দেহের রণকৌশল: ইমিউনিটি-সিস্টেম

আমাদের শরীর একটা দুর্গের মতো। অণুজীবদের জীবনের ঝুঁকি নিতে হয় এই দুর্গে প্রবেশ করতে। প্রতিদিন কোটি কোটি আণুবীক্ষণিক প্রাণ নিঃশেষ হয় এই দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাছে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, কিংবা রোগ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক উপাদানদের বলে প্যাথোজেন (Pathogen)। এই প্যাথোজেনদের দূরে রাখতে প্রথমেই রয়েছে চামড়া। মেরূদণ্ডী বা ভার্টিব্রেট প্রাণীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক অঙ্গ হলো এই চামড়া। আমাদের ওজনের প্রায় ১৫% চামড়া। চামড়ার একটি জটিল বহুস্তর বিশিষ্ট অঙ্গ। এর সবচেয়ে বাহিরের স্তরে রয়েছে ক্যরেটিন (Keratin) নামক এক প্রোটিন, যেটা চামড়াকে আঘাত সহ্য করার অসামান্য দৃঢ়তা দেয়। চামড়া একটা দ্রুত বর্ধনশীল টিস্যু। চামড়া বাহিরের স্তর ক্রমাগত পরিবেশের সাথে লড়াই করে খসে পরে আর নিচের অপেক্ষাকৃত নতুন টিস্যুগুলো তাদের শূন্যস্থান পূরণ করে। চামড়ায় রয়েছে প্রচুর ঘাম ও তৈল গ্রন্থি, যেগুলো থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক উপাদান অণুজীবদের বেড়ে ওঠার জন্য প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করে। ঘামে রয়েছে লাইসোজাইম (Lysozyme) এনজাইম যেটা অণুজীবের কোষের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলে। চামড়া অত্যন্ত অ্যাসিডিক, এর মাত্রা Ph৩ থেকে Ph৫ এর মাঝামাঝি, ফলে চামড়া অণুজীবদের জন্য মোটেও সুখকর জায়গা নয়।

চামড়া এড়িয়ে শরীরে প্রবেশের অন্য রাস্তাগুলো হলো খাদ্যনালী, শ্বাসনালী, এবং রেক্টো-জেনিটাল-নালী বা পায়ু-যৌন পথ। এদের প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। । খাদ্যনালীর প্রথমেই রয়েছে মুখ। মুখের লালাতেও রয়েছে লাইসোজাইম। এই লালায় আটকে পরা প্যাথোজেনদের মুখ সরাসরি পাঠিয়ে দেয় পাকস্থলীতে। পাকস্থলীর হাইড্রোক্লোরিক-অ্যাসিড এবং প্রোটিন হজমকারী এনজাইমগুলো প্যাথোজেনদের ধ্বংস করে ফেলে। কিছু কিছু প্যাথোজেন অবশ্য পাকস্থলীর এই চরম পরিস্থিতিতেও টিকে যেতে পারে, কিন্তু, এদের জন্যও রয়েছে অন্য চমক। আমাদের পাকস্থলীতে কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া বাস করে, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো তাদের উপযোগী খাবার নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে। নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থেই এরা বহিরাগত প্যাথোজেনদের প্রতিহত করে। অন্যদিকে, শ্বাসনালীর এবং রেক্টো-জেনিটাল নালীতে নি:সরণ হয় মিউকাস (Mucus)। মিউকাসে রয়েছে অত্যন্ত আঠালো মিউসিন (Mucin) প্রোটিন, যার কাজ হলো প্যাথোজেনদের মাকড়সার জলের মতো আটকে ফেলা। মিউকাস তৈরি পাশাপাশি শ্বাসনালীর কোষগুলোতে রয়েছে ছোট ছোট চুলের মতো অগণিত সিলিয়া (Cilia)। এই সিলিয়াগুলো ক্রমাগত ছন্দের সাথে সাথে দুলতে থাকে। এই দুলতে থাকা সিলিয়াগুলো মিউকাস এবং মিউকাসে আটকে পরা প্যাথোজেনদের ঠেলে শ্বাসনালীর বাহিরে পাঠিয়ে দেয়। শ্বাসনালী কিংবা রেক্টো-জেনিটাল-নালীর মিউকাসে আটকে পরা প্যাথোজেনদের হয় শরীর থেকে বেরিয়ে যায়, নতুবা অ্যাসিডিক উপাদান ও বিভিন্ন এনজাইমের সংস্পর্শে এসে মারা যায়।

এই প্রথম সারির প্রতিরক্ষা বেষ্টনী অতিক্রম করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। যদি কোনোভাবে বহিরাগত প্যাথোজেনেরা শরীরের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যায় তবে তাদের মুখোমুখি হতে হয় দ্বিতীয় সারির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে। এই দ্বিতীয় সারির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নির্ভর করে রক্তের বিশেষ কোষের ওপর। এই বিশেষ কোষদের বলে শ্বেতকণিকা (White blood cell)। শ্বেতকণিকা ভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তিনটি ধাপ আছে। শনাক্তকরণ (Recognition), সমাবেশ (Mobilization), এবং প্রত্যাখ্যান (Rejection)। বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল-চিহ্নের মাধ্যমের শ্বেতকণারা বহিরাগত প্যাথোজেনদের শরীরের নিজস্ব কোষদের থেকে আলাদাভাবে চিনতে পারে। এই শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া দুই ধরণের হতে পারে, স্থূল-শনাক্তকরণ (None specific) প্রক্রিয়ায় শ্বেতকণারা প্যাথোজেনদের শুধু “নিজ” কিংবা “বহিরাগত” এই দুইভাগে ভাগ করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি বহিরাগতকে সমান দৃষ্টিতে দেখা হয়। আর সূক্ষ্ম-শনাক্তকরণ (Specific) প্রক্রিয়ায় শ্বেতকণারা ভিন্ন ভিন্ন বহিরাগত প্যাথোজেনদের আলাদা আলাদাভাবে চিনতে পারে। শুধুই স্থূল-শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বলে সহজাত বা ইনেট-ইমিউনিটি-সিস্টেম (Innate immunity system)। আর সূক্ষ্ম-শনাক্তকরণ ভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বলে অর্জিত বা অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেম (Acquired immunity system)। অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটির দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, বিভিন্ন প্যাথোজেনদের আলাদা আলাদাভাবে শনাক্ত করা হয়। ফলে, ভিন্ন ভিন্ন প্যাথোজেনদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন  প্রতিক্রিয়া বা ইমিউনিটি-রেসপন্স তৈরি হয়। এবং কোনো প্যাথোজেনকে প্রথমবার শনাক্ত করা হলে এই শনাক্তকরণ তথ্য সংরক্ষণ করা হয়, তাই  ওই প্যাথোজেন যদি আবার ফিরে আসে তবে  ইমিউনিটি-রেসপন্স হয় অতিদ্রুত।

সার্কেলুটরি-সিস্টেম (Circulatory system) থেকে চুইয়ে রক্ত শরীরের বিভিন্ন কোষের ছড়িয়ে পরে এবং গুরুত্বপূর্ণ রসদ সরবরাহ করে। কাজ শেষে এই রক্ত সংগ্রহ করা হয় লিম্ফেটিক-সিস্টেমের (Lymphatic system) মাধ্যমে। লিম্ফেটিক-সিস্টেম হলো শরীরের ড্রেইন-সিস্টেম (Drain system)। এই লিম্ফেটিক-সিস্টেমে রয়েছে প্রচুর লিম্ফেটিক-নালী, যারা যুক্ত থাকে কিছু লিম্ফ-নোডের সাথে (Lymph nodes)। আর লিম্ফ-নোডগুলো পুরো লিম্ফেটিক-সিস্টেমকে যুক্ত করে সার্কেলুটরি-সিস্টেমের সাথে। শ্বেতকণাদের বলা হয় লিউকোসাইট (Leukocytes)। যদিও লিউকোসাইটেরা রক্তের অংশ এরা বেশীরভাগ সময়ই সার্কেলুটরি-সিস্টেম ছেড়ে ঘুরে বেড়ায় কোষের মধ্যকার ফাঁকা অংশের তরলের মাঝে, যাকে বলে ইন্টারস্টিশিয়াল-ফ্লুইড (Interstitial fluid)। অনেকটা পুলিশের টহল দেবার মতো। টহল দেয়া শেষ হলে এরা আবার সার্কেলুটরি-সিস্টেমে ফিরে আসে লিম্ফেটিক-সিস্টেমের মাধ্যমে।

ইনেট-ইমিউনিটি জন্য রয়েছে প্রধানত তিন ধরণের লিউকোসাইট। প্রথমটি হলো নিউট্রােফিল (Neutrophils), এরা ফ্যাগোসাইট। এক অণুজীব যখন অন্য অণুজীবকে গিলে ফেলে তখন এই খাদকদের বলে ফ্যাগোসাইট (Phagocytes), আর এই গিলে ফেলা প্রক্রিয়াকে বলে ফ্যাগোসাইটোসিস (Phagocytosis)। নিউট্রােফিলেরা প্যাথোজেন পেলে গিলে ফেলে এবং গিলে ফেলার পরপরই নিউট্রােফিলেরা মারা যায়। এরা আত্মঘাতী যোদ্ধা। লিউকোসাইটদের ৬০% থেকে ৭০% নিউট্রােফিল। শরীরের সংক্রামিত বা ক্ষতিগ্রস্ত কোষেগুলো বিভিন্ন প্রোটিন নি:সরণের মাধ্যমের সাহায্যের আবেদন জানায়। আর এই সাহায্যের আবেদনে সবার প্রথমে হাত বাড়িয়ে দেয় নিউট্রােফিলেরা, এরা এরা অতিদ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্যাথোজেনদের বাছবিচার ছাড়াই গিলতে শুরু করে।

নিউট্রােফিলদের পরপরই এসে হাজির হয় আরেক ধরণের লিউকোসাইট, নাম ম্যাক্রোফেজ (Macrophase)। এরা বিশাল, দীর্ঘস্থায়ী, কিন্তু সংখ্যায় কম। এরা সাধারণত নিক্রিয় অবস্থায় থাকে, যখন দরকার হয় শরীর এদের সক্রিয় করে তোলে, ফলে ম্যাক্রোফেজের ইমিউনিটি-রেসপন্স ধীর। নিউট্রােফিলদের মতোই ম্যাক্রোফেজেরাও ফ্যাগোসাইট। কিন্তু প্যাথোজেন গিলে ফেলার কারণে এরা মারা যায় না। বরং, ম্যাক্রোফেজেরা প্যাথোজেনদের হজম করে ফেলে এবং হজম শেষে লিম্ফ-নোডে ফিরে আসে। ম্যাক্রোফেজেরা পাইরোজেন (Pyrogen) নামের কিছু প্রোটিন নি:সরণ করে যেটা সার্কেলুটরি-সিস্টেমের মাধ্যমের মস্তিস্কের হাইপোথ্যালামাসের (hypothalamus) বিশেষ কিছু কোষকে উদ্দীপ্ত করে। হাইপোথ্যালামাসের এই কোষগুলোর কাজ শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা। পাইরোজেনের কারণে হাইপোথ্যালামাস শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়, ফলে জ্বর অনুভূত হয়।

ইনেট-ইমিউনিটি-সিস্টেমের তৃতীয় লিউকোসাইট হলো ন্যাচারাল-কিলার-সেল (Natural-killer-cell)। এরা কিন্তু ফ্যাগোসাইট নয়, এদের বলে লিম্ফেটিক-লিউকোসাইট। ন্যাচারাল-কিলার-সেল প্যাথোজেনদের মেমব্রেনে পার্ফোরিন (Perforines) নামের বিশেষ ধরণের প্রোটিন লাগিয়ে দেয়। এই প্রোটিন প্যাথোজেনদের মেমব্রেন গলিয়ে দেয়, ফলে প্যাথোজেনদের কোষ ফেঁটে যায়। ভাইরাস আক্রান্ত এবং প্রি-ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে এই ন্যাচারাল-কিলার-সেল অত্যন্ত কার্যকর।

কমপ্লিমেন্টারি-সিস্টেম (Complementary system) নামের প্রায় ২০টি প্রোটিনের একটা দলও এই ইনেট-ইমিউনিটি-সিস্টেমের অংশ। এই প্রোটিনগুলো কাজ অনেকটা ন্যাচারাল-কিলার-সেলের মতো। কমপ্লিমেন্টারি-সিস্টেমের কিছু প্রোটিন প্রথমে প্যাথোজেনের মেমব্রেনে আটকে যায়। এরপর এই প্রোটিনগুলোর সাথে যুক্ত হয় অন্যান্য প্রোটিনেরা। প্রোটিনগুলো মেমব্রেনে গলিয়ে ফেলে, ফলে প্যাথোজেনের কোষ ফেঁটে যায়। ইনেট-ইমিউনিটি-সিস্টেমের অংশ হিসেবে আক্রান্ত কোষ ইন্টারফেরন (Interferons) নামের একধরণের প্রোটিন নি:সরণ করে। এই প্রোটিন অনেকটা বিপদসংকেত মতো। ইন্টারফেরান শনাক্ত করার সাথে সাথে আশেপাশের কোষগুলো সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহতের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ইনেট-ইমিউনিটি-রেসপন্সের ফলে শরীরে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে বলে প্রদাহ (Inflammation)। এই প্রদাহে শরীরের আক্রান্ত অংশটিতে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায় ফলে জায়গাটি ফুলে যায় এবং গরম হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে, অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেমের অংশ নেয়া শ্বেতকণাদের বলে লিম্ফোসাইট (Lymphocyte)। লিম্ফোসাইটেরা দুই শ্রেণীর, বি-সেল (B-cell) এবং টি-সেল (T-cell)। এই দুই শ্রেণীর লিম্ফোসাইটদের কাজের ওপর ভিত্তি করে অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেমকে দুই অংশে ভাগ করা হয়। বি-সেল ভিত্তিক হিউমোরাল-ইমিউনিটি (Humoral components) এবং টি-সেল ভিত্তিক সেলুলার-ইমিউনিটি (Cell mediated immunity)। বি-সেলের জন্ম এবং পরিণত হওয়া লাভ করে অস্থি মজ্জায় (Bone marrow)। আর, টি-সেলের জন্ম অস্থি মজ্জায় কিন্তু এরা পরিণত লাভ করে হৃৎপিণ্ডের ঠিক ওপরের ছোট একটা গ্রন্থি থাইম্যাসে (Thymus)।

লিম্ফোসাইটের শরীরের সার্কেলুটরি-সিস্টেম, লিম্ফেটিক-সিস্টেম, এবং ইন্টারস্টিশিয়াল-ফ্লুইড সবজায়গাতেই টহল দিয়ে বেড়ায়। প্যাথোজেনেরা শরীরে ঢুকে পড়লে টহলরত লিম্ফোসাইটের সাথে আটকে যায়। প্যাথোজেনের সাথে লিম্ফোসাইটের আটকে যাবার ব্যাপারটা খুবই সুনির্দিষ্ট। প্যাথোজেনদের মেমব্রেন-পৃষ্টে  স্বাতন্ত্র্যসূচক বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল-চিহ্ন থাকে। এই বায়োলজিক্যাল-চিহ্নগুলো হলো মেমব্রেনে অবস্থিত বিভিন্ন অণু, যেটা দেখে বাহির থেকেই ওই প্যাথোজেনদের আলাদা করে চেনা যায়। বায়োলজিক্যাল-চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত এই অণুদের বলে এন্টিজেন (Antigen)। একটি প্যাথোজেনের মেমব্রেনে একাধিক এন্টিজেন থাকতে পারে, তাই একাধিক এন্টিজেন একটি প্যাথোজেনকে  শনাক্ত করতে পারে। লিম্ফোসাইটদের মেমব্রেন-পৃষ্টে এই এন্টিজেনগুলো আটকানোর মতো উপযুক্ত এন্টিজেন-রিসেপ্টর (Antigen-receptor) থাকে। এন্টিজেন-রিসেপ্টরগুলো হলো মেমব্রেন-বাউন্ড প্রোটিন। একটি লিম্ফোসাইটের মেমব্রেনে শুধু একধরণের এন্টিজেন-রিসেপ্টর থাকে, অর্থাৎ, যে কোনো লিম্ফোসাইট মাত্র একটি এন্টিজেনের সাথে আটকাতে পারে। ফলে, ওই লিম্ফোসাইটটি শুধু ওই এন্টিজেনযুক্ত প্যাথোজেনদের শনাক্ত করতে পারে।

প্রথমে আসা যাক বি-সেলের ক্ষেত্রে, আমাদের শরীরে কোনো এক সময়ে যে পরিমাণ বি-সেল থাকে তাতে প্রায় বিলিয়ন খানেক প্যাথোজেনকে শনাক্ত করা সম্ভব। যেকোনো প্রোটিন সংশ্লেষণে আলাদা আলাদা জিন প্রয়োজন। সাধারণ দৃষ্টিতে, এই বিলিয়ন খানেক আলাদা আলাদা এন্টিজেন-রিসেপ্টরের জন্য বিলিয়ন খানেক আলাদা আলাদা জিন প্রয়োজন। এক হিসাব অনুযায়ী, এই বিলিয়ন খানেক এন্টিজেন-রিসেপ্টর-জিনের স্থানসঙ্কলানের জন্য পুরো জিনোমই দরকার এবং তাতে অন্য কোনো জিনের জন্য জিনোম আর জায়গা থাকবে না। শরীর এন্টিজেন-রিসেপ্টর-জিনের স্থানসঙ্কলান সমস্যার সমাধান করে জেনেটিক-রিকম্বিনেশন (Genetic recombination) পদ্ধতির মাধ্যমে। জেনেটিক-রিকম্বিনেশনে প্রথমে একাধিক জিনকে এলোমেলোভাবে (Randomly) কাটা ছেড়া করা হয়। এরপর ওই ছেড়া অংশগুলো জোড়াতালি লাগিয়ে সম্পূর্ণ নতুন জিন তৈরি করা হয়।

immunity-1
বি-সেলের এন্টিজেন-রিসেপ্টর।

একসময় ধারণা করা হতো, জেনেটিক-রিকম্বিনেশন ঘটে শুধুই মায়োসিসের সময়। কিন্তু, পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় যে, অস্থি মজ্জার স্টেম-সেলগুলো যখন বি-সেলে রূপান্তরিত (Cell differentiation) হতে থাকে তখন এই রূপান্তর পর্যায়ে স্টেম-সেলগুলো নিজের ভেতর জেনেটিক-রিকম্বিনেশন ঘটায়। স্টেম-সেল পর্যায়ে এই জেনেটিক-রিকম্বিনেশনের ধারণা দেন ১৯৬০ সালে উইলিয়াম জে ড্রায়ার (William J. Dreyer) এবং জে ক্লড বেনেট (J. Claude Bennett )।  এন্টিজেন-রিসেপ্টরগুলো একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রোটিন নাম ইমিউনোগ্লবিউলিন (Immunoglobulin)। এই প্রোটিনগুলোর চারটি পলি-পেপটাইড চেইন থাকে। এদেরর মধ্যে লম্বা পেপটাইড-চেইন দুটোকে বলে হেভি-চেইন (Heavy chain) আর ছোট দুটোকে বলে লাইট-চেইন (Light chain)। লাইট-চেইনগুলো কোয়ার্টারনারি স্ট্রাকচারের মাধ্যমে হেভি-চেইনগুলোর সাথে আটকে থাকে। লাইট-চেইন এবং হেভি-চেইনগুলোর নিচের অংশটি অপরিবর্তনশীল (সবুজ), অর্থাৎ, প্রতিটি এন্টিজেন-রিসেপ্টরের এই অংশটি একই রকম। কিন্তু, ওপরের অংশটি পরিবর্তনশীল (গোলাপী), অর্থাৎ, একেকটি এন্টিজেন-রিসেপ্টরের এই অংশটি একেক রকম। এন্টিজেন-রিসেপ্টরের এই পরিবর্তনশীল অংশটিকে বলে এন্টিজেন-বাইন্ডিং-সাইট যেটা এন্টিজেনের সাথে আটকাতে যায়। হেভি-চেইনের জন্য আমাদের DNA-তে মাত্র চারগুচ্ছ জিন আছে। এক মধ্য একটি ব্যবহার হয় অপরিবর্তনশীল অংশ তৈরিতে। বাকি তিনটি ব্যবহার হয় পরিবর্তনশীল  অংশ তৈরিতে। স্টেম-সেলগুলো বি-সেলে রূপান্তর হবার সময় এই তিনগুচ্ছ জিন থেকে এলোমেলোভাবে কিছু অংশ কেঁটে নিয়ে এমন DNA-সেগমেন্ট তৈরি করে যাতে সম্পূর্ন নতুন পরিবর্তনশীল অংশ তৈরি করা যায়। লাইট-চেইন জন্যও একই ব্যাপার প্রযোজ্য। লাইট-চেইন এবং হেভি-চেইনের এই পরিবর্তনশীল অংশগুলো মিলিয়ে একটি অদ্বিতীয় এন্টিজেন-রিসেপ্টর তৈরি হয়।

immunity-2
স্টেম-সেলের DNA থেকে ছোট ছোট তিনটি টুকরো V, D, এবং J কেঁটে নিয়ে হেভি-চেইনের পরিবর্তনশীল অংশের DNA বানানো হচ্ছে। μ হলো DNA-এর সেই অংশ যেটা হেভি-চেইনের পরিবর্তনশীল অংশের জন্য দায়ী।

আমাদের দেহকোষদেরও স্বাতন্ত্র্য বায়োলজিক্যাল-চিহ্ন বা এন্টিজেন উপদান আছে। ধারণা করা হয় জন্ম নেয়া প্রায় ৯০% বি-সেলই শরীরের স্বীয় কোষের এন্টিজেন শনাক্ত করতে এবং ইমিউনিটি-রেসপন্স তৈরি করতে সক্ষম। কিন্তু, পরিণত হবার সময়ে এরা যখন নিজ শরীরের বিরুদ্ধে দুর্বল ইমিউনিটি-রেসপন্স তৈরি করতে শুরু করে ঠিক তখন একইসাথে এরা বিভিন্ন কোষীয় পরিবর্তনের মাধ্যমের শরীরকে সংকেত দিতে থাকে। এই কোষীয় পরিবর্তন এবং সংকেতের কারণে, হয় তাদের বিকাশ বন্ধ হয়ে যায় নয়তো লিউকোসাইটেরা এসে পরিণত হবার আগেই তাদের ধ্বংস করে দেয়। বলা যায়, শরীর খুব কঠিনভাবে বি-সেলের মান নিয়ন্ত্রণ করে। নিয়োগের আগে প্রতিটি বি-সেলেকে পরীক্ষা করে নেয়া হয়। জন্ম নেয়া মাত্র ১০% বি-সেল পরিণত লাভ করে।

সমস্যা হলো, শরীরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট এন্টিজেনের সাথে আটকাতে সক্ষম এমন বি-সেলের পরিমাণ একেবারেই কম। তাই এই বি-সেল যখন কোনো এন্টিজেন শনাক্ত করে তখন এরা অতিদ্রুত বিভাজিত হয়ে নিজেদের ক্লোন (Clone) তৈরি করা শুরু করে। এই ক্লোন দুই ধরণের হয়। ইফেক্টর-বি-সেল (Effector-cell) বা প্লাসমা-সেল, এবং মেমরি-সেল (Memory cell)। এই ক্লোন তৈরি প্রক্রিয়াকে বলে ক্লোনাল-সিলেকশন, কারণ, অগণিত বি-সেলগুলোর মধ্যে শুধু তারাই ক্লোন তৈরি করতে পারে যারা এন্টিজেন শনাক্ত করে। প্লাসমা-সেলের কাজ হলো এন্টিবডি (Antibody) তৈরি করে রক্তে ছেড়ে দেয়া। এন্টিবডি হুবুহু এন্টিজেন-রিসেপ্টরের মতোই ইমিউনোগ্লবিউলিন প্রোটিন। বলা যায়, এন্টিবডি এবং এন্টিজেন-রিসেপ্টর একই জিনিস। পার্থক্য হলো, এন্টিবডিরা হলো মুক্ত প্রোটিন যারা স্বাধীনভাবে রক্তে ভেসে বেড়ায় এবং উপযুক্ত এন্টিজেনযুক্ত প্যাথোজেনের সাথে আটকে যায়। এই এন্টিবডি একবার প্যাথোজেনের সাথে আটকে গেলে সেই প্যাথোজেন যেখানেই যাক সাথে করে ওই এন্টিবডিকে বায়োলজিক্যাল-চিহ্নের মতো বহন করে বেড়ায়। আর এই এন্টিবডি ভিত্তিক বায়োলজিক্যাল-চিহ্নের কারণে লিউকোসাইট এবং কমপ্লিমেন্টারি-সিস্টেম খুব সহজেই এই প্যাথোজেন বহিরাগত হিসেবে শনাক্ত করতে পারে। অন্যদিকে, মেমরি-সেলদের তুলোনা করা চলে রিজার্ভ-সেনাদের মতো, এরা চুপচাপ রয়ে যায় এবং অপেক্ষা করে পরবর্তী যুদ্ধের জন্য। একই প্যাথোজেন যদি ভবিষ্যতে আক্রমণ চালায় তবে এই মেমরি-সেলের জন্যই ইমিউনিটি-রেসপন্স হয় অতিদ্রুত। টীকা বা ভ্যাক্সিন শরীরে মেমরি-সেল তৈরি করে। ফলে, প্যাথোজেনেরা যদি সদলবলে আক্রমণ চালায় তবে এই মেমরি-সেলেরা অতিদ্রুত শরীরে আন্টিবডি নি:সরণ করতে শুরু করে। এই মেমরি-সেল আয়ুষ্কাল কয়েকে বছর থেকে কয়েক দশক পর্যন্ত হতে পারে।

Immunity-5
মেমরি-সেলের কল্যাণে একই প্যাথোজেন যখন আবার ফিরে আসে, তখন ইমিউনিটি-রেসপন্স হয় অতিদ্রুত এবং ব্যাপক। ঠিক এভাবেই টীকা কাজ করে।

ওদিকে, টি-সেলও মূলত দুই ধরণের হয়। ইফেক্টর-টি-সেল এবং সাইটোটক্সিক-টি-সেল (Cytotoxic t cells)। সাইটোটক্সিক-টি-সেল অনেকটা ন্যাচারাল-কিলার-সেলের মতোই, তবে পার্থক্য হলো সাইটোটক্সিক-টি-সেলগুলো লক্ষ্য-নির্ধারিত অর্থাৎ, এরা এন্টিবডি ভিত্তিক বায়োলজিক্যাল-চিহ্নযুক্ত প্যাথোজেন,কিংবা  ভাইরাস সংক্রামিত কোষ, কিংবা প্রি-ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে। তবে, টি-সেল একটা অতিগুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, সেটা হলো, অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেমকে কার্যকর করা। বি-সেল কিন্তু এন্টিজেন পাওয়ার সাথে সাথেই ক্লোন তৈরি করা শুরু করে না। কোনো প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেমকে কার্যকর করা হয় দুই ধাপ বিশিষ্ট যাচাইয়ের মাধ্যমে।

immunity-3
বি-সেল এবং টি-সেলের এন্টিজেন-রিসেপ্টর পাশাপাশি।

এন্টিজেনে শনাক্ত করার সাথে সাথে ইফেক্টর-টি-সেলগুলো ক্লোনিং শুরু করে না। বরং, এই টি-সেলগুলো লিম্ফেটিক-সিস্টেমে ফিরে যায় এবং অপেক্ষা করতে থাকে ম্যাক্রোফেজদের জন্য। আগেই বলা হয়েছে যে, ম্যাক্রোফেজেরা প্যাথোজেনদের গিলে ফেলার পরপরই ওদের হজম করে ফেলে। কিন্তু, এই হজম প্রক্রিয়াটি একটু ভিন্ন। ম্যাক্রোফেজেরা প্যাথোজেনের এন্টিজেনকে নিজের তৈরি এক বিশেষ ধরণের প্রোটিন নাম MHC বা মেজর-হিস্টোকম্পাটিবিলিটি-কমপ্লেক্সের  (Major histocompatibility complex) সাথে মিশিয়ে মেমব্রেন-পৃষ্টে উপস্থাপন করে। একে বলে ইমিউন-প্রেসেন্টেশন (Immune presentation)। এন্টিজেন শনাক্ত করার সাথে সাথে বি-সেল এবং টি-সেলও প্রায় একইভাবে নিজেদের মেমব্রেন-পৃষ্টে ইমিউন-প্রেসেন্টেশন তৈরি করে। এই ইমিউন-প্রেসেন্টেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, শ্বেতকণারা কোনোভাবেই কোষের মেমব্রেনের ভেতরের অংশ দেখেতে পায়না। তাই তাদের শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া পুরোপুরি নির্ভর করে মেমব্রেন-পৃষ্টের আকারের ওপর। এই ম্যাক্রোফেজেরা যখন লিম্ফ-নোডে ফিরে আসে তখন তাদের সাথে সাক্ষাৎ হয় এই ইফেক্টর-টি-সেলের সাথে। এই ইফেক্টর-টি-সেলেরা নিজেদের ইমিউন-প্রেসেন্টেশনের সাথে ম্যাক্রোফেজের ইমিউন-প্রেসেন্টেশন মিলিয়ে দেখে। যদি মিলে যায় তবে এই  ইফেক্টর-টি-সেলগুলো ক্লোনিং শুরু করে। এই ক্লোনগুলো দুই ধরণের হয়, হেল্পার-সেল (Helper cell) এবং মেমরি-সেল। টি-মেমরি-সেলগুলো বি-মেমরি-সেলের মতোই রিজার্ভ-সেনা। কিন্তু, হেল্পার-সেলগুলো প্লাসমা-সেলের মতো এন্টিবডি তৈরি করে না। ক্লোনিংয়ের সময় এই হেল্পার-সেলেগুলো তাদের মাতৃ-ইমিউন-প্রেসেন্টেশন পেয়ে থাকে। ক্লোনিংয়ের পরপরই এই হেল্পার-সেলগুলো লিম্ফ-নোডে থেকে রক্তে ফিরে আসে, সেখানে তাদের সাক্ষাৎ হয় বি-সেলের সাথে। এবার, হেল্পার-সেল এবং বি-সেল নিজেদের ইমিউন-প্রেসেন্টেশন মিলিয়ে দেখে। যদি মিলে যায় তবে বি-সেল সক্রিয়ে হয়ে পরে এবং ক্লোন ও এন্টিবডি তৈরি শুরু করে। ফলে ওই এন্টিজেন বহনকারী প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেম কার্যকর হয়ে পরে।

immunity-6
বি-সেল এবং হেল্পার-সেলের ইমিউন-প্রেসেন্টেশন মিলিয়ে দেখা।

কোন স্থানীয় সংক্রমণ মোকাবেলায় ইনেট-ইমিউনিটি-সিস্টেম অত্যন্ত কার্যকর। কিন্তু, প্যাথোজেন যদি দ্রুত সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে তবে ইনেট-ইমিউনিটি-সিস্টেম পক্ষে সেটা সামাল দেয়া সম্ভব হয়না। বরং, ইনেট-ইমিউনিটি-সিস্টেমের প্রদাহে শরীরের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে, যেমন উচ্চ তাপমাত্রায় শরীরের দরকারী প্রোটিন নষ্ট হয় যায়, ফলে বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই, পুরো শরীর জুড়ে সংক্রমণ মোকাবেলায় দরকার অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেম। অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেমের পক্ষে এটা সম্ভব কারণ, অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেম লক্ষ্য-নির্ভর।  ইনেট-ইমিউনিটি-সিস্টেমকে যদি কামানের সাথে তুলোনা করা হয় তবে অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেম হলো রাশান-এস৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা। আর তাই এই অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-ক্ষেপণাস্ত্র-ব্যবস্থা কার্যকর করার আগে শরীর বিভিন্ন ধাপে ইমিউন-প্রেসেন্টেশন যাচাইয়ের মাধ্যমের যুদ্ধ শুরু করার মতো পরিস্থিতি হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেয়।

অবলম্বনে: “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “Biology: The Science of Life” by “Stephen Nowicki”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.