মরণব্যাধি ক্যান্সার: কারণ এবং কার্সিনোজেনেসিস

CML থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট, ক্যান্সারের শুরু কোষের জেনেটিক উপাদান (DNA) পরিবর্তন দিয়ে। আধুনিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে ক্যান্সারের সবচেয়ে সফল তত্ত্বটির নাম মাল্টিস্টেপ-কার্সিনোজেনেসিস। মাল্টিস্টেপ- কার্সিনোজেনেসিসের মূল কথা হলো; বিভিন্ন ভৌত এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কোষের জেনেটিক উপাদানের পরিবর্তন হয়। সময়ের সাথে সাথে এই পরিবর্তনগুলো পুঞ্জীভূত হতে থেকে। এইজন্যই ক্যান্সারকে প্রবীণ মানুষের রোগ বলা হয়। পুঞ্জীভূত জেনেটিক পরিবর্তন স্বাভাবিক কোষেকে ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত করে। এই ক্যান্সার কোষ প্রাকৃতিক নির্বাচনের চাপে দ্রুত বৈচিত্রতা লাভ করতে থাকে। ক্যান্সারের এই বৈচিত্রতাকে পাঁচটি ধাপে ভাগ করা যায়, (এক) শুরু, (দুই) প্রিনিয়োপ্লাষ্টিক বা প্রিম্যালিগন্যান্ট, (তিন) ম্যালিগন্যান্ট বা টিউমার ধাপ , (চার) ক্লিনিক্যাল, (পাঁচ) মেটাস্টেসিস: এই ধাপে ক্যান্সার দেহের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পরে।

cancer-9
ক্যান্সারের আধুনিক ধারণা মাল্টিস্টেপ-কার্সিনোজেনেসিসের বিভিন্ন ধাপ।

DNAয়ের যে অংশগুলো শুধু একটি প্রোটিন সংশ্লেষণের জন্য দায়ী তাদের আমরা বলি জিন। আমাদের DNAতে বিশেষ দুটি শ্রেণীর জিন আছে; অংকোজিন (Oncogene), এবং টিউমার-সাপ্রেশন-জিন (Tumor suppressor genes)। অংকোজিনগুলোর কাজ হলো কোষকে বিভাজনে সাহায্য করা; CMLলের ক্ষেত্রে BCR-ABL অংশটি ছিলো একটা অংকোজিন, যেকোনো অংকোজিনের কাজ হলো কাইনেস-প্রোটিন তৈরি করা। অন্যদিকে, টিউমার-সাপ্রেশন-জিনগুলো হলো রেগুলেটরি-জিন; অর্থাৎ, টিউমার-সাপ্রেশন-জিন এমন প্রোটিন তৈরি করে যারা জিন প্রকাশ (Gene expression) নিয়ন্ত্রণ করে। টিউমার-সাপ্রেশন-জিন অংকোজিনের ঠিক উল্টো, টিউমার-সাপ্রেশন-জিনগুলো বিভিন্ন উপায়ে কোষ বিভাজনে বাধা দেয়। ভ্রূণ থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হতে, কিংবা ক্ষয় হয়ে যাওয়া কোষ প্রতিস্থাপনে অংকোজিনগুলো ভূমিকা প্রশ্নাতীত। সুতরাং অংকোজিন খারাপ জিন নয়। ক্যান্সারের শুরু হয় তখনই যখন কোষ এই দুই প্রকার জিনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। যে পুঞ্জীভূত মিউটেশনের কথা বলা হয়েছে, তাতে মূলত অংকোজিনগুলো লাগামহীনভাবে প্রকাশ পেতে থাকে, এবং একই সাথে টিউমার-সাপ্রেশন-জিনগুলোর প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।

CMLয়ের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছিলাম ক্রোমোসোম-৯ এবং ক্রোমোসোম-২২য়ের অংশ বিশেষের অদলবদল হতে। প্রশ্ন হলো কোষের জেনেটিক উপাদান কিভাবে পরিবর্তিত হয়? এই পরিবর্তনের উৎস হলো খাদ্য এবং পরিবেশ। খাবার বলতে এখানে ভেজাল বা সংরক্ষণপ্রণালী কিংবা প্রক্রিয়াজাতকরণের ত্রুটির কথা বলা হচ্ছে না, বরং আমাদের প্রাকৃতিক খাদ্যকে বোঝানো হয়েছে।

কোষের উপযোগী করতে খাবারকে রাসায়নিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এই কাজটি করে যকৃৎ; যকৃৎ উপযুক্ত রাসায়নিক-গ্রুপ সংযুক্তির মাধ্যমে খাবারের অণুগুলোকে পানিতে সহজ দ্রবণশীল করে তোলে। ফলে রক্তের মাধ্যমে খাবারের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো দেহের প্রতিটি কোষের পৌঁছে দেয়া যায়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ, কারণ রক্তের অপ্রয়োজনীয় উপাদানগুলো সহজেই কিডনীর মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়া যায়। অন্যদিকে যকৃতের কাজটি অত্যন্ত বিপদজনক, কারণ খাবারে যদি এমন কোনো উপাদান থাকে যেটা DNAয়ের পরিবর্তনে সক্ষম, তবে এইসব উপাদানগুলোও রক্তের মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন কোষে পৌঁছে যাবে। এবং দুর্ভাগ্যক্রমে সেটাই ঘটে। উদাহরণ দেয় যাক: গুদামজাত অবস্থায় চীনাবাদাম, ভুট্টা ইত্যাদি শস্যদানায় একধরণের ছত্রাক জন্মে যা এফ্লোটক্সিন (Aflatoxin) নামের একটি রাসায়নিক উপাদান নিঃসরণ করে। এফ্লোটক্সিন একধরণের মিউটেজেনিক-টক্সিন বা DNA পরিবর্তনকারী বিষ। আর যেসব মিউটেজেনিক-টক্সিন ক্যান্সারের জন্য দায়ী তাদের বলে কার্সিনোজেন (Carcinogen)। যকৃৎ অক্সিজেন সংযুক্তির মাধ্যমে এফ্লোটক্সিনকে পানিতে দ্রবণীয় করে তোলে, এই এফ্লোটক্সিন রক্তের মাধ্যমে কোষের নিউক্লিয়াসে পৌঁছে যায় এবং DNAয়ের G-বেস বা গুয়ানিনের নাইট্রোজেনস-বেসের সাথে যুক্ত হয়। ফলে G-বেসের বিকৃতি ঘটে।

F1.large
যকৃতের এফ্লোটক্সিনের রূপান্তর (মেটাবোলিক এক্টিভেশন), অতঃপর এফ্লোটক্সিনের কারণে G-বেসের বিকৃতি।

বিকৃত-G-বেসকে নিয়ে সমস্যা হয় কোষ বিভাজনের সময়। রেপ্লিকেশন বা প্রতিলিপি তৈরি সময় DNA-পলিমারেস এই বিকৃত-G-বেসকে শনাক্ত করতে পারে না, তাই DNA-পলিমারেস লক্ষ্যহীনভাবে যেকোন নাইট্রোজেনস-বেসকে ঐ বিকৃত-G-বেসের জায়গায় বসিয়ে দেয়। এতে বেস-পেয়ারিংয়ে অমিল তৈরি হয়। যখন মিসম্যাচ-কারেকশন-এনজাইমগুলো এই ভুল বেস-পেয়ারগুলো খুঁজে পায়, তখন তারাও লক্ষ্যহীনভাবে বেস-পেয়ারগুলোকে সংশোধন করার চেষ্টা করে। ফলাফল হলো, নব্য বিভাজিত কোষে এক বা একাধিক অনিচ্ছাকৃত মিউশন। বিভাজনের সময় কোষের প্রতিলিপি এবং ভুল-সংশোধনি যন্ত্রগুলো অত্যন্ত নিখুঁতভাবে DNA নকল করার চেষ্টা করে; তবুও মানব দেহে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ষোলো হাজার এই ধরণের অবাঞ্ছিত মিউটেশন ঘটে। এফ্লোটক্সিন যকৃতের ক্যান্সারের জন্য দায়ী। মানুষের দেহে এফ্লোটক্সিন সহনশীল মাত্রা খুব কম; তাই উন্নত বিশ্বে কঠিনভাবে গুদামজাত খাদ্যশস্যের এফ্লোটক্সিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

cancer-3
একটি বিকৃত বেস কিভাবে DNA রেপ্লিকেশনের সময় মিউটেশন ঘটায় সেটা দেখানো হয়েছে। (এক) G-বেসের বিকৃতি, (দুই) রেপ্লিকেশন প্রক্রিয়া বিকৃত-G-বেস শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়, ফলে লক্ষ্যহীনভাবে C-বেসের বদলে ভুল A-বেস যুক্ত করে। (তিন) অমিল বেস-পেয়ারযুক্ত রেপ্লিকেশন সম্পন্ন, (চার) মিসম্যাচ-কারেকশন-এনজাইমগুলো যখন সংশোধনের জন্য দ্বিতীয় রেপ্লিকেশন চালায় তখন বিকৃত-G-বেস পাল্টিয়ে T-বেস বসিয়ে দেয়।

আরেকটা উদাহরণ হলো, রেফ্রিজারেটর আবিষ্কারের পূর্বে পশ্চিমা বিশ্বে এবং আজও স্বাদের জন্য এশিয়ার কিছু দেশে লবণের মাধ্যমে মাছ-মাংস সংরক্ষণ করা হয়। লবণ মাছ-মাংসের প্রোটিনের সাথে বিক্রিয়া করে নাইট্রাস-অ্যাসিড তৈরি করে। নাইট্রাস-অ্যাসিড একটি কার্সিনোজেন যা পাকস্থলীর ক্যান্সারের কারণ।

সবচেয়ে বিখ্যাত কার্সিনোজেনটি হলো: বেঞ্জপাইরিন (Benzopyrene), যেটা তামাকে পাওয়া যায় এবং পৃথিবীর ৮০% মুখগহ্বর, কণ্ঠনালী, খাদ্যনালী,এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য এই বেঞ্জপাইরিনকে দায়ী করা হয়। বেঞ্জপাইরিন কিভাবে ফুসফুসের ক্যান্সার ঘটায় সেটা গ্রেড ফাইফার (Gerd Pfeifer) ১৯৯০ সালে দিকে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেন। বেঞ্জপাইরিন একটি গুরুত্বপূর্ণ টিউমার-সাপ্রেশন-জিন P53য়ের  G-বেসের সাথে যুক্ত হয় এবং বিকৃতি ঘটায়; কোষে বিভাজনের সময় এই বিকৃত-G-বেস পরিপূরক T-বেসের পরিবর্তন ঘটে। এই T-বেসের মিউটেশনের ফলে বিভাজিত নতুন কোষের P53 জিন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

Screen Shot 2016-07-29 at 3.02.07 PM
IARCয়ের প্রকাশিত কার্সিনোজেনদের বিভিন্ন শ্রেণী।

IARC (International Agency for Research on Cancer) ক্যান্সার হবার সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে কার্সিনোজেনদের পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করেছে। এই শ্রেণীগুলোর নাম সহজবোধ্য তাই ব্যাখ্যা করা হলো না। IARCয়ের গবেষণা অনুসারে, নিশ্চিতভাবে ক্যান্সার সৃষ্টি করে এমন রাসায়নিক কার্সিনোজেনের সংখ্যা ১১৮টি। নিচে কয়েকটির নাম দেয়া হলো। উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হলো, ক্যান্সার নিরাময়ের ব্যবহৃত কেমোথেরাপি ঔষুধগুলোও কার্সিনোজেন ধরণের। তাই, এইসব ঔষুধের মাধ্যমে সফল চিকিৎসা হলেও পরবর্তীতে অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে।

cancer-4
কিছু প্রথম সারির নিশ্চিত ক্যান্সার জন্য দায়ী কার্সিনোজেন।

ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বিকিরণ দুই প্রকার হতে পারে; অতিবেগুনি রশ্মি এবং তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি DNAয়ের পাশাপাশি দুটি T বা থায়মিন বেসকে বাঁকিয়ে দেয়। ফলে T-বেসগুলো কোভ্যালেন্ট বন্ধনের মাধ্যমে একে অন্যের সাথে জোড়া লেগে যায়, একে বলে পাইরিমিডিন-ডাইমার (Pyrimidine dimers), একই অবস্থা C বা সাইটোসিন-বেসেরও হতে পারে। কোষ বিভাজনের সময় DNA-পলিমারেস এই বেঁকে যাওয়া T-বেসদের শনাক্ত করতে পারে না, ফলে নতুন বিভাজিত কোষে অবাঞ্ছিত মিউটেশন ঘটে।

cancer-6
অতিবেগুনি রশ্মি (UV) দুটো পাশাপাশি T-বেসের ওপর আপতিত হয়।
cancer-7
অতিবেগুনি রশ্মি T-বেসদের বাঁকিয়ে ফেলে।
cancer-8
বেঁকে যাওয়া T-বেসগুলো নিজেদের মধ্যে কোভ্যালেন্ট বন্ধন তৈরি করে, ফলে বেস দুটো জোড়া লেগে যায়।
cancer-9
কোষ বিভাজনের সময় রেপ্লিকেশন প্ৰক্ৰিয়া লক্ষ্যহীনভাবে A-বেসের পরিবর্তে ভুল G এবং C-বেস যুক্ত করে।

অতিবেগুনি রশ্মি মূলত চামড়ার বহিঃস্তরে শোষিত হয়, অত্যাধিক মাত্রা বিভিন্ন চর্ম ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। কিছু ক্যান্সার কম ঝুঁকিপূর্ণ যেমন: স্কোয়ামাস-সেল-কার্সিনোমা এবং ব্যাসেল-সেল-কার্সিনোমা (squamous and basal cell carcinoma), এরা এতোই নিরাময়যোগ্য যে এদের ক্যান্সার পরিসংখ্যানে গণ্যই করা হয় না। কিছু ক্যান্সার বিপদজনক যেমন: মেলানোমা (Melanoma)।

cancer-9
মেলানোমা এবং একে শনাক্ত করার চারটি সহজ উপায়: অপ্রতিসম আকার, অনিয়মিত সীমানা, ছোপ ছোপ রঙের বিন্যাস, এবং ব্যাস ৬ মিলিমিটারের বেশি।

অন্যদিকে, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বলতে বিভিন্ন অস্থিতিশীল মৌল ভেঙ্গে নির্গত, কিংবা পারমাণবিক বিস্ফোরণে নিঃসরিত উচ্চশক্তির আলফা, বেটা, এবং গামা রশ্মির বিকিরণ বোঝায়। এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ যে কতোটা ভয়াবহ সেটা বোঝা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা বা নাগাসাকিতে আণবিক বোমার বিস্ফোরণ থেকে। এইধরণের বিকিরণে DNAয়ের হয় না এমন কোনো ক্ষতিই নেই। যেমন: পাইরিমিডিন-ডাইমার গঠন, একটি বা দুটি স্ট্রান্ডের যুগপৎ ভেঙ্গে যাওয়া, বেস নষ্ট বা পরিবর্তন হওয়া, স্ট্রান্ড দুটোর এলোমেলো জোড়া লেগে যাওয়া, ক্রোমোসোমে DNA যে হিস্টোন প্রোটিনগুলোতে প্যাঁচানো থাকে সেগুলোও এলোমেলোভাবে জোড়া লেগে যেতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ কি কি ক্যান্সারের কারণ হতে পারে সেটা বিশ্লেষণে ১৯৮৪ সালে বিশিষ্ট ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রেনেটো-ডুলবেকো (Renato Dulbecco) পুরো মানব DNAয়ের সিকোয়েন্স নির্ণয়ের প্রস্তাব করেন। ডুলবেকোর এই প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করেই হিউমান-জিনোম-প্রজেক্টের যাত্রা শুরু হয়; ২০০০ সালে জিনোমের প্রথম খসড়া এবং ২০০৩ সালে চূড়ান্ত সিকোয়েন্স প্রকাশ করা হয়।

4341-3
তেজস্ক্রিয় বিকিরণে DNAয়ের সম্ভাব্য ক্ষতি।

বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে বা নিরাময়ে আমরা বিভিন্ন মাত্রার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ব্যবহার করি। X-রশ্মি তার একটা বড় উদাহরণ, সাধারণ X-রশ্মি পরীক্ষণে ক্যান্সার ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু কিছু কিছু পরীক্ষণ যেমন: বেরিয়াম-এনিমা (Barium enema) কিংবা পাকস্থলীর CT-স্ক্যানের বিকিরণ মাত্রা সাধারণ X-রশ্মি পরীক্ষণের চেয়ে যথাক্রমের ১৫০ এবং ৭৫০গুণ বেশি। অত্যাধিক তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মূলত থাইরয়েড-ক্যান্সার, বিভিন্ন রকমের রক্ত এবং চর্ম ক্যান্সারের জন্য দায়ী।

বিকিরণের ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হলো, উচ্চ ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক লাইন এবং মোবাইল ফোন থেকে নির্গত বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকিরণের ওপর প্রচুর গবেষণা হয়েছে, কিন্তু ক্যান্সার হবার সাথে এদের কোনোই সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। এই সমস্ত উৎসগুলোর বিকিরণ মাত্রা অত্যন্ত দুর্বল।

অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি DNA পরিবর্তন না ঘটেও ক্যান্সার হতে পারে। এর আদর্শ একটা উদাহরণ হলো, হেলিকোব্যাক্টের পাইলোরি (Helicobacter pylori বা H. Pylori) ব্যাকটেরিয়া, যেটা পাকস্থলীর আলসারের জন্য দায়ী। সঠিক এন্টিবায়োটিক গ্রহণ না করা হলে এই আলসার ক্যান্সারে পরিণত হবার সম্ভাবনা থাকে।

cancer-5
H. Pylori ব্যাকটেরিয়া মেমব্রেন ভেদ করে পাকস্থলী কোষের ভেতর কার্সিনোজেন (CagA) ঢুকিয়ে দেয়, যেটা পাকস্থলীর ক্যান্সারের জন্য দায়ী।

DNAয়ের এপিজেনেটিক পরিবর্তনও ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। এপিজেনেটিক পরিবর্তন সরাসরি DNAয়ের কোনো পরিবর্তন ঘটায় না, কিন্তু জিন প্রকাশের এদের ভূমিকা ব্যাপক। দুই ধরণের এপিজেনেটিক পরিবর্তন ক্যান্সারের সাথে সম্পৃক্ত, DNA-মিথাইলেশন এবং হিস্টোন-মডিফিকেশন। মিথাইলেশন যদিও রেপ্লিকেশনে সমস্যা করে না, কিন্তু এই মিথাইলেশনের পরিমাণ RNA-পলিমারেসের জন্য বিশাল সমস্যা। অত্যাধিক মিথাইলেশনের ফলে আস্ত জিন RNA-পলিমারেসের কাছে থেকে আড়াল হয়ে যায়, অনেকটা ভারী পর্দা হয়ে ঢেকে রাখা বস্তুর মতো। তাই জিনটির ট্রান্সক্রিপ্ট সম্ভব হয় না এবং জিনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। টিউমার-সাপ্রেশন-জিনের মিথাইলেশন ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা তৈরি করে। বস্তুত DNA-মিথাইলেশন অনেক ক্ষেত্রে লিউকেমিয়া, কোলন, স্তন, পাকস্থলী, ফুসফুস, এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারের জন্য দায়ী।

আগেই বলা হয়েছিলো, DNA ক্রোমোসোমের একাধিক হিস্টোন প্রোটিনে প্যাঁচানো অবস্থায় থাকে, অনেকটা রিলে প্যাঁচানো সুতোর মতো। এইজন্যই ক্রোমোসোমকে বলে DNAয়ের প্যাকেজিং। ক্রোমোসোমে এই হিস্টোন প্রোটিনগুলোর সামগ্রিক আকার অনেক ক্ষেত্রে জিনের প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। সময়ের সাথে সাথে এই হিস্টোন প্রোটিনগুলোর বিন্যাস এমনভাবে পরিবর্তিত হতে পারে যে, কোনো কোনো জিন প্রোটিনগুলোর ভাঁজে চাপা পরে যায়, ফলে RNA-পলিমারেসে তাদের খুঁজে পায় না। এই জিন যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ টিউমার-সাপ্রেশন-জিন হয়ে থাকে তবে ক্যান্সারের সম্ভাবনা রয়েছে। এই হিস্টোন-মডিফিকেশন ভিত্তিক কিছু কেমোথেরাপি ঔষধ রয়েছে, যাদের বলা হয় HDAC (Histone deacetylase inhibitors), এই শ্রেণীতে একটি ঔষধ হলো ভোরিনোস্টেট (Vorinostat) বা জোলিঞ্জা (Zolinza)। এই ঔষধগুলো ক্রোমোসোমের হিস্টোন প্যাকেজিং খুলতে সাহায্য করে, ফলে চাপা পড়ে থাকা টিউমার-সাপ্রেশন-জিনগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে।

কিছু কিছু খনিজ পদার্থ DNAয়ের পরিবর্তন না করেও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন: অ্যাসবেস্টস (Asbestos); অ্যাসবেস্টস এক ধরণের প্রাকৃতিক তন্তু, নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণের ফলে এই খনিজ ফুসফুস-সহ দেহের বিভিন্ন কোষে জমা হতে থাকে। মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসবেস্টস একটি বিশেষ ধরণের ক্যান্সার তৈরি করে, নাম মেসোথ্যালিনোমা (Mesothelioma), এই ক্যান্সার হতে পারে ফুসফুস, হৃৎপিণ্ডে, কিংবা পাকস্থলীতে। মেসোথ্যালিনোমার একমাত্র কারণ অ্যাসবেস্টস, আমাদের জানা মতে অন্য কোনো কার্সিনোজেন এই ক্যান্সার ঘটে না। আমাদের দেশ জাহাজ তৈরি এবং ভাঙ্গা শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকরা এই ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে।

thick-uterine-lining
এস্ট্রোজেন জরায়ুর ভেতর এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের জন্য দায়ী।

আমরা আগে একটি কার্সিনোজেন দেখেছিলাম যার নাম এস্ট্রোজেন (Estrogen); এস্ট্রোজেন একটি মেয়েলি হরমোন। এস্ট্রোজেন মেয়েদের মাসিকচক্র (Menstrual cycle) নিয়ন্ত্রণ এবং জরায়ুর অভ্যন্তরীণ কোষ (Uterus lining) প্রতিস্থাপনে সাহায্য করে। এস্ট্রোজেন মূলত জরায়ুর কোষে অবস্থিত রিসেপ্টর-প্রোটিনে যুক্ত হয় এবং কোষ বিভাজনে সাহায্য করে। নারীস্তনেও প্রচুর পরিমাণের এই এস্ট্রোজেন-রিসেপ্টর-প্রোটিন রয়েছে। দীর্ঘ এবং অত্যাধিক এস্ট্রোজেন নিঃসরণ জরায়ুতে এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার (Endometrial) এবং স্তন-ক্যান্সারের জন্য দায়ী। এই ক্যান্সারগুলোর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি মাসিকচক্র চলার সময়; এবং সবচেয়ে কম প্রসব পরবর্তী সময়গুলোতে যখন মাসিকচক্র বন্ধ থাকে। প্রচলিত আছে যে, সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর সময়টাতে স্তন ক্যান্সার হয় না, ব্যাপারটা আসলে এস্ট্রোজেন নিঃসরণের সাথে সম্পর্কিত। মাসিকচক্র পরবর্তী বয়সে (Menopause) এস্ট্রোজেন হরমোনের অভাবে নারীদের হাড়ে ব্যাথাসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, পশ্চিমাবিশ্বে একসময় এই উপসর্গগুলোর নিরাময় হরমোন থেরাপি দেয়া হতো, এই থেরাপিতে থাকতো তিনটি হরমোন নাম: এস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরোন, এবং প্রোজেস্টিন (Estrogen/Progesterone/Progestin Hormone Therapy)। এই হরমোন থেরাপির ফলে আশঙ্কাজনকভাবে স্তন ক্যান্সারের হার বেড়ে যায়, এবং গবেষণায় এস্ট্রোজেনকে এর কারণ হিসেবে পাওয়া যায়।

এস্ট্রোজেন-রিসেপ্টর-প্রোটিনের জন্য দায়ী জিনের এমন মিউটেশন ঘটে পারে যাতে এস্ট্রোজেন ছাড়াই রিসেপ্টর-প্রোটিনগুলো কোষ বিভাজনের সংকেত দিতে থাকে; এই ধরণের মিউটেশনও এন্ডোমেট্রিয়াল এবং স্তন-ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

আগের পর্ব – প্রাচীনতম ব্যাধি
পরের পর্ব – টিউমার

অবলম্বনে: “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “What Science Knows about Cancer” by “David Sadava”