘটে হিগ্গস বোসনে, এই হিগ্গস বোসন দ্রুত পরিণত হয় সাধারণ কণা-প্রতিকণায়। বাঁয়ে: ডানের ডায়াগ্রামটিকে ৯০ডিগ্রী ঘোরালে এই নতুন ডায়াগ্রাম পাওয়া যায়। এই নতুন ডায়াগ্রাম অনুসারে, WIMP এবং সাধারণ কণারা মাঝে মধ্যে নিজেদের ভেতর হিগ্গস আদান-প্রদান করে।

WIMPয়ের গাণিতিক মডেল এটাও ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, WIMP কণারা মাঝে মধ্যেই সাধারণ কণাদের সাথে হিগ্গস-বোসন আদান-প্রদান করে। এর মানে হলো, WIMP কণাদের ভর হিগ্গস-বোসনের কাছাকাছি। আর এই ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর ভিত্তি করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডার্ক-ম্যাটার পর্যবেক্ষণকেন্দ্র LUX (Large Underground Xenon experiment) তৈরি করা হয়।

bernstein4
LUX ডার্ক-ম্যাটার পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র: প্রায় ৩৫০ লিটার জেনন-গ্যাস একটি বিশাল কন্টেইনারে মাধ্যমে নর্থ-ডাকোটার পরিত্যক্ত হোমস্টেক স্বর্ণখনির ভেতরে রাখা হয়েছে। এই স্বর্ণখনির গভীরতা প্রায় দেড় কিলোমিটার। ভূপৃষ্টের এই গভীরতায় কসমিক-রশ্মিসহ অন্যান্য মহাজাগতিক কণা থেকে এক্সপেরিমেন্টকে মুক্ত রাখা যায়। জেনন একটি ভারী নোবেল-গ্যাস, তাই জেননের ওপর সৌর-নিউট্রিনোর প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম। WIMP যদি কখনো জেননের কোয়ার্কগুলোর সাথে হিগ্গস আদান-প্রদান করে, এতে জেননের নিউক্লিয়াস ও ইলেক্ট্রনসহ পুরো পরমাণুই নড়েচড়ে উঠবে। আমরা জানি, ইলেক্ট্রনসহ যেকোনো চার্জযুক্ত কণার চলনে বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ সৃষ্ট হয়। LUXয়ে WIMPয়ের প্রভাবে জেনন পরমাণুর ইলেক্ট্রনগুলোর নড়াচড়া থেকে নির্গত বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করা হয়।

আগেই বলা হয়েছিলো যে, হিগ্গস-ফিল্ডের বিভবশক্তি 246GeV এবং এই শক্তিমাত্রায় হিগ্গস-ফিল্ডের মোটশক্তি সর্বনিম্ন। এই বিভবশক্তি এবং মোটশক্তি দুটোই ভিন্ন জিনিস। হিগ্গস-ফিল্ডের বিভবশক্তির রেখাচিত্র নিচের সমীকরণ থেকে পাওয়া যায়। V(H) হিগ্গস-ফিল্ডের বিভবশক্তি। μ এবং λ যথাক্রমে হিগ্গস-বোসনের ভর এবং হিগ্গস-ফিল্ডের বিভবশক্তি সম্পর্কিত ধ্রুবক।

Screen Shot 2016-08-22 at 8.36.30 PM
হিগ্গস-ফিল্ডের পোটেনশিয়াল এনার্জি কার্ভের সমীকরণ।

হিগ্গস-ফিল্ডের পোটেনশিয়াল এনার্জি রেখাচিত্র অনুসারে, বর্তমান মহাবিশ্বের হিগ্গস-ফিল্ডের মোটশক্তি একটি অস্থায়ী-স্থিতিবস্থায় রয়েছে, যাকে বলে মেটাস্ট্যাবল বা ফলস-মিনিমাম (False minimum)। নিচের রেখাচিত্রে দেখা যাচ্ছে যে, হিগ্গস-ফিল্ডের একাধিক স্থায়ী-স্থিতিবস্থায় রয়েছে যেখানে ফিল্ডের মোটশক্তি বর্তমানের অনেক কম। কিন্তু এই স্থিতিবস্থাগুলোতে হিগ্গসের বিভবশক্তি বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি। যেকোনো কোয়ান্টাম-ফিল্ডের মতোই হিগ্গস-ফিল্ডও চেষ্টা করে মোটশক্তিকে সর্বনিম্ন করার মাধ্যমে স্থায়ী-স্থিতিবস্থায় উপনীত হবার। আর যে প্রক্রিয়ায় হিগ্গস-ফিল্ড স্থায়ী-স্থিতিবস্থায় উপনীত হবার চেষ্টা করে তাকে বলে কোয়ান্টাম-টানেলিং

Screen Shot 2016-08-22 at 8.38.24 PM
স্কেলার-ফিল্ড-থিওরি অনুসারে, হিগ্গস-ফিল্ডের একাধিক স্থায়ী-স্থিতিবস্থা রয়েছে। এই স্থায়ী-স্থিতিবস্থাগুলোতে হিগ্গস-ফিল্ডের মোটশক্তি বর্তমানের চেয়ে কম। যেকোনো কোয়ান্টাম-ফিল্ডের মতোই হিগ্গস-ফিল্ডও চেষ্টা করে সেই স্থায়ী-স্থিতিবস্থায় পৌঁছুতে যেখানে ফিল্ডের মোটশক্তি হবে সর্বনিম্ন।

কোয়ান্টাম-টানেলিং প্রক্রিয়ায় স্থানকালে বিভিন্ন অঞ্চলের হিগ্গস-ফিল্ডে ছোট ছোট বুদ্বুদ তৈরি হয়। হিগ্গস-ফিল্ডে এই বুদ্বুদগুলোতে ফিল্ডের মোটশক্তি অনেক কম (কিন্তু, বিভবশক্তি অত্যন্ত বেশি)। আশপাশের হিগ্গস-ফিল্ডগুলো তাদের মোটশক্তি এই বুদ্বুদ-অঞ্চলগুলোর সমান পর্যায়ে আনতে চায়, ফলে বুদ্বুদগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, একে বলে নিউক্লিয়েশন। নিউক্লিয়েশনের এক পর্যায়ে এই বুদ্বুদগুলো বড় হতে হতে একে অন্যের সাথে মিলিয়ে যেতে শুরু করে। বুদ্বুদগুলো মিলিয়ে গেলে হিগ্গস-ফিল্ডের ফেজ-ট্রান্সিশন বা অস্থায়ী-স্থিতি থেকে স্থায়ী-স্থিতিবস্থায় রূপান্তর সম্পন্ন হয়, অনেকটা বরফ গলে পানিতে পরিণত হবার মতো।

FF7B097_large
কোয়ান্টাম-টানেলিং: এই প্রক্রিয়ার হিগ্গস-ফিল্ডের মোটশক্তিকে উচ্চ-বিভবশক্তি ভেদ করে নিম্ন-মোটশক্তিতে পৌঁছাতে হয়।

আমাদের মহাবিশ্বে হিগ্গস-ফিল্ড যদি কখনো স্থায়ী-স্থিতিবস্থায় পৌঁছে তবে ব্যাপারটা হবে অত্যন্ত বিপর্যয়কর। কারণটা হলো, সত্যিকার স্থিতিবস্থায় হিগ্গস-ফিল্ডের বিভবশক্তি প্রায় প্ল্যাঙ্ক-স্কেলের সমান। আগেই বলা হয়েছিলো যে, ফার্মিয়নদের ভর আসে হিগ্গস-ফিল্ডের সাথে নিউক্লিয়ার-কার্যালাপের মাধ্যমে। প্ল্যাঙ্ক-স্কেলের সমান বিভবশক্তির হিগ্গস-ফিল্ডের সাথে ইন্টারঅ্যাকশনে ফার্মিয়নদের ভর দাঁড়াবে কল্পনাতীত রকমের বেশি। ফলে, মহাবিশ্বের বেশিরভাগ বস্তুই ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে, ঘটবে প্রাণের বিলুপ্তি। পাশাপাশি হিগ্গস-বোসনের সংখ্যা সাধারণ পদার্থকে ছাড়িয়ে যাবে, মহাবিশ্ব পরিণত হবে সম্পূর্ন অপরিচিত জায়গায়।

bubblesj
কোয়ান্টাম-টানেলিংয়ে তৈরি হওয়া হিগ্গস-ফিল্ডের নিউক্লিয়েশনের কাল্পনিক চিত্র।

এক হিসাব অনুসারে, প্রতি দশবিলিয়ন ঘন আলোকবর্ষ অঞ্চলে একটি নিউক্লিয়েশন শুরু সময় লাগে প্রায় দশকোটি বছর। সুসংবাদ হলো, হিগ্গস-ফিল্ডের নিউক্লিয়েশনের লক্ষণ এখনো দেখা যায়নি।

_75952891_75937467
হিগ্গস-ফিল্ডের ফেজ-ট্রান্সিশন: Y-অক্ষে টপ-কোয়ার্কের ভর এবং X-অক্ষে হিগ্গস-বোসনের ভর। হিগ্গস-ফিল্ডের ফেজ-ট্রান্সিশন বর্তমানে কালো বিন্দুটিতে রয়েছে।

হিগ্গস-ফিল্ডের ফেজ-ট্রান্সিশনের পর্যবেক্ষণের একটা উপায় হলো, ফার্মিয়ন এবং হিগ্গস-বোসনের ভরে পরিবর্তন লক্ষ্য করা। বর্তমান মহাবিশ্বে সবচেয়ে ভারী ফার্মিয়ন হলো টপ-কোয়ার্ক, ভর প্রায় 173GeV। হিগ্গস-ফিল্ডের ফেজ-ট্রান্সিশনের সাথে সাথে টপ-কোয়ার্কের ভর বাড়তে থাকবে। হিসেবে অনুসারে হিগ্গস-ফিল্ডের ফেজ-ট্রান্সিশন সম্পন্ন হলে টপ-কোয়ার্কের ভর দাঁড়াবে 200GeVতে।

এই প্রবন্ধের শুরুতেই আমরা দেখেছিলাম, হিগ্গস-মেকানিক্স তৈরিতে অবদান রেখেছিলেন ইয়োশিরো-নাম্বু থেকে শুরু করে গেরার্ড-তুফ পর্যন্ত একাধিক গবেষক। সুতরাং, হিগ্গস-মেকানিক্স কোনো একক ব্যক্তির প্রচেষ্টা নয়। তাই অনেকেই মনে করেন যে, হিগ্গস-বোসন নামটি পাল্টে রাখা উচিত স্কেলার-বোসন।

প্রথম পর্ব: গেজ-সিমেট্রি

অবলম্বনে: “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “The Higgs Boson and Beyond” by “Sean Carroll”