ক্যান্সার কোষের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো স্বাভাবিক কোষের চেয়ে ভিন্ন।
কোনো বাধা ছাড়াই ক্যান্সার কোষ বাড়তে থাকে: দেহের প্রতিটি কোষের DNA হুবুহু এক। পার্থক্য শুধু প্রোটিন সংশ্লেষণে, যেমন: চুল যেখানে তন্তুর মতো কেরোটিন (Keratin) প্রোটিন তৈরি করে, সেখানে হৃৎপিণ্ড শক্তিশালী পেশীতন্তু তৈরি করে। এই নিয়ন্ত্রণের কারণে আমরা কখনো হৃৎপিণ্ডে চুল গজাতে দেখিনা। এই প্রোটিন সংশ্লেষণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও দেহের বিভিন্ন টিস্যু খুব শক্তভাবে প্রতিটি কোষের অবস্থান নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যান্সার কোষে এই দুই নিয়ন্ত্রণের কোনোটাই থাকে না। টেরাটোমা (Teratoma) একটি বিরল ক্যান্সার। এই ক্যান্সার টিউমারে একই সাথে বিভিন্ন বিশেষায়িত (Differentiated) টিস্যু একসাথে বিকাশ পেতে থাকে। একটি টেরাটোমা টিউমারে একসঙ্গে দাঁত, হাড়, পাকস্থলী, চুল, এবং এমনকি চোখের টিস্যুও বেড়ে উঠতে দেখা গেছে।
স্বভাবিক টিস্যুতে কোষেরা ক্যাডহেরিন (Cadherin) প্রোটিনের মাধ্যমের এক অন্যের সাথে যুক্ত থাকে। ক্যাডহেরিন একধরণের মেমব্রেন-বাউন্ড প্রোটিন, একে তুলোনা করা চলে ভেলক্রোর সাথে। অন্যদিকে, দেহের বিভিন্ন টিস্যু এবং অঙ্গগুলো কোল্যাজেন (Collagen) প্রোটিনের মাধ্যমে একে অন্যের সাথে জায়গা মতো আটকে থাকে। কোল্যাজেন একটি আঁশালো এবং আঁঠালো সংযোজক প্রোটিন, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দেহ প্রায় ২৫% থেকে ৩৫% এই প্রোটিন দিয়ে তৈরি। ক্যান্সার কোষের এই দুই প্রোটিনেরই মিউটেশন ঘটে, ফলে ক্যান্সার কোষ দেহের কোনো নির্দিষ্ট অংশে আবদ্ধ থাকে না। এরা স্বাধীনভাবে দেহের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতে পারে এবং দেহের বিভিন্ন ভৌত-রাসায়নিক পরিবেশের প্রভাবে বিভিন্ন প্রোটিন উৎপাদন করে।
কোষের সাইটোস্কেলিটনের পরিবর্তন ঘটে: প্রতিটি কোষের একটি দৃঢ় এবং স্থিতিস্থাপক কাঠামো থাকে, এই কাঠামোকে বলে সাইটোস্কেলিটন (Cytoskeleton)। সাইটোস্কেলিটনের মূল উপাদান একাধিক স্থিতিস্থাপক-তন্তু (ফিল্যামেন্ট) ধরণের প্রোটিন। এই সাইটোস্কেলিটনই কোষের বিভিন্ন আন্তঃকোষীয় যন্ত্রাংশ যেমন: নিউক্লিয়াস, মাইটোক্রোন্ডিয়া ইত্যাদিকে জায়গা মতো ধরে রাখে। সাইটোস্কেলিটনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো অন্তঃকোষীয় যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করা, অনেকটা শহুরে রাস্তা এবং ট্রাফিক সিগন্যালিংয়ের মতো। কাজ ভেদে বিভিন্ন কোষের সাইটোস্কেলিটনের গঠন বিভিন্ন হয়। ক্যান্সার কোষ চলনশীল, ক্যান্সার কোষের সাইটোস্কেলিটনের পরিবর্তন এমনভাবে হয় যাতে কোষের চলাফেরায় কোনো বাধা থাকে না।
আন্তঃকোষীয় যোগাযোগের পরিবর্তন ঘটে: একই অঙ্গের কোষগুলো নলের মতো কিছু প্রোটিনের মধ্যে দিয়ে আয়ন এবং অন্যান্য অণু দেয়া নেয়ার মাধ্যমে একে অন্যের সাথে সরাসরি সংকেত আদান প্রদানের করে। এই নলগুলোকে বলে গ্যাপ-জাংশন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হৃৎপিণ্ডের কোষগুলো গ্যাপ-জাংশনের মাধ্যমে একই ছন্দে সংকোচন এবং প্রসারণের সংকেত আদান-প্রদান করে।
যেকোনো অঙ্গে স্বাভাবিক কোষগুলোর গ্যাপ-জাংশনগুলো অত্যন্ত সুসন্নিবেশিত এবং সুসংহত। ফলে, ঔষুধ প্রয়োগে দ্রুত ফল পাওয়া যায়। ক্যান্সার কোষে এই গ্যাপ-জাংশনগুলোর বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে যায়, ফলে কোষগুলো সমন্বয়হীনতার কারণে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো বেড়ে উঠতে থাকে। গ্যাপ-জাংশনগুলোর অপ্রতুলতার কারণে ঔষুধ টিউমারের সব কোষে সহজে পৌঁছাতে পারে না; তাই ক্যান্সারের রক্তবাহিত চিকিৎসাগুলো দীর্ঘমেয়াদি হয়।
মেটাস্টেসিস (Metastasis): ক্যান্সার কোষে দেহের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে: সাইটোস্কেলিটনের একটি বিশেষ প্রোটিন আছে নাম কল্যাপ্সিন (Collapsin), এই কল্যাপ্সিন সাইটোস্কেলিটনের সাথে আটকে থাকে এবং সাইটোস্কেলিটনের নড়াচড়াতে বাধা দেয়। এইজন্য কল্যাপ্সিনকে বলে এন্টি-মেটাস্টেসিস প্রোটিন। ক্যান্সার টিউমারের চলাচল শুরু হয় এই এন্টি-মেটাস্টেসিস জিনগুলো মিউটেশনর থেকে। মূলত, এই এন্টি-মেটাস্টেসিস জিনের মিউটেশনই নিরীহ টিউমারের বিপদজনক হয়ে ওঠার কারণ।
ক্যান্সার কোষের চলন একটি সক্রিয় প্রক্রিয়া। অর্থাৎ, ক্যান্সার টিউমার অনেকটা স্বাধীন জীবের মতো দেহের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করে। এবং এই চলাচলের মূল মাধ্যম হলো রক্ত। আগেই বলা হয়েছিলো ক্যান্সার কোষের সাইটোস্কেলিটনের পরিবর্তন ঘটে, সামুদ্রিক তারামাছের মতো এদের অগ্রভাগ থাকে। ক্যান্সার টিউমার তাদের অগ্রভাগ থেকে এক শ্রেণীর এনজাইম নিঃসরণ করে, নাম প্রোটিয়েস (Protease)। এই প্রোটিয়েসের কাজ হলো যেকোনো প্রোটিন ভেঙ্গে ফেলা বা হজম করা। ক্যান্সার টিউমার যে বিশেষ প্রোটিয়েস এনজাইম ব্যবহার করে তার নাম MMP বা ম্যাট্রিক্স মেটালোপ্রোটিয়েস (Matrix metalloproteases)। এই MMP নিঃসরণের মাধ্যমে কোল্যাজেন ভেদ করে টিউমার রক্তনালীর দিকে এগিয়ে যায়।
রক্তনালীতে পৌঁছুলে টিউমার সেই MMP ব্যবহার করে রক্তনালীর প্রাচীর ফুটো করে ফেলে এবং রক্তনালীর ভেতরে প্রবেশ করে। কোলন ক্যান্সারসহ কিছু কিছু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এই পর্যায়ে রক্তক্ষরণ হয়। রক্তনালীতে প্রবেশের পর টিউমারের কিছু কিছু ক্যান্সার কোষ ক্যাডহেরিন বন্ধন ভেঙ্গে টিউমার থেকে আলাদা হয়ে রক্তে মিশে যায়।
ক্যান্সার কোষের জন্য রক্ত অত্যন্ত বিপদজনক; কারণ, রক্তের শ্বেতকণিকার এইসব ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এই পর্যায়ে দুটি ব্যাপার ঘটতে পারে, ক্যান্সার কোষের সংখ্যা যদি বেশি হয় তবে শ্বেতকণিকার পক্ষে সবগুলো ধ্বংস করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, শ্বেতকণিকার প্যাথোজেনের মেমব্রেনে প্রকাশিত ইমিউনো-প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে এন্টিজেন শনাক্ত করে। CMLসহ কিছু কিছু ক্যান্সারের ইমিউনো-প্রেজেন্টেশন কোষের ভেতর লুকানো থাকে, তাই শ্বেতকণিকার এই ক্যান্সারদের এন্টিজেন শনাক্ত করতে পারে না। যে সমস্ত ক্যান্সার তার ইমিউনো-প্রেজেন্টেশন কোষের মেমব্রেনে প্রকাশ করে না তারা পুরো ইমিউনিটি-সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়ে রক্তে ছড়িয়ে পড়ে।
রক্তে ভাসতে থাকা ক্যান্সার কোষের গন্তব্য কোথায় সেটা নির্ভর করে ক্যান্সারের ধরণের ওপর। বিভিন্ন ক্যান্সার কোষে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের মেমব্রেন-বাউন্ড প্রোটিন থাকে যেগুলো শুধু নির্দিষ্ট কিছু অঙ্গে আটকাতে সাহায্য করে। যেমন: ফুসফুসের ক্যান্সারের গন্তব্যগুলো মস্তিষ্ক, হাড়, এবং যকৃৎ; তবে প্রধান গন্তব্য মস্তিস্ক। ক্যান্সার কোথায় ছড়াবে সেটা দূরত্বের ওপর নির্ভর করে না।
গন্তব্যে পৌঁছানোর পর ক্যান্সার কোষ MMP ব্যবহার করে রক্তনালীর প্রাচীর ফুটো করে টিস্যুতে প্রবেশ করে।
অতঃপর, নতুন গন্তব্যে নতুন টিউমারের বিকাশ হতে থাকে। অথবা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ক্যান্সার কোষগুলো সুপ্ত অবস্থায় রয়ে যায়।
এঞ্জিয়োজেনেসিস (Angiogenesis): প্রয়োজনমাফিক রক্ত সরবরাহ নালী তৈরি করে: মেটাস্টেসিসের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, বহুক্ষেত্রেই ছড়িয়ে যাওয়া ক্যান্সার কোষগুলো সাথে সাথেই টিউমারে পরিণত হয় না। যদি কোনো কারণে মূল টিউমারকে অপসারণ করা হয় তবে ছড়িয়ে যাওয়া ক্যান্সার কোষগুলো টিউমারে পরিণত হতে শুরু করে। যেকোনো কোষের মতোই ক্যান্সার কোষেরও রক্তের দরকার। রক্তের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ অক্সিজেনসহ বিভিন্ন দরকারি উপাদান গ্রহণ করে এবং কার্বন-ডাইঅক্সাইড মতো বর্জ্য অপসারণ করে। রক্তনালী ব্যাপনের (Diffusion) মাধ্যমে অক্সিজেন আশপাশের কোষে ছড়িয়ে দেয়। ব্যাপন একটি ধীর প্রক্রিয়া, তাই যেকোনো কোষ রক্তনালী থেকে আড়াআড়িভাবে সর্বোচ্চ পাঁচ কোষ দূরত্বে অবস্থান করতে পারে। অক্সিজেনবঞ্চিত কোষ কিছু গ্রোথ-হরমোন নিঃসরণের মাধ্যমে কাছাকাছি থাকা রক্তনালীকে শাখাপ্রশাখা বিস্তারের সংকেত দেয়। ক্যান্সার কোষ VEGF বা ভ্যাস্কুলার-এন্ডোথেলিয়াল-গ্রোথ-ফ্যাক্টর (vascular endothelial growth factor) নিঃসরণ করতে থাকে। প্রতিক্রিয়ায় কাছাকাছি রক্তনালী নতুন শাখা প্রশাখা (Capillary) বিস্তারের মাধ্যমে ক্যান্সার টিউমারকে লালনপালন শুরু করে। মেটাস্টেসিসের ক্ষেত্রে মূল টিউমার ছড়িয়ে যাওয়া ক্যান্সার কোষের এঞ্জিয়োজেনেসিস অবদমিত করে রাখে। ফলে, মূল টিউমার অপসারণ করা হলে ছড়িয়ে যাওয়া ক্যান্সার কোষগুলো এঞ্জিয়োজেনেসিস সক্রিয় হয়ে পরে এবং কোষগুলোর টিউমারে পরিণত হতে থাকে।
ক্যান্সার কোষ অবিশেষায়িত কোষ: আমাদের দেহের টিস্যুগুলোতে এক শ্রেণীর কোষ থাকে যাদের বলে পিউরিপোট্যান্ট-স্টেমসেল (Pluripotent stemcell)। এই স্টেমসেলগুলো দেহের জমিয়ে রাখা অবিশেষায়িত (Undifferentiated) কোষ, যখন দরকার তখন এই স্টেমসেলগুলো বিভাজন এবং বিশেষায়নের (Differentiation) মাধ্যমের পরিণত কোষে রূপান্তরিত হয়। যেমন: রক্তের স্টেমসেল ভিন্ন ভিন্ন বিশেষায়নের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন রক্তকণিকা তৈরি করে। কিছু কিছু মিউটেশন স্টেমসেলগুলোর বিশেষায়নে বাধা দেয়, ফলে বিকাশের একপর্যায়ে এই স্টেমসেলগুলো বিশেষায়িত কোষের পরিবর্তে অবিশেষায়িত টিউমার কোষে পরিণত হয়। CMLলের ক্ষেত্রে এটাই ঘটে। রক্তের স্টেমসেল প্রথমে মায়েলয়েড-স্টেমসেলে বিকশিত হয়; এরপর কিছু ময়েলয়েড-স্টেমসেল বিকশিত হয় মায়েলোব্লাস্টে। কিন্তু, BCR-ABL মিউটেশনের কারণে মায়েলোব্লাস্টগুলো গ্র্যানুলোব্লাস্টে পরিণত না হয়ে ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়। সুতরাং, ক্যান্সার কোষেরা মূলত অবিশেষায়িত স্টেমসেল, যারা মিউটেশনের কারণে পুরোপুরি বিশেষায়িত হতে পারে না।
ক্যান্সার কোষগুলো ক্লোনাল: ক্যান্সার কোষের উৎপত্তি সাধারণত একটি কোষে থেকে। অর্থাৎ, এরা একে অন্যজনের ক্লোন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ক্যান্সার টিউমারের বিভিন্ন অংশে মিউটেশনের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হতে থাকে। অর্থাৎ, টিউমারে সব কোষের মিউটেশন সমান নয়। ঠিক এইজন্যই ক্যান্সার চিকিৎসায় বিভিন্ন কেমোথেরাপি ঔষধের সমন্বয় ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো ক্যান্সার কোষ সম্পূর্ণ নতুন মিউটেশনের কারণে প্রচলিত ঔষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাই, কেমোথেরাপি চিকিৎসায় হয়তো ৯৯.৯৯৯%% ভাগ টিউমার কোষ ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু চিকিৎসার কিছু দিন পর রয়ে যাওয়া ঐ ০.০০১% বিকশিত হয়ে অপ্রতিরোধ্যে টিউমারে পরিণত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, মিউটেশনের পরিমাণ ভিন্ন হবার কারণে একটি টিউমারের সব কোষই কিন্তু টিউমারে পরিণত হবার ক্ষমতা রাখে না। মূলত টিউমার বিকাশে ভূমিকা রাখে সামান্য কিছু কোষ, এবং এই ফলাফল থেকেই ক্যান্সার-স্টেমসেল ধারণাটি গড়ে উঠেছে। ক্যান্সার-স্টেমসেল ধারণাটি বিতর্কিত, কিন্তু যদি সত্যি হয় তবে ব্যাপারটা হবে যুগান্তকারী। ভবিষ্যৎ কেমোথেরাপি ঔষুধগুলোর লক্ষ্য হবে এই ক্যান্সার-স্টেমসেল।
কোষ বিভাজন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঘটে: কোষ বিভাজনকে চারটি ধাপে ভাগ করা হয়। G1 বিশেষায়িত কোষের স্বাভাবিক অবস্থা। কোষ G1 ধাপের একটি বিশেষ বিন্দু Rয়ে (Restriction point) এসে বিভাজনের সিদ্ধান্ত নেয়। বিশেষায়িত কোষ R-বিন্দু অতিক্রম করার চেষ্টা করে না। কিন্তু, স্টেমসেল কিংবা ক্যান্সার কোষ R-বিন্দু অতিক্রম করে এবং S ধাপে উপনীত হয়। S ধাপে কোষের DNA রেপ্লিকেশন ঘটে। G2তে কোষের নিউক্লিয়াস বিভাজত হয়। M ধাপে মাইটোসিস ঘটে এবং বিভাজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
বিভিন্ন কোষ বিভিন্নভাবে এই R-বিন্দুতে থেমে থাকার চেষ্টা করে। আর এ ব্যাপারে সবক্ষেত্রেই কোনো না কোনো টিউমার-সাপ্রেশন-জিন মুখ্য ভূমিকা পালন করে। একটা উদাহরণ হলো RB বা রেটিনোব্ল্যাস্টোমা (retinoblastoma) প্রোটিন। RB একটি রেগুলেটরি প্রোটিন, এটি DNAতে আটকে থাকে এবং ট্রান্সক্রিপশনে বাধা দেয়। তবে ব্যাপারটা হলো, RB সেইসব জিনের সাথে আটকে থাকে যারা কোষ বিভাজনে সাহায্য করে। ফলে, কোষ বিভাজনে জন্য দরকারি প্রোটিন উৎপন্ন করতে পারেনা এবং R-বিন্দুতে এসে আটকে থাকে। দুটি উপায়ে এই RB-প্রোটিনের কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে। কোনো কারণে যদি RB জিনের মিউটেশন ঘটে। অথবা যদি কোনো কাইনেস-প্রোটিন এই RB-প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়ে RB-প্রোটিনের আকার পাল্টে দেয়, ফলে RB-প্রোটিন আর DNAয়ের সাথে আটকাতে পারে না। এই দুটির যেকোনোটির ক্ষেত্রে কোষ R-বিন্দু অতিক্রম করবে এবং ক্যান্সারে পরিণত সম্ভাবনা তৈরি হবে।
কাইনেস-প্রোটিনকে অচল করে দিতে পারে এমন একটি প্রোটিন হলো P21। এই P21 কাইনেস-প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয় এবং অবদমিত করে। কোষ এই P21য়ের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে P53য়ের মাধ্যমে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোষ স্বাধীনভাবে এই P21 উৎপাদন করতে পারে। আমরা দেখেছিলাম, তামাকের বেঞ্জপাইরিন কিভাবে P53কে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। দেখা গেছে ফুসফুসের ক্যান্সারে কোষ স্বাধীনভাবে P21 উৎপাদন করে। যেসব রোগীর এই P21 উৎপাদন বেশি তাদের আরোগ্যসম্ভাবনাও বেশি।
টিউমার-সাপ্রেশন-জিনের মিউটেশন ছাড়াও ভিন্ন কারণে কোষ R-বিন্দু অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটি মূলত ঘটে বিভিন্ন প্রোটিন সিগন্যালিংয়ের মাধ্যমে। যেমন: বিভিন্ন গ্রোথ-হরমোন কোষের হরমোন-রিসেপ্টরে আটকে যাওয়ার মাধ্যমে কোষ বিভাজনে প্রলুব্ধ করতে পারে। গ্রোথ-হরমোন-সিগনালিং ক্যান্সারের কারণ হতে পারে তিনটি উপায়ে। (এক) কোষে হরমোন-রিসেপ্টরে সংখ্যা আশংকাজনকভেবে বেড়ে গেলে। যেমন: এস্ট্রোজেন বাদেও স্তন ক্যান্সারের আরেকটি কারণ অস্বাভাবিক পরিমাণের HER2 হরমোন-রিসেপ্টর (Human epidermal growth factor receptor 2)। (দুই) কোষ যদি নিজে নিজেই গ্রোথ-হরমোন তৈরি করতে থাকে। (তিন) হরমোন-রিসেপ্টরের যদি এমন পরিবর্তন আসে যে হরমোন ছাড়াই রেসপন্স-প্রক্রিয়া অনবরত চলতে থাকে। এই তিনটি অবস্থার মূল কারণ কোনো না কোনো ধরণের মিউটেশন।
ক্যান্সার কোষের মৃত্যু নেই: ক্যান্সার কোষের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, এদের মৃত্যু নেই। কোষের মৃত্যুবরণ প্রক্রিয়াকে বলে এপোপটোসিস (Apoptosis)। এপোপটোসিসের অনেকটা স্বনিয়ন্ত্রিত আত্মহত্যার মতো। এপোপটোসিসের অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হলো DNAয়ের অপূরণীয় ক্ষতি। প্রতিটি ক্রোমোসোমের শেষপ্রান্তে কিছু পুনরাবৃত্ত মূলক DNA সিকোয়েন্স থাকে। একে বলে টেলোমের (Telomere), টেলোমের অনেকটা টুপির মতো DNAকে ক্ষয় হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। স্বাভাবিক কোষের ক্ষেত্রে প্রতিবার কোষ বিভাজনে এই টেলোমের একটু একটু করে ক্ষয়ে যেতে থাকে। প্রায় ৫০বার বিভাজনের পর এই টেলোমের একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যায়, ফলে DNA উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এই উন্মুক্ত DNAতে এতো বেশি মিউটেশন ঘটে যে কোষের রেপ্লিকেশন যন্ত্রাংশ সেটা সামাল দিতে পারে না। তাই এই পর্যায়ে কোষ এপোপটোসিসের সিন্ধান্ত নেয়। ঠিক এই কারণেই সুস্থ কোষ ৫০ বারের বেশি বিভাজিত হতে পারে না। এই টেলোমের ক্ষয়ের হার বিভিন্ন কোষের জন্য বিভিন্ন, শুক্রাণু-ডিম্বাণুর (জার্মলাইন) ক্ষেত্রে টেলোমের ক্ষয় হয় না, স্টেমসেলের ক্ষয়ের হার কম, বিশেষায়িত কোষের ক্ষয় সবচেয়ে বেশি। ক্ষয়ে যাওয়া টেলোমেরকে পুরুদ্ধারের কাজ একটা এনজাইমের, নাম টেলোমেরেস (Telomerase)। জার্মলাইন কোষের মতোই ক্যান্সার কোষের টেলোমের ক্ষয় হয় না, ফলে ক্যান্সার কোষ এপোপটোসিসের হাত থেকে বেঁচে যায়। ক্যান্সার কোষের টেলোমের ক্ষয় না হবার কারণ ঐ টেলোমেরেস এনজাইম। কিছু কিছু কেমোথেরাপি ঔষধ ক্যান্সার কোষের এপোপটোসিস ঘটায় এই টেলোমেরেস এনজাইমকে অবদমনের মাধ্যমে। আবার কিছু কিছু ঔষুধের লক্ষ্য হলো ক্যান্সার কোষের DNA নষ্ট করে ফেলা যাতে কোষের স্বতঃস্ফূর্ত এপোপটোসিসের ঘটে, এইধরণের কেমোথেরাপি ঔষধগুলো কার্সিনোজেনিক।
স্বাভাবিক কোষের কিছু বিশেষ জিন এপোপটোসিস অবদমনের জন্য দায়ী। যেমন: শ্বেতকণিকাদের এপোপটোসিসের একটা কারণ BCL2 জিনের প্রকাশ কমে যাওয়া। BCL2 একটি এপোপটোসিসের অবদমনকারী জিন। এই জিনের অস্বাভাবিক প্রকাশ ফলিক্যুলার-লিম্ফোমা টিউমারের (Follicular lymphoma) জন্য দায়ী।
ক্যান্সার চিকিৎসায় একটা সমস্যা হলো, ক্যান্সারের উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে থাকে যখন ক্যান্সার বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছে। যেমন: ক্যান্সার টিউমার হরমোনের মতো বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান রক্তে নিঃসরণ করতে থাকে, কিংবা যখন কোনো অঙ্গপ্রতঙ্গের কার্যপ্রণালীতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বিপদজনক পর্যায়টি হলো মেটাস্টেসিস, মেটাস্টেসিস পর্যায়ে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিন্তু পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়। ক্যান্সারে এক তৃতীয়াংশ মৃত্যুর কারণ ক্যাকেক্সিয়া (Cachexia)। ক্যাকেক্সিয়ার কারণ টিউমার নিঃসরিত রাসায়নিক উপাদান এবং কেমোথেরাপির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। টিউমার নির্গত রাসায়নিক উপাদান শরীরের চর্বিকে ফ্যাটি-অ্যাসিডে এবং মাংসপেশীকে অ্যামিনো-অ্যাসিডে ভেঙ্গে ফেলে, ফলে দ্রুত ওজন কমতে থাকে। কিছু কিছু রাসায়নি উপাদান মস্তিষ্কে, জিহ্বায়, যকৃৎ ইত্যাদি অঙ্গে পৌঁছে, ফলে বিষণ্নতা, স্বাদহীনতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। বাকি দুই তৃতীয়াংশ মৃত্যুর কারণ অঙ্গহানী। টিউমার বিভিন্ন অঙ্গের জন্য শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে, এমনকি ক্ষতিকারক রাসায়নি উপাদান নিঃসরণের মাধ্যমে পুরো অঙ্গকে অকেজো করে দিতে পারে।
আগের পর্ব – কারণ এবং কার্সিনোজেনেসিস
পরের পর্ব – অংকোজিন এবং টিউমার-সাপ্রেশন-জিন
অবলম্বনে: “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “What Science Knows about Cancer” by “David Sadava”