বায়োলজিক্যাল তথ্য আদান-প্রদানের দুটি পদ্ধতি রয়েছে। এন্ডোক্রিন-সিস্টেম (Endocrine system), এই পদ্ধতিতে একাধিক গ্রন্থি হরমোন নিঃসরণের মাধ্যমের দেহের বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এন্ডোক্রিন-সিস্টেমকে তুলোনা করা চলে রেডিও-ব্রডকাস্টের সাথে। বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নির্গত হরমোন রক্তের সার্কেলুটরি-সিস্টেমের (Circulatory system) মাধ্যমের দেহের আনাচে কানাচে পৌঁছে যায়। কিছু কিছু হরমোনের কার্যকারিতা দ্রুত, কয়েক সেকেন্ড লাগে তাদের প্রতিক্রিয়ায়। কিন্তু, বহু ক্ষেত্রে সেকেন্ড অনেক লম্বা সময়। তাই বিবর্তনের ধারায় এন্ডোক্রিন-সিস্টেমের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে দ্বিতীয় পদ্ধতিটি, নার্ভ-সিস্টেম (Nerve system)। নার্ভ-সিস্টেমকে তুলোনা করা চলে ক্যাবল-টিভির সাথে। এন্ডোক্রিন-সিস্টেম যেখানে ব্যবহার করে রাসায়নিক উপাদান, নার্ভ-সিস্টেম সেখানে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করায় নার্ভ-সিস্টেম মিলিসেকেন্ড গতিতে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। নার্ভ-সিস্টেম বৈশিষ্ট্য হলো, নার্ভ-সিস্টেমের তথ্য প্রেরণ ব্রডকাস্টের মাধ্যমের ঘটে না বরং তথ্য একটা নির্দিষ্ট অঙ্গের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়। এই অতিদ্রুত এবং লক্ষ্য-নির্ধারিত তথ্য আদান-প্রদানের জন্য নার্ভ-সিস্টেমের রয়েছে বিশেষায়িত কোষে, নিউরণ।
কাজ ভেদে নিউরণ বিভিন্ন ধরণের হয়। তবে, যেকোনো নিউরণের তিনটি বিশেষ অংশ রয়েছে যেগুলো সাধারণ দেহকোষে থাকে না: ডেনড্রাইট (Dendrite), এক্সন (Axon), এবং সিনাপ্স (Synapse)। আমরা যদি অসিলোস্কোপ কিংবা ভোল্টমিটার দিয়ে যেকোনো দেহকোষের মেমব্রেনের ভেতর ও বাহিরের বৈদ্যুতিক বিভব-পার্থক্য নির্ণয়ের চেষ্টা করি তবে আমরা সামান্য বিভব পার্থক্য দেখবো। মেমব্রেনের ভেতর ও বাহিরের এই বৈদ্যুতিক বিভব-পার্থক্যে বলে মেমব্রেন-পোটেনশিয়াল (Membrane potential)। এই মেমব্রেন-পোটেনশিয়ালের মূল কারণ মেমব্রেনের ভেতর ও বাহিরে চার্জযুক্ত অণুদের ঘনত্বের পার্থক্য। নিউরণ এর ব্যতিক্রম নয়। তবে, মেমব্রেন-পোটেনশিয়ালের ওপর ভিত্তি করে সাধারণ দেহকোষের সাথে নিউরণের তিনটি বড় পার্থক্য আছে। নিউরণের মেমব্রেন-পোটেনশিয়াল পরিবর্তনশীল, এই মেমব্রেন-পোটেনশিয়াল নিউরণের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দ্রুত প্রবাহিত হয়, এবং এক নিউরণ অন্য নিউরণের মেমব্রেন-পোটেনশিয়াল পরিবর্তন করতে পারে। একটা অলস নিউরণের মেমব্রেন পোটেনশিয়ালকে বলে রেস্টিং-পোটেনশিয়াল (Resting potential) যার মান প্রায় নেগেটিভ ৬০মিলি ভোল্ট। রেস্টিং-পোটেনশিয়ালের থাকা নিউরণের এই বৈদ্যুতিক অবস্থাকে বলে পোলারাইজড (Polarized)।
নিউরণের মেমব্রেন-পোটেনশিয়াল নির্ভর করে মূলত দুটি পজিটিভ আয়নের ওপর সোডিয়াম-আয়ন (Na+) এবং পটাসিয়াম-আয়ন (K+)। অলস নিউরণে পটাসিয়াম-আয়নের ঘনত্ব মেমব্রেনের ভেতরে বেশি এবং বাহিরে কম। অন্যদিকে, সোডিয়াম-আয়নের অবস্থা ঠিক উল্টো। পজিটিভ আয়নের ছাড়াও নিউরণে প্রচুর নেগেটিভ আয়ন থাকে, উল্লেখ করার মতো হলো, ক্লোরিন-আয়ন (Cl-)। অন্যান্য নেগেটিভ আয়নগুলো যেমন ফসফেট, কিছু প্রোটিন ইত্যাদিকে ছবিতে (A-) হিসেবে দেখানো হয়েছে।
নিউরণ তার মেমব্রেন-পোটেনশিয়াল নিয়ন্ত্রণ করে এই সোডিয়াম-আয়ন এবং পটাসিয়াম-আয়নের ঘনত্ব পরিবর্তনের মাধ্যমে। আয়নেরা চার্জযুক্ত তাই এরা মেমব্রেন ভেদ করতে পারে না। তাই আয়ন ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিউরণে কিছু মেমেব্রেন-বাউন্ড প্রোটিন থাকে যাদের বলে আয়ন-চ্যানেল (Ion channel)। এই আয়ন-চ্যানেল গুলো অনেকটা নলের মতো মেমব্রেনের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। আয়নেরা এই আয়ন-চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে মেমেব্রেন ভেতরে এবং বাহিরে যাওয়া আসা করতে পারে।
কিছু আয়ন-চ্যানেল যেকোনো আয়নকে মেমেব্রেন পার হতে দেয়। আর, কিছু আয়ন-চ্যানেল শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কোনো আয়নকে মেমেব্রেন পার হতে দেয়। কিছু আয়ন-চ্যানেলদের বলে প্যাসিভ-আয়ন-চ্যানেল (Passive ion channel)। প্যাসিভ-আয়ন-চ্যানেল আয়নদের উচ্চ ঘনত্বযুক্ত অঞ্চল থেকে নিম্ন ঘনত্বযুক্ত অঞ্চলে যেতে দেয়। এই প্রক্রিয়াকে বলে পরিব্যাপ্তি বা ডিফিউশন (Diffusion), এবং এতে কোনো শক্তির প্রয়োজন হয় না। আবার কিছু আয়ন-চ্যানেলদের বলে এক্টিভ-আয়ন-চ্যানেল (Active ion channel), এরা প্যাসিভ-আয়ন-চ্যানেলের ঠিক উল্টো। অর্থাৎ, এরা নিম্ন ঘনত্বযুক্ত অঞ্চল থেকে আয়নদের উচ্চ ঘনত্বযুক্ত অঞ্চল যেতে সাহায্য করে। এক্টিভ-আয়ন-চ্যানেলদের অন্য নাম আয়ন-পাম্প (Ion pump)। আয়ন-পাম্পদের কার্যসিদ্ধির জন্য শক্তির প্রয়োজন। আরেক ধরণের এক্টিভ-আয়ন-চ্যানেল আছে যাদের বলে গেটেড-আয়ন-চ্যানেল (Gated ion channels)। গেটেড-আয়ন-চ্যানেল সাধারণত নিষ্ক্রিয়, এদের দুইভাবে সক্রিয় করা যেতে পারে। কিছু গেটেড-আয়ন-চ্যানেল যখন নিউরোট্রান্সমিটার নামের বিশেষ কিছু অণুর সাথে যুক্ত হয় তখন আয়ন-চ্যানেলগুলোর আকার পরিবর্তন ঘটে, ফলে এই আয়ন-চ্যানেলগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। এদের বলে লিগ্যান্ড-গেটেড-আয়ন-চ্যানেল (Ligand gated ion channels) বা সোজা ভাষায় নিউরোরিসেপ্টর। এদের পাওয়া যায় নিউরণের সিনাপ্স অংশে। আবার কিছু গেটেড-আয়ন-চ্যানেল আছে যারা অনেকটা ডায়োডের (Diode) মতো, মেমেব্রেন-পোটেনশিয়াল নির্দিষ্ট ভোল্টে পৌঁছার সাথে সাথে এই আয়ন-চ্যানেলগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। এদের বলে ভোল্টেজ-গেটেড-আয়ন-চ্যানেল (Voltage gated ion channels)।
প্রশ্ন হতে পারে যে, এই প্যাসিভ-আয়ন-চ্যানেলগুলো বদৌলতে ডিফিউশন প্রক্রিয়ায় মেমব্রেনের ভেতরে ও বাহিরে আয়নদের ঘনত্ব সমান হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু সেটা হয় না কেনো? অলস নিউরণে আয়নদের এই অসম ঘনত্বের জন্য দায়ী দুটি ব্যাপার। প্রথমত, আয়নদের ঘনত্ব নির্ভর করে তাদের রাসায়নিক এবং বৈদ্যুতিক-চার্জ ঘনত্বের ওপর। পটাসিয়াম-আয়নেরা প্যাসিভ-আয়ন-চ্যানেল দিয়ে বেরিয়ে মেমব্রেনের কাছাকাছি জড়ো হতে থাকে। ফলে, মেমব্রেনের কাছাকাছি পজিটিভ বৈদ্যুতিক-চার্জ ঘনত্ব বেশি। এই পজিটিভ বৈদ্যুতিক-চার্জ প্যাসিভ-আয়ন-চ্যানেলের ভেতরে অন্যান্য পটাসিয়াম-আয়নদের বিকর্ষণ করে। তাই, এক পর্যায়ে মেমব্রেনের ভেতরে উচ্চ রাসায়নিক ঘনত্ব থাকা সত্ত্বেও মেমব্রেনের বাহিরের উচ্চ বৈদ্যুতিক-চার্জ ঘনত্বের জন্য পটাসিয়াম-আয়নেরা প্যাসিভ-আয়ন-চ্যানেল পার হতে পারে না। শুধু পটাসিয়াম-আয়ন বিবেচনা করলে অলস নিউরণের রেস্টিং-পোটেনশিয়াল হয় নেগেটিভ ৮৫মিলি ভোল্ট। বলা যায়, অলস নিউরণ থাকে পটাসিয়াম-আয়নের কতৃত্বে।
দ্বিতীয়ত, আয়ন-চ্যানেলজনিত মেমব্রেনের ভেদ্যতা পটাসিয়াম-আয়ন ও সোডিয়াম-আয়নের জন্য সমান নয়। অলস নিউরণে পটাসিয়াম-আয়নের মেমব্রেন-ভেদ্যতা সোডিয়াম-আয়নের চেয়ে ২০গুণ বেশি। তাই, সোডিয়াম-আয়ন চাইলেও বন্যার পানির মতো মেমব্রেনের ভেতর ঢুকতে পারে না। নিউরণে কিছু বিশেষ এক্টিভ-আয়ন-চ্যানেল রয়েছে, নাম সোডিয়াম-পটাসিয়াম-পাম্প। এই সোডিয়াম-পটাসিয়াম-পাম্প ক্রমাগত বেরিয়ে যাওয়া পটাসিয়াম-আয়নদের একপ্রকার ঘাড় ধরে মেমব্রেনের ভেতরে ঢোকায় আর সোডিয়াম-আয়নদের ঘাড় ধরে বের করে দেয়। যখন এই সোডিয়াম-আয়নদের হিসেবে আনা হয় তখন রেস্টিং-পোটেনশিয়াল কমে দাঁড়ায় নেগেটিভ ৬০ মিলিভোল্টে। অর্থাৎ, পজিটিভ সোডিয়াম-আয়ন নেগেটিভ রেস্টিং-পোটেনশিয়ালকে শূন্যের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে চায়। এভাবে নিউরণের রেস্টিং-পোটেনশিয়াল শূন্যের দিকে কমতে থাকাকে বলে ডিপোলারইজেশন (Depolarization)। আর এই ডিপোলারইজেশন একটা নির্দিষ্ট ভোল্টে পৌঁছালে নিউরণের বৈদ্যুতিক অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে।
এবার, নিউরণে ডিপোলারইজেশন প্রক্রিয়াটি দেখা যাক। এখন আমরা একটা অলস নিউরণের সাথে একটা ব্যাটারী সংযুক্ত করবো , যেটা মেমব্রেনের ভেতর ধীরে ধীরে পজিটিভ চার্জ ঢালতে থাকবে। পজিটিভ চার্জ বাড়ার সাথে সাথে নিউরণের রেস্টিং-পোটেনশিয়াল কমতে থাকবে। কমতে কমতে যখন ৪৫মিলিভোল্ট থেকে ৫৫মিলিভোল্টের মধ্যে চলে আসে, যাকে বলে থ্রেশহোল্ড-ভ্যালু (Threshold value), তখন মেমব্রেন পোটেনশিয়াল হুট করে প্রায় পজিটিভ ৫০মিলি ভোল্টে পৌঁছে যায়। এই উচ্চ পজিটিভ মেমব্রেন-পোটেনশিয়ালকে বলে অ্যাকশন-পোটেনশিয়াল (Action potential)। অ্যাকশন-পোটেনশিয়াল প্রায় ১ থেকে ২ মিলিসেকেন্ড পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই অ্যাকশন-পোটেনশিয়ালে পৌঁছানো নিউরণদের বলে সক্রিয় নিউরণ।
অ্যাকশন-পোটেনশিয়ালের জন্য দায়ী দুটি ভোল্টেজ-গেটেড-আয়ন-চ্যানেল, একটি সোডিয়াম-আয়নের এবং অন্যটি পটাসিয়াম-আয়নের। সোডিয়ামের এই আয়ন-চ্যানেলটি অপেক্ষাকৃত দ্রুত। এই আয়ন-চ্যানেলের দুটি দরজা বা গেট আছে। সক্রিয় হবার সাথে সাথে এদের এক্টিভেশন-গেটটি খুলে যায়, ফলে সোডিয়াম-আয়নের মেমব্রেন ভেদ্যতা বেড়ে যায়। নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ইনএক্টিভেশন-গেটটি বন্ধ হয়ে যায়, ফলে সোডিয়াম-আয়নেরা এই চ্যানেলটি আর ব্যবহার করতে পারে না। ডিপোলারইজেশন প্রক্রিয়াটি যখন মেমেব্রেন-পোটেনশিয়ালকে থ্রেশহোল্ড-ভ্যালুতে নিয়ে যায়, সাথে সাথে সোডিয়াম-আয়নের ভোল্টেজ-গেটেড-চ্যানেলটির এক্টিভেশন-গেট খুলে যায়। ফলে, তুমুল বেগে সোডিয়াম-আয়ন মেমব্রেনের ভেতর প্রবেশ করে। এই বিপুল পরিমাণের পজিটিভ সোডিয়াম-আয়নের কারণে মেমব্রেন-পোটেনশিয়াল অ্যাকশন-পোটেনশিয়ালে উন্নীত হয়। সোডিয়াম-আয়নের ভোল্টেজ-গেটেড-চ্যানেলের বৈশিষ্ট্য হলো, এদের সক্রিয়তা খুব ক্ষণস্থায়ী, প্রায় ১ থেকে ২ মিলিসেকেন্ড পর্যন্ত। মেমেব্রেন-পোটেনশিয়াল যাই হোক না কেনো এই ১ থেকে ২ মিলিসেকেন্ডের পরপরই এই চ্যানেলটির ইনএক্টিভেশন-গেটটি বন্ধ হয়ে যায়। একবার ইনএক্টিভেশন-গেটটি বন্ধ হয়ে গেলে চ্যানেলটি কয়েক মিলিসেকেন্ড পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় থাকে, চাইলেও এই সময়টাতে চ্যানেলটিকে সক্রিয় করা যায় না। সোডিয়াম-আয়নের ভোল্টেজ-গেটেড-চ্যানেলের এই বাধ্যতামূলক নিষ্ক্রিয় সময়টাকে বলে রিফ্রাক্টরি-পিরিয়ড (Refractory period)। থ্রেশহোল্ড-ভ্যালু পার হবার সাথে সাথে সোডিয়াম-আয়নের মেমব্রেন-ভেদ্যতা পটাসিয়াম-আয়নের চেয়ে বেশি হয়ে পরে। ফলে, সক্রিয় নিউরণ চলে যায় সোডিয়াম-আয়নের কতৃত্বে।
যা হোক, সোডিয়াম-আয়নের ভোল্টেজ-গেটেড-চ্যানেলটি বন্ধ হবার সাথে সাথে পটাসিয়াম-আয়নের ভোল্টেজ-গেটেড-চ্যানেলটি খুলে যায়। ফলে, হু হু করে পটাসিয়াম-আয়ন নিউরণ থেকে বেরিয়ে যায়। বিপুল পরিমাণের পজিটিভ পটাসিয়াম-আয়ন হারানোর কারণে মেমব্রেন-পোটেনশিয়াল কমতে থাকে। এমনকি এক পর্যায়ে, মেমব্রেন-পোটেনশিয়াল কমে গিয়ে রেস্টিং-পোটেনশিয়ালের নিচে নেমে যায়। মেমব্রেন-পোটেনশিয়াল প্রায় নেগেটিভ ৮৫মিলি ভোল্টে কাছাকাছি পৌছে গেলে পটাসিয়াম-আয়নের ভোল্টেজ-গেটেড-চ্যানেলটি বন্ধ হয় যায়। এরপর, প্যাসিভ-আয়ন-চ্যানেল ও সোডিয়াম-পটাসিয়াম-পাম্পের কল্যাণে মেমব্রেন-পোটেনশিয়াল ধীরে ধীরে রেস্টিং-পোটেনশিয়ালে স্থির হয় এবং সোডিয়াম-আয়ন ও পটাসিয়াম-আয়নের ঘনত্ব আগের অবস্থায় ফিরে যায়। নিউরণের রেস্টিং-পোটেনশিয়াল থেকে অ্যাকশন-পোটেনশিয়ালে যাওয়াকে চারটি ধাপে নিচে দেখানো হলো।
ডিপোলারইজেশন প্রক্রিয়াটি শুরু হয় নিউরণের একটা বিশেষ অংশ থেকে, নাম এক্সন-হিল্যক (Axon hillock)। এক্সন-হিল্যকের অ্যাকশন-পোটেনশিয়াল তার পাশের অংশকে ডিপোলারইড হতে সাহায্য করে, ফলে, পুরো এক্সন জুড়ে অ্যাকশন-পোটেনশিয়াল তরঙ্গের মতো প্রবাহিত হতে থাকে। এই তরঙ্গ এক্সন-হিল্যক থেকে শুরু করে সিনাপ্সে এসে পৌঁছে। অ্যাকশন-পোটেনশিয়ালের এই প্রবাহ একমুখী। সোডিয়াম-আয়নের ভোল্টেজ-গেটেড-চ্যানেলটির রিফ্রাক্টরি-পিরিয়ডের কারণে অ্যাকশন-পোটেনশিয়াল উল্টো দিকে প্রবাহিত হতে পারে না।
নিচে অ্যাকশন-পোটেনশিয়াল সঞ্চালন ছবির মাধ্যমে দেখানো হলো। এই সঞ্চালন একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া, বোঝার সুবিধার জন্য ভেঙ্গে ভেঙ্গে দেখানো হলো।
একটি নিউরণ তার এক্সন-প্রান্তের (Axon terminal) মাধ্যমে অন্য নিউরণের ডেনড্রাইটের সাথে যুক্ত থাকে। এই এক্সন এবং ডেনড্রাইট সংযোগস্থলকে বলে সিনাপ্স। ইনভার্টিব্রেট (Invertebrate) প্রাণীর ক্ষেত্রে এক্সন এবং ডেনড্রাইট সরাসরি আয়ন-চ্যানেলের মাধ্যমে যুক্ত থাকে, এই ধরণের সিনাপ্সকে বলে বৈদ্যুতিক-সিনাপ্স (Electrical synapse)। কিন্তু, ভার্টিব্রেট প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই বৈদ্যুতিক-সিনাপ্স অত্যন্ত বিরল। ভার্টিব্রেট সিনাপ্সে দুটি নিউরণের মেমব্রেনের মাঝে খুব সামান্য ফাঁক থাকে, একে বলে সিনাপ্টিক-ক্লেফ্ট (Synaptic cleft)। অ্যাকশন-পোটেনশিয়াল এই সিনাপ্টিক-ক্লেফ্টে এসে পৌঁছালে বৈদ্যুতিক-সিগন্যাল রাসায়নিক-সিগন্যালে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ, সিনাপ্সে নিউরণেরা বৈদ্যুতিক উপায়ের পরিবর্তে রাসায়নিক উপায়ে তথ্য আদান-প্রদান করে। সিনাপ্সের সাপেক্ষে যে নিউরণ থেকে অ্যাকশন-পোটেনশিয়াল শুরু হয় তাকে বলে প্রিসিনাপ্টিক-নিউরণ (Presynaptic neuron) আর যে নিউরণে এসে পৌঁছে তাকে বলে পোস্টসিনাপ্টিক-নিউরণ (Presynaptic neuron)। সিনাপ্টিক-ক্লেফ্টের বিস্তার প্রায় ২০ থেকে ৪০ন্যানোমিটার। এই ক্ষুদ্র ব্যবধানের কারণে সিনাপ্টিক-সিগন্যালিং ঘটে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে।
সিনাপ্সের কাছাকাছি অঞ্চলে প্রচুর নিউরোট্রান্সমিটার একধরণের ক্যাপসুলের মধ্যে আটকে থাকে। এই ক্যাপসুলদের বলে সিনাপ্টিক-ভেসিকেল (Synaptic vesicle)। এই সিনাপ্টিক-ভেসিকেলগুলো সিনাপ্সের আশেপাশে ভাসতে বেড়ায়। সিনাপ্টিক-ভেসিকেল মূলত ফসফোলিপিডের তৈরি একধরণের প্যাকেজিং। প্রিসিনাপ্টিক-নিউরণে অ্যাকশন পোটেনশিয়াল সিনাপ্সের কাছাকাছি এসে পৌঁছালে ক্যালসিয়াম-আয়ন (Ca2+) এই সিনাপ্টিক-ভেসিকেলগুলোকে সিনাপ্টিক-ক্লেফ্টের দিকে ঠেলে দেয়। কোষের মেমব্রেনও ফসফোলিপিডের তৈরি, তাই সিনাপ্টিক-ভেসিকেলগুলো মেমব্রেন স্পর্শ করার সাথে সাথে মেমব্রেনের সাথে মিশে যায় এবং নিউরোট্রান্সমিটারদের সিনাপ্টিক-ক্লেফ্টে মুক্ত করে দেয়।
পোস্টসিনাপ্টিক-নিউরণের মেমব্রেনে সিনাপ্স বরাবর প্রচুর লিগ্যান্ড-গেটেড-আয়ন-চ্যানেল বা নিউরোরিসেপ্টর যুক্ত থাকে। নিউরোট্রান্সমিটারের সাথে যুক্ত হবার ফলে এই নিউরোরিসেপ্টরগুলোর সক্রিয় হয়ে পরে। অর্থাৎ, নিউরোরিসেপ্টরগুলোর খুলে যায় এবং বিভিন্ন আয়নেরা পোস্টসিনাপ্টিক-নিউরণের ঢুকে পরতে শুরু করে। এতে পোস্টসিনাপ্টিক-নিউরণের ডিপোলারইজেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়।
একটি সিনাপ্সের কার্যকারিতা অবস্থা ভেদে দুই ধরণের হতে পারে। উদ্দীপক বা দমনমূলক। বিশেষ কিছু নিউরোট্রান্সমিটার যুক্ত হওয়ায় নিউরোরিসেপ্টর আয়ন-চ্যানেলগুলো খুলে যায়, ফলে সোডিয়াম-আয়ন পোস্টসিনাপ্টিক-নিউরণের ঢুকে পরে এবং ডিপোলারইজেশন শুরু হয়। ডিপোলারইজেশন দ্রুততর করে এমন সিনাপ্সকে বলে উদ্দীপক-সিনাপ্স (Excitatory synapse)। অন্যদিকে, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের নিউরোট্রান্সমিটার যুক্ত হওয়ায় ইতিমধ্যে খুলে থাকে নিউরোরিসেপ্টরগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে, সোডিয়াম-আয়ন পোস্টসিনাপ্টিক-নিউরণে ডিপোলারইজেশন ঘটাতে পারে না। এদের বলে দমনমূলক সিনাপ্স (Inhibitory synapse), দমনমূলক-সিনাপ্স ডিপোলারইজেশনে বাধা দেয়।
আমরা দেখেছি, রেস্টিং-পোটেনশিয়াল থেকে থ্রেশহোল্ড-ভ্যালুতে যেতে প্রয়োজন পজিটিভ ৫ থেকে ১০মিলিভোল্টের। কিন্তু, একটি সিনাপ্স ডিপোলারইজেশন করতে পারে পজিটিভ ১ থেকে ২মিলিভোল্ট পরিসরে। অর্থাৎ, শুধু একটি সিনাপ্স পুরো একটা নিউরণকে এক চেষ্টাতেই অ্যাকশন-পোটেনশিয়ালে নিয়ে যেতে পারেনা। একটি নিউরণে প্রায় হাজার খানেক সিনাপ্টিক-প্রান্তের মাধ্যমে একাধিক নিউরণের সাথে যুক্ত থাকে। এর মধ্যে কিছু সিনাপ্স উদ্দীপক আর কিছু দমনমূলক। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে একটি নিউরণের অ্যাকশন-পোটেনশিয়ালে যাওয়া কিংবা না যাওয়া নির্ভর করে এই হাজার হাজার সিনাপ্সের মিলিত ডিপোলারইজেশনের ওপর, এই পদ্ধতিকে বলে সঙ্কলন (Summation)।
এই সিনাপ্টিক-সঙ্কলন হতে পারে দুই ধরণের। সময়-নির্ভর। আগে বলা হয়েছিলো, সিনাপ্টিক-সিগন্যালিং অতিদ্রুত। কিন্তু, একটি সিনাপ্স যদি এরচেয়েও দ্রুততার সাথে উদ্দীপ্ত হতে থাকে তবে প্রতিটি উদ্দীপনার ডিপোলারইজেশনগুলো যোগ হতে হতে একসময় থ্রেশহোল্ড-ভ্যালু অতিক্রম করে, ফলে নিউরণ অ্যাকশন-পোটেনশিয়ালে পৌঁছে যায়। এই সময়-নির্ভর সঙ্কলন ব্যবহার করে বায়োলজিক্যাল তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণকে বলে টেম্পোরাল-সিনাপ্টিক-ইন্টিগ্রেশন (Temporal synaptic integration)। অন্য ধরণটি হলো, স্থান-নির্ভর। একাধিক উদ্দীপ্ত সিনাপ্সের ছোট ছোট ডিপোলারইজেশনগুলো যোগ হয়ে নিউরণকে অ্যাকশন-পোটেনশিয়ালে নিয়ে যেতে পারে। এই ধরণের তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণকে বলে স্পেটিয়াল-সিনাপ্টিক-ইন্টিগ্রেশন (Spatial synaptic integration)।
যেকোনো সিনাপ্টিক-ইন্টিগ্রেশনের সময় দমনমূলক-সিনাপ্সগুলোকে হিসাবে আনা দরকার। কারণ, দমনমূলক-সিনাপ্সগুলো নিউরণকে অ্যাকশন-পোটেনশিয়ালে যেতে বাধা দেয়।
এতক্ষণ আমরা দেখলাম কিভাবে নার্ভ-সিস্টেম তথ্য সঞ্চালন ও প্রক্রিয়াজাত করে। এবার আমরা দেখবো নার্ভ-সিস্টেমের তথ্য সংরক্ষণ করার পদ্ধতি। নার্ভ-সিস্টেমের তথ্য সংরক্ষণ পদ্ধতির আধুনিক তত্ত্বের প্রবক্তা নিউরোসাইকোলজিস্ট ডোনাল্ড হেব্ব (Donald Olding Hebb)। তিনি ১৯৪৯ সালে স্মৃতি সংরক্ষণের হেবিয়ান-মডেল (Hebbian model) সম্পর্কে ধারণা দেন। এই হেবিয়ান-মডেলের ওপর ভিত্তি করে বর্তমানে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ধারণাটি গড়ে উঠেছে, যার নাম লং-টার্ম-পোটেনশিয়েশন বা LTP (Long term potentiation)।
সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের কল্যাণে সিনাপ্সের প্রতিক্রিয়াশীলতা ওঠা নামা করে। সিনাপ্সের প্রতিক্রিয়াশীলতা এই ওঠা নামা বা পরিবর্তনশীলতাকে বলে সিনাপ্টিক-নমনীয়তা (Synapse plasticity)। কিছু কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের কারণে সিনাপ্সের প্রতিক্রিয়াশীলতা কমে যায়, এদের বলে দুর্বল-সিনাপ্স (Weak synapse)। আবার কিছু নিউরোট্রান্সমিটার সিনাপ্সের প্রতিক্রিয়াশীলতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়, এদের বলে শক্তিশালী-সিনাপ্স (Strong synapse)। কিছু কিছু শক্তিশালী-সিনাপ্স দীর্ঘমেয়াদী হয়। এই দীর্ঘমেয়াদী শক্তিশালী-সিনাপ্সগুলোর জন্য দায়ী একটি নিউরোট্রান্সমিটার নাম গ্লুটামেট (Glutamate)। এই গ্লুটামেটের দুটি নিউরোরিসেপ্টর আছে, AMPA-গ্লুটামেট-রিসেপ্টর এবং NMDA-গ্লুটামেট-রিসেপ্টর। বলে রাখা ভালো, একটি নিউরোট্রান্সমিটার একাধিক নিউরোরিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হতে পারে।
AMPA এবং NMDA দুটোই সোডিয়ামের গেটেড-আয়ন-চ্যানেল। NMDA-এর দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, NMDA সোডিয়াম-আয়নের পাশাপশি ক্যালসিয়াম-আয়নকেও প্রবেশ করতে দেয়। এবং NMDA আয়ন-চ্যানেলের আশপাশে প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম-আয়ন জড়ো হয়ে থাকে, ফলে গ্লুটামেট চাইলেও NMDA-এর সাথে যুক্ত হতে পারে না। তাই প্রথমে, গ্লুটামেট AMPA আয়ন-চ্যানেলের সাথে যুক্ত হয় এবং সিনাপ্সকে ডিপোলারইজেশন করতে শুরু করে। এই ডিপোলারইজেশন প্রক্রিয়াটি NMDA আশপাশের ম্যাগনেসিয়াম-আয়নকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয়। ফলে, গ্লুটামেট স্বাধীনভাবে NMDA আয়ন-চ্যানেলের সাথে যুক্ত হয়ে এদের সক্রিয় করে তোলে। এই সক্রিয় NMDA আয়ন-চ্যানেলগুলো দিয়ে সোডিয়াম-আয়নের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম-আয়নও নিউরণে প্রবেশ করে।
সিনাপ্স শক্তিশালীকরণের মুদ্রা হলো ক্যালসিয়াম-আয়ন। ক্যালসিয়াম-আয়ন যেকোনো কোষের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেকেন্ড-ম্যাসেঞ্জার। এই ক্যালসিয়াম-আয়ন সিনাপ্সের নমনীয়তা বৃদ্ধি করে, ফলে সিনাপ্সের হয়ে ওঠে শক্তিশালী। নার্ভ-সিস্টেম তার বিলিয়ন বিলিয়ন সিনাপ্সগুলোতে ক্রমাগত ক্যালসিয়াম-আয়ন জমানোর মাধ্যমে বায়োলজিক্যাল তথ্যে সংরক্ষণ করে ।
মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে যে, আমাদের স্মৃতিগুলো আসলে ২০ থেকে ৪০ ন্যানোমিটার ফাঁক দিয়ে পাচার হওয়া ক্যালসিয়াম-আয়ন ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনাকে যদি কোনো অসহনীয় স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায় তবে মনে রাখবেন এই স্মৃতি আপনার সিনাপ্সের আটকে পরা কিছু অসভ্য ক্যালসিয়াম মাত্র।
অবলম্বনে: “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “Biology: The Science of Life” by “Stephen Nowicki”