বাস্তবতা কি? “কণা” নাকি “তরঙ্গ”? আমরা জানি, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু এবং বিকিরণ কোনো না কোনো মৌলিক কণা দিয়ে তৈরি। প্রশ্ন হতে পারে, এই কণাদের উৎপত্তি কোথায় থেকে?
তিরিশের দশক থেকেই মহাবিশ্বের বাস্তবতা সম্পর্কে একটি গাণিতিক ধারণা গড়ে ওঠে। ধারণাটির ওপর সক্রিয় তাত্ত্বিক কাজ শুরু ষাটের দশকে। এবং সত্তরের দশকে ধারণাটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এই ধারণা অনুসারে, কণারা হলো অলীক আর বাস্তবতা হলো কোয়ান্টাম-ফিল্ড। এই ধারণাটির আনুষ্ঠানিক নাম, কোয়ান্টাম-ফিল্ড-থিওরি।
কোয়ান্টাম-ফিল্ড-থিওরি অনুসারে, আমরা এবং আমাদের পাশের সবকিছুই বিভিন্ন কোয়ান্টাম-ফিল্ড দিয়ে তৈরি। এই কোয়ান্টাম-ফিল্ডগুলোর কম্পন থেকে পাওয়া যায় বিভিন্ন কণা। যেমন: ইলেক্ট্রন হলো ইলেক্ট্রন-ফিল্ডের কম্পন, ফোটন হলো বিদ্যুৎচুম্বকীয়-ফিল্ডের কম্পন, ইত্যাদি। কোয়ান্টাম-ফিল্ডগুলো পুরো স্থানকাল জুড়ে বিস্তৃত। স্থানকালের প্রতিটি বিন্দুতে এই ফিল্ডগুলোর নির্দিষ্ট কিছু মান থাকে। স্থানকালের কোনো বিন্দুতে কোয়ান্টাম-ফিল্ডের মান শূন্য হলে ঐ বিন্দুতে কণা পাওয়ার যায় না; আর অশূন্য হলে আমরা তাকে কণা হিসেবে গণ্য করি। অর্থাৎ, কণারা বস্তুত কোয়ান্টাম-ফিল্ডের পরিমাপ ছাড়া বেশি কিছু নয়। কোয়ান্টাম-ফিল্ড থেকে কণা পরিমাপের পদ্ধতিকে বলে সেকেন্ড-কোয়ান্টাইজেশন। এই পদ্ধতিতে প্রথমে ফিল্ডের কম্পনকে কোয়ান্টা আকারে পরিমাপ করা হয়, এরপর কোয়ান্টাগুলো থেকে কণাদের শক্তিস্তর নির্ণয় করা হয়।
কোয়ান্টাম-মেকানিক্সের এক্সপেরিমেন্টাল সফলতা অসামান্য। কিন্তু, সমস্যা হলো এর তথ্য-উপাত্তের ব্যাখ্যা নিয়ে। কোয়ান্টাম-মেকানিক্যাল আচরণ ব্যাখ্যা নিয়ে বিভিন্ন ইন্টারপ্রিটেশন বা মতবাদ রয়েছে। তবে প্রতিটি মতবাদের সার্বজনীন বিষয়টি হলো, আমরা যখন কোনো ফিল্ডকে পর্যবেক্ষণ করি তখনই কণার আবির্ভাব ঘটে। অর্থাৎ, বাস্তবতা হলো ফিল্ড কিন্তু আমরা দেখি কণা।
কোয়ান্টাম-ফিল্ডের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, কণাদের স্থানীয়করণ বা লোক্যালাইজ করা। মহাবিশ্বের প্রতিটি ইলেক্ট্রন অভিন্ন, কারণ এদের উৎপত্তি একই ইলেক্ট্রন-ফিল্ড থেকে। কিন্তু, কণার উপস্থিতি একটি স্থানীয় ঘটনা। যেমন: পৃথিবীতে অবস্থিত ইলেক্ট্রনগুলোর উৎস পৃথিবী এবং পৃথিবীর আশেপাশের ইলেক্ট্রন-ফিল্ডের কম্পন। এবং মঙ্গল গ্রহের ইলেক্ট্রনগুলোর উৎস মঙ্গল ও তার আশেপাশের ইলেক্ট্রন-ফিল্ডের কম্পন। আর তাই, স্থানকালের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ইলেক্ট্রন পাঠানোর মানে হলো, এক অঞ্চলের ইলেক্ট্রন-ফিল্ডের কম্পন ঢেউয়ের মতো প্রবাহিত হয়ে অন্য অঞ্চলের ইলেক্ট্রন-ফিল্ডে কম্পন সৃষ্টি করা। অর্থাৎ, স্থানকালে কোনো অঞ্চলে কণা উপস্থিতির কারণ স্থানীয় ফিল্ডের কম্পন।
কোনো কোয়ান্টাম-ফিল্ডের স্থানীয় পরিমাপ যদি শুধু একটি মান (বা কোয়ান্টা) পাওয়া যায়, তবে এই ধরণের কোয়ান্টাম-ফিল্ডকে বলে, ফার্মিয়নিক-ফিল্ড। ইলেক্ট্রন-ফিল্ড, কোয়ার্ক-ফিল্ড, ইত্যাদি হলো ফার্মিয়নিক-ফিল্ড। ফার্মিয়নিক-ফিল্ডগুলোর কম্পন থেকে ফার্মিয়ন কণা পাওয়া যায়। এই ধরণের ফিল্ডগুলোর পরিমাপ থেকে নির্দিষ্ট একটি মান পাওয়ার কারণ হলো, পাউলির-বর্জননীতি। অন্যদিকে, কোনো ফিল্ড পরিমাপে যদি একাধিক মান (বা কোয়ান্টা) পাওয়া যায়, তবে তারা হলো বোসনিক-ফিল্ড। বিদ্যুৎচুম্বকীয়, গ্লুয়ন-ফিল্ড, ইত্যাদি হলো বোসনিক-ফিল্ড।
প্রকৃতিতে চারটি বোসনিক-ফিল্ড আছে যারা বল বহন করে, এরা ফোর্স-ফিল্ড বা বলক্ষেত্র: বিদ্যুৎচুম্বকীয়, মাধ্যাকর্ষণ, প্রবল-নিউক্লিয়ার, এবং দুর্বল-নিউক্লিয়ার। বিদ্যুৎচুম্বকীয় এবং মাধ্যাকর্ষণ বলক্ষেত্রের প্রভাব দূরগামী (Long range), আর তাই আমরা এদের সহজেই পরিমাপ করতে পারি। অন্যদিকে, প্রবল-নিউক্লিয়ার এবং দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র অত্যন্ত স্বল্পপ্রসারী (Short range), এদের প্রভাব বলয় শুধুই পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
প্রকৃতিতে কেনো বলক্ষেত্রের উৎপত্তি হয় সেটা সম্পর্কে ষাটের দশকেই পদার্থবিদদের একটা শক্ত গাণিতিক ধারণা ছিলো, যাকে বলে প্রতিসাম্যতা (Symmetry)। প্রতিসাম্যতা কাজ হলো কোনো ভৌত-প্রক্রিয়াকে মহাবিশ্বের যেকোনো স্থানে একই রকমভাবে প্রকাশ করা। যেই বিশেষ প্রতিসাম্যতার কারণে প্রকৃতিতে বলক্ষেত্রের উৎপত্তি ঘটে তাকে বলে পরিমাপগত-প্রতিসাম্যতা বা গেজ-সিমেট্রি (Gauge symmetry)। গেজ-সিমেট্রি থেকে যে ধরণের বলক্ষেত্র সৃষ্টি করে, সেগুলো সবসময় দূরগামী। অন্যদিকে, নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্রগুলোর উৎসও গেজ-সিমেট্রি, কিন্তু এরা অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরের। প্রশ্ন হলো কেনো? ষাটের দশকেই পদার্থবিদরা নিশ্চিত ছিলেন যে, স্বল্পপ্রসারী বলক্ষেত্রগুলোর কারণ হলো গেজ-সিমেট্রির ভাঙ্গন। অর্থাৎ, গেজ-সিমেট্রি অক্ষত থাকলে দূরগামী বলক্ষেত্র পাওয়া যায়, এবং গেজ-সিমেট্রি ভেঙ্গে গেলে স্বল্পপ্রসারী বলক্ষেত্র পাওয়া যায়।
আগেই বলা হয়েছিলো, মহাবিশ্ব কোয়ান্টাম-ফিল্ড দিয়ে তৈরি, তাই এই গেজ-সিমেট্রি ভাঙ্গনের কারণ নিশ্চিতভাবে কোনো না কোনো কোয়ান্টাম-ফিল্ড। আজ আমরা জানি, প্রবল-নিউক্লিয়ার এবং দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র দুটির স্বল্পপ্রসারী হবার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে, গেজ-সিমেট্রি ভাঙ্গনের মাধ্যমে দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র সংকুচিত করার জন্য দায়ী কোয়ান্টাম-ফিল্ডের নাম হলো, হিগ্গস-ফিল্ড। হিগ্গস-ফিল্ড একটি বোসনিক-ফিল্ড, কিন্তু এর উৎপত্তি গেজ-সিমেট্রি নয়। হিগ্গস-ফিল্ড কোনো বলক্ষেত্র নয়, তাই হিগ্গস-কণারা বল বহন করে না। এটি একটি স্কেলার-ফিল্ড, অর্থাৎ এই ফিল্ড সবদিকেই সমান প্রভাব বিস্তার করে। ষাটের দশক থেকেই পদার্থবিদরা এই স্কেলার-বলক্ষেত্রের কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই, ২০১২ সালের জুলাইতে হিগ্গস-কণা আবিষ্কারের আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণাটি যতোটা না হিগ্গস-কণার জন্য, তারচেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো পঞ্চাশ বছরের পুরোনো হিগ্গস-ফিল্ড ধারণাটি প্রামাণিত হবার জন্য।
হিগ্গস-কণারা পদার্থ বা বিকিরণ তৈরি করে না, তাই হিগ্গস-কণার প্রভাব আমাদের জীবনে নেই বললেই চলে। কিন্তু, আমাদের মহাবিশ্বে হিগ্গস-ফিল্ডের অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে: দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্রকে সংকুচিত করা এবং বিভিন্ন মৌলিক কণাদের ভর প্রদান।
আমরা যদি একটি পরমাণুর দিকে তাকাই, তবে সহজেই বিভিন্ন বলক্ষেত্রের প্রভাব দেখতে পারি। প্রবল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র প্রোটন এবং নিউট্রন তৈরি করে, এবং নিউক্লিয়াসে প্রোটন এবং নিউট্রনগুলোকে একসাথে ধরে রাখতে সাহায্য করে। বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলক্ষেত্র নিউক্লিয়াস এবং ইলেক্ট্রনকে একসাথে ধরে রাখে। মাধ্যাকর্ষণ অগণিত পরমাণুদের এক জায়গায় জড়ো হয়ে গ্রহ নক্ষত্র তৈরিতে সাহায্য করে।
প্রবল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র পরিমাপে পাওয়া যায় গ্লুয়ন কণা। গ্লুয়ন কণারা রং-সংবেদনশীল। অর্থাৎ, এরা রংযুক্ত কণাদের ওপর কাজ করে। এই রংযুক্ত কণা পরিবারকে বলে কোয়ার্ক। অন্যদিকে লেপ্টন পরিবারের সদস্যদের রং নেই, তাই লেপ্টনেরা প্রবল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্রে সাড়া দেয় না। গ্লুয়ন কণারা নিজেরাও রংযুক্ত, তাই গ্লুয়নেরা একে অন্যের সাথে মিলেমিশে গ্লুয়োবল কণা তৈরি করতে পারে। যদিও, এখনো কোন গ্লুয়োবল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলক্ষেত্র পরিমাপে পাওয়া যায় ফোটন, ফোটনেরা চার্জযুক্ত কণাদের ওপর কাজ করে। চার্জবিহীন কণা, যেমন: নিউট্রিনোর ওপর ফোটনের কোনোই প্রভাব নেই। ফোটন নিজেও চার্জবিহীন, তাই ফোটনেরা একে অন্যের সাথে কোনো রকম কার্যালাপে জড়ায় না।
মাধ্যাকর্ষণ বলক্ষেত্র হলো স্থানকালের একটি বৈশিষ্ট্য। স্থানকালের এই বৈশিষ্ট্যকে বলে জ্যামিতিক-বক্রতা। কোয়ান্টাম-ফিল্ড-থিওরি অনুসারে, স্থানকালের জ্যামিতিক-বক্রতাকে কোয়ান্টাইজ করলে গ্র্যাভিটন কণা পাওয়া যায়। গ্র্যাভিটন কণার ভরযুক্ত কণাদের ওপর কাজ করে। গ্র্যাভিটন, ফোটন, এবং গ্লুয়ন কণারা ভরহীন। তাই গ্র্যাভিটন নিজেদের ওপর, কিংবা ফোটন ও গ্লুয়নের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করে না। গ্র্যাভিটন এবং ফোটন ভরহীন, তাই মাধ্যাকর্ষণ এবং বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলক্ষেত্র দূরগামী। গ্লুয়নও ভরহীন কিন্তু প্রবল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র স্বল্পগামী, কারণটা হলো আবদ্ধকরণ (Confinement)।
পার্টিকেল-ফিজিক্সে ভরের একক হলো ইলেক্ট্রন-ভোল্ট বা eV। একটি ইলেক্ট্রনকে এক ভোল্ট বিভব-পার্থক্যে নিতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন তাকে বলে এক ইলেক্ট্রন-ভোল্ট। এক বিলিয়ন ইলেক্ট্রন-ভোল্টকে বলে এক GeV। আমাদের দৈনন্দিন পরিমাপে, একটি মশার গতিশক্তি প্রায় একশ GeV।
অন্যদিকে, দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র হলো একমাত্র বলক্ষেত্র যেটা একটি কণাকে অন্য কণায় পরিণত করতে পারে। কণাদের মধ্যকার এই রূপান্তরকে আমরা বলি তেজস্ক্রিয়তা। দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র পরিমাপে পাওয়া যায় তিন ধরণের কণা: W-, W+, এবং Z কণা। W- ও W+ প্রত্যেকের ভরই প্রায় 80GeV এবং Z কণার ভর প্রায় 91Gev। লম্বা দূরত্বে এই বিশাল ভরের W এবং Z বোসন আদান-প্রদান করা সম্ভব নয়, এইজন্যই দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র স্বল্পগামী। আর, W এবং Z বোসনের ভরের উৎস হলো হিগ্গস-ফিল্ড।
আমরা আগেই বলেছিলাম যে, ওপরের আলোচিত চারটি বলক্ষেত্রের উৎপত্তি গেজ-সিমেট্রি থেকে। এবার এই গেজ-সিমেট্রির দিকে তাকানো যাক।
জ্যামিতির ভাষায় প্রতিসাম্যতা (Symmetry) শব্দটার মানে হলো, যে পরিবর্তন কোনো পার্থক্য ঘটায় না। যেমন: একটি বর্গক্ষেত্রকে ৯০° বা ৯০°য়ের গুণিতক কোণে ঘোরালে একই বর্গক্ষেত্র ফেরৎ পাওয়া যাবে। একইভাবে, একটি আয়তক্ষেত্র ১৮০° প্রতিসাম্যতার বজায় রাখে। অন্যদিকে, একটি বৃত্তকে যেকোনো কোণেই ঘোরানো হোক না কেনো, আমরা ঘুরে ফিরে একই বৃত্ত ফেরৎ পাবো। তাই বৃত্তের প্রতিসাম্যতা বর্গক্ষেত্র কিংবা আয়তক্ষেত্র থেকে অনেক বেশি।
জ্যামিতিক আকারগুলোকে ওপরে বর্ণিত বিভিন্ন কোণে ঘোরানোকে বলা হয় রূপান্তর বা ট্রান্সফর্মেশন (Transformation)। গণিতের যে শাখায় প্রতিসাম্যতা নিয়ে কাজ করা হয় তাকে বলে গ্রুপ-থিওরি। গ্রুপ-থিওরিতে বিভিন্ন রূপান্তরের অধীনে বস্তুর প্রতিসাম্যতার পরিমাপ করা হয়। কোনো বস্তুর একাধিক স্বাধীন প্রতিসাম্যতা থাকে পারে, এই স্বাধীন প্রতিসাম্যতাগুলোকে একসাথে বলা হয় সিমেট্রি-গ্রুপ।
এই জ্যামিতিক প্রতিসাম্যতাকে যদি স্থানকালে ওপর অবস্থিত কোনো ভৌত-প্রক্রিয়ার (Physical process) ওপর প্রয়োগ করা হয়, তবে ঘূর্ণন (Rotation) বাদেও আরো দুই ধরণের রূপান্তর পাওয়া যাবে।
ট্রান্সলেশন (Translation): ট্রান্সলেশন দুই ধরণের হতে পারে; স্পেস-ট্রান্সলেশন: যেখানে একই ভৌত-প্রক্রিয়া স্থানকালের দুটি ভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনভাবে ঘটানো হয়। টাইম-ট্রান্সলেশন; যেখানে স্থানকালের নির্দিষ্ট অঞ্চলে একই ভৌত-প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন সময় ব্যবধানে ঘটানো হয়।
সবশেষে, বুস্ট (Boosts): যেখানে একই ভৌত-প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন গতিশীল রেফারেন্স-ফ্রেমে ঘটানো হয়; যেমন: চলমান রকেটের ভেতর বা ভূপৃষ্টের গবেষণাগারে ঘটানো কোনো এক্সপেরিমেন্ট ইত্যাদি।
ঘূর্ণন, ট্রান্সলেশন, এবং বুস্টকে একসাথে বলে পয়েনকেয়ার-গ্রুপ (Poincaré group)। পদার্থবিজ্ঞানের এই পয়েনকেয়ার-গ্রুপ একটি গুরুত্বপূর্ণ গেজ-সিমেট্রি-গ্রুপ। এখানে “গেজ” শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হলো “পরিমাপ” করা। কারণ এইধরণের প্রতিসাম্যতা খুঁজতে হলে, স্থানকালের দুই বা ততোধিক বিন্দুতে রূপান্তরগুলোর স্থানীয় পরিমাপ করতে হয়। আর, এইজন্যই গেজ-সিমেট্রিকে বলা হয় স্থানীয়-প্রতিসাম্যতা (Local symmetry)।
স্থানকালের দুটি কাছাকাছি বিন্দুর গেজ-সিমেট্রি সহজেই বিন্দু দুটির রূপান্তর পরিমাপের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়। কিন্তু, সমস্যা হলো স্থানকালের দূরবর্তী বিন্দুগুলোর ক্ষেত্রে। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা অনুসারে, স্থানকালের প্রতিটি অঞ্চলের “স্থান” এবং “কাল” পুরোপুরি স্বাধীন। এজন্যই স্থানকালের একাধিক অঞ্চলের পরিমাপগুলো যুগপৎ করা যায় না। তাই পরিমাপগুলো যদি যুগপৎ না হয় তবে, মহাবিশ্বের দূরবর্তী কোয়ান্টাম-ফিল্ডগুলো যে গেজ-সিমেট্রি রক্ষা করে সেটা আমরা নিশ্চিত হবো কিভাবে?
স্থানকালে ছড়িয়ে থাকা কোয়ান্টাম-ফিল্ডগুলোর গেজ-সিমেট্রি বজায় রাখতে গাণিতিকভাবে দরকার হয় গেজ-ফিল্ডের। গেজ-ফিল্ডের কাজ হলো বিভিন্ন ফার্মিয়নিক-ফিল্ডকে যুক্ত করা, তাই এদের কখনো কখনো কানেকশন-ফিল্ডও (Connection field ) বলা হয়। হেরম্যান-ওয়াইল (Hermann Weyl) এই গেজ-ফিল্ডকে তুলোনা করেন রেললাইনের সাথে। রেললাইনের দুই ইস্পাতের পাতের মাঝে সুনির্দিষ্ট ফাঁক থাকে। কোনো কারণে এই ফাঁকের পরিমাণ পরিবর্তিত হলে, এই পরিবর্তনকে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ডাইনামিক্স। আর এই পরিবর্তন বা ডাইনামিক্স পরিমাপ করাকেই “গেজ” বলে। ঠিক একইভাবে মহাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রেললাইনের মতো গেজ-ফিল্ডগুলোর কাজ হলো বিভিন্ন ফার্মিয়নিক-ফিল্ডের গেজ-সিমেট্রির পরিবর্তন বা ডায়নামিক্স পরিমাপ করা। আর, এই পরিবর্তনকে কোয়ান্টাইজ করা হলে আমরা পাই ভরহীন, বল-বহনকারী বোসন কণা। যেহেতু, গেজ-ফিল্ডগুলো এক ফার্মিয়নিক-ফিল্ডের সাপেক্ষে অন্য ফার্মিয়নিক-ফিল্ডের গেজ-সিমেট্রির পরিবর্তন পরিমাপ করে, তাই এই পরিবর্তনগুলোর দিক রয়েছে। অর্থাৎ, যেকোনো গেজ-ফিল্ডের পরিবর্তনগুলোর ভেক্টরের মাধ্যমে সূচিত করতে হয়। ফলে, গেজ-ফিল্ড থেকে পাওয়া বোসনদের দিক থাকে।
গাণিতিকভাবে গেজ-সিমেট্রিকে ঐকিক-ম্যাট্রিক্স U(n) বা গুচ্ছ ঐকিক-ম্যাট্রিক্স SU(n)য়ের (Set of Unitary matrices) মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এখানে n হলো ম্যাট্রিক্সের উপাদান। পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড-মডেল তিনটি গেজ-সিমেট্রি-গ্রুপের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, একে বলে SU(3)xSU(2)xU(1)।
ফার্মিয়নদের চার্জ সম্পর্কিত গেজ-সিমেট্রি গাণিতিকভাবে সূচিত করা হয় গুচ্ছ ঐকিক-ম্যাট্রিক্স SU(1)য়ের মাধ্যমে। SU(1) গেজ-সিমেট্রি-গ্রুপটির ভালো নাম ইলেক্ট্রো-ডাইনামিক্স (QED)। গাণিতিকভাবে ঐকিক-ম্যাট্রিক্স U(1) একটি বৃত্তের ত্রিমাত্রিক ঘূর্ণন-প্রতিসাম্যতা বোঝায়। SU(1) গেজ-সিমেট্রি-গ্রুপ থেকে যেই বলক্ষেত্রের উদ্ভব হয়, তাকে বলে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলক্ষেত্র।
ফার্মিয়নদের তেজস্ক্রিয়-ক্ষয় সম্পর্কিত গেজ-সিমেট্রি গাণিতিকভাবে সূচিত করা হয় গুচ্ছ ঐকিক-ম্যাট্রিক্স SU(2)য়ের মাধ্যমে। এই SU(2) গেজ-সিমেট্রি-গ্রুপের নাম উইক-ইন্টারঅ্যাকশন (Weak interaction)। গাণিতিকভাবে SU(2) একটি গোলকের ত্রিমাত্রিক ঘূর্ণন-প্রতিসাম্যতা বোঝায়। SU(2) গেজ-সিমেট্রি-গ্রুপ থেকে যেই বলক্ষেত্রের উদ্ভব হয় তাকে বলে দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র।
কোয়ার্কদের রং সম্পর্কিত গেজ-সিমেট্রিকে গাণিতিকভাবে সূচিত করা হয় আরেকটি গুচ্ছ ঐকিক-ম্যাট্রিক্স SU(3) মাধ্যমে। এই গেজ-সিমেট্রি-গ্রুপের নাম ক্রোমো-ডাইনামিক্স (QCD)। এই SU(3)য়ের জন্যই যখন কোনো কোয়ার্কের কথা বলা হয়, তখন কোয়ার্কটির রং উল্লেখ করার প্রয়োজন হয় না। SU(3) গেজ-সিমেট্রি-গ্রুপ থেকে যেই বলক্ষেত্রের উদ্ভব হয়, তাকে বলে প্রবল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র।
SU(3)xSU(2)xU(1) গেজ-সিমেট্রি-গ্রুপ থেকে মাধ্যাকর্ষণকে বাদ দেয়া হয়েছে। মাধ্যাকর্ষণ নিজেও একটি গেজ-ফিল্ড। এই গেজ-ফিল্ডের উৎস স্থানকালের গেজ-সিমেট্রি। সমস্যা হলো, স্থানকালের গেজ-সিমেট্রির পরিবর্তন বা ডায়নামিক্সকে এখনো সফলভাবে কোয়ান্টাইজ করা যায়নি।
গেজ-সিমেট্রির ওপর ভিত্তি করে সর্বপ্রথম যে বলক্ষেত্রকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছিলো সেটি হলো বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলক্ষেত্র। এরপর মাধ্যাকর্ষণ। ১৯৫৪ সালে পদার্থবিদ ইয়াং (Chen Ning Yang) এবং মিল (Robert Mills) ধারণা দেন যে, নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র দুটোর উৎপত্তির কারণও গেজ-সিমেট্রি। তাদের এই ধারণাকে বলে ইয়াং-মিল-থিওরি। ইয়াং-মিল-থিওরি হলো কোয়ান্টাম-ফিল্ড-থিওরির একটা অংশ যেটা প্রকৃতির প্রতিটি বলক্ষেত্রকে গেজ-সিমেট্রির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। সমস্যা হলো, গেজ-সিমেট্রি মাধ্যমে পাওয়া বোসনগুলো হয় ভরহীন এবং বলক্ষেত্রগুলো হয় দীর্ঘগামী, তাই এদের খুঁজে পাওয়া সহজ। ইয়াং-মিল-থিওরি অনুসারে, নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্রগুলো হওয়ার কথা ছিলো বিদ্যুৎচুম্বকীয় কিংবা মাধ্যাকর্ষণের মতোই দীর্ঘগামী, কিন্তু পর্যবেক্ষণ বলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। এইজন্যই ইয়াং-মিল-থিওরি প্রাথমিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
১৯৫৭ সালের দিকে মার্কিন পদার্থবিদ জুলিয়ান সুইঙ্গার (Julian Schwinger), ইয়াং-মিল-থিওরির মাধ্যমে দুর্বল-নিউক্লিয়ার বল ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তিনি গোলকের ঘূর্ণন-প্রতিসাম্যতার ওপর ভিত্তি করে একটি সিমেট্রি-গ্রুপ তৈরি করেন। এই সিমেট্রি-গ্রুপটি তিন ধরণের কণা ভবিষ্যদ্বাণী করে। সুইঙ্গার এদের মধ্যে চার্জযুক্ত নতুন কণা দুটির নাম দেন, W-/W+। ভবিষ্যদ্বাণীর তৃতীয় চার্জহীন কণাটি ছিলো ফোটন। পর্যবেক্ষণের সাথে মেলাতে সুইঙ্গার W-/W+ বোসনগুলোকে নিজ হাতে ভর প্রদান করেন। এরপরও সুইঙ্গার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, কারণ একবছর আগেই ১৯৫৬ সালে চীনা বংশোদ্ভুত পদার্থবিদ উ (Chien-Shiung Wu) প্রমাণ করেন যে, দুর্বল-নিউক্লিয়ার বল আয়নার-প্রতিসাম্যতা বা পি-সিমেট্রি (P-symmetry ) লঙ্ঘন করে, একে বলে প্যারিটি-ভায়োলেশন (Parity violation)। প্রবল-নিউক্লিয়ার, বিদ্যুৎচুম্বকীয়, এবং মাধ্যাকর্ষণ বলক্ষেত্রগুলোর জন্য পি-সিমেট্রি একটি সংরক্ষিত প্রতিসাম্যতা। আর তাই, দুর্বল-নিউক্লিয়ার এবং বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলক্ষেত্র কখনো একই গেজ-সিমেট্রি থেকে উৎপত্তি হতে পারে না।
সমসাময়িক ধারণা প্রচলিত ছিলো যে, বাকি তিনটি বলক্ষেত্রের মতোই দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্রও হয়তো পি-সিমেট্রি সংরক্ষণ করে। এজন্যই উয়ের এক্সপেরিমেন্টের উদ্দেশ্য ছিলো, দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলের পি-সিমেট্রির নিত্যতা নিশ্চিত করা।
উ কিছু অতিশীতল কোবাল্ট-৬০ সমাণুকে একটি চুম্বকক্ষেত্রে ভাসমান অবস্থায় রাখেন। এতে সমস্ত কোবাল্ট-৬০ পরমাণুর নিউক্লিয়ার-স্পিন একটি নির্দিষ্ট দিকে বিন্যস্ত হয়। এক্সপেরিমেন্ট করার সময় চুম্বকক্ষেত্রের মেরু পরিবর্তনের মাধ্যমে কোবাল্ট-৬০ পরমাণুর নিউক্লিয়ার-স্পিনের দিক পরিবর্তনের ব্যবস্থা ছিলো। এভাবেই উ নিউক্লিয়ার-স্পিনের দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এক্সপেরিমেন্টটির বিন্যাস আয়নার-প্রতিবিম্বের মতো তৈরি করেছিলেন।
তেজস্ক্রিয় বেটা-ক্ষয়ে গামারশ্মি এবং ইলেক্ট্রন নিঃসরণ ঘটে। গামারশ্মি হলো ফোটন, আর ফোটন পি-সিমেট্রি মেনে চলে। ফলে, বিভিন্ন নিউক্লিয়ার-স্পিনের ক্ষেত্রে ফোটন এবং ইলেক্ট্রনের গতিপথের তুলোনা করলে সহজেই তেজস্ক্রিয়-ক্ষয়ের পি-সিমেট্রি নির্ণয় করা সম্ভব।
উ লক্ষ্য করেন যে, বেটা-ক্ষয়ে বেরিয়ে যাওয়া ইলেক্ট্রনদের গতিপথ সবসময়ই নিউক্লিয়ার-স্পিনের উল্টো দিকে। অর্থাৎ, দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র কোনো না কোনোভাবে “বাস্তব” এবং “প্রতিবিম্ব” দুইয়ের মাঝে পার্থক্য বুঝতে পারে, এবং নিজেকে সেভাবেই খাপ খাইয়ে নেয়। ফলে, দুর্বল-নিউক্লিয়ার বলক্ষেত্র পি-সিমেট্রি সংরক্ষণ করে না।
সুইঙ্গার তার অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব দেন তার ছাত্র শেল্ডন-গ্ল্যাশোকে (Sheldon Glashow), গ্ল্যাশো সুইঙ্গারের গেজ-সিমেট্রির সাথে আরেকটি সিমেট্রি যোগ করেন। নতুন সিমেট্রি জন্ম দেয় চার্জহীন Z বোসনের। সুইঙ্গারের মতোই গ্ল্যাশোও নিজ হাতে Z বোসনের ভর প্ৰদান করেন। প্যারিটি-ভায়োলেশন ছাড়াও গ্ল্যাশো বড় সমস্যা ছিলো, তার প্রস্তাবিত গেজ-সিমেট্রিগুলোর কোনো পর্যবেক্ষণকৃত প্রমান ছিলো না।
আজ আমরা জানি, গ্ল্যাশো ও সুইঙ্গারের গেজ-সিমেট্রিগুলোর না পাওয়ার কারণ হলো হিগ্গস-ফিল্ড। হিগ্গস-ফিল্ডের কারণেই এই গেজ-সিমেট্রিগুলো ভেঙে যায় এবং W/Z বোসনেরা পায় বিশাল ভর।
অবলম্বনে: “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “The Higgs Boson and Beyond” by “Sean Carroll”