মরণব্যাধি ক্যান্সার: প্রাচীনতম ব্যাধি

এইডসকে একসময় মনে করা হতো মৃত্যুদণ্ড। HIV পজিটিভ হবার খবর ছিলো যেনো মৃত্যু পরোয়ানা। আজ ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় ২৫ বছর বয়সী কেউ যদি এইডসে আক্রান্ত হয় এবং সঠিক চিকিৎসা নিতে থাকে, তবে তার গড় আয়ুর প্রত্যাশা হবে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতোই। আমরা কার্যত এইডসকে পরাজিত করেছি। কিন্তু সেই ইউরোপ, আমেরিকা, এবং অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি তিনজনে একজন মারাত্মক এবং মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং প্রতি চারজনে একজন ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করে। ক্যান্সার একটা প্রাচীন রোগ। ঐতিহাসিক নথিপত্র অনুসারে আমাদের জানা সবচেয়ে প্রাচীন ক্যান্সারের নজির দুইলক্ষ পঞ্চাশ হাজার বছরের পুরোনো।  প্রশ্ন হলো, এতো প্রাচীন একটা রোগকে কেনো আমরা আজো বশে আনতে পারলাম না?

ক্যান্সার মূলত বৃদ্ধ প্রবীণ মানুষের রোগ। গড় আয়ু বেশি হওয়ায় ধনী দেশগুলোতে ক্যান্সারের ঝুঁকি গরীব দেশগুলোর তুলোনা বেশি। প্রাচীনকালে মানুষের আয়ুষ্কাল কম ছিলো তাই বর্তমান সময়ের মতো ক্যান্সারের প্রকোপও এতো ছিলো না। যুগে যুগে ক্যান্সার সম্পর্কে মানুষের বিভিন্ন ধারণা প্রচলিত ছিলো। তবে ক্যান্সারের আধুনিক ধারণার সারমর্ম হলো: (এক) ক্যান্সার একটি ভৌত রাসায়নিক প্রক্রিয়া; (দুই) ক্যান্সার একটি কোষ সম্পর্কিত ব্যাধি; (তিন) বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ প্রাকৃতিক নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হয় ক্যান্সারকে। মিউটেশনের মাধ্যমে ক্যান্সার বৈচিত্রতা লাভ করে; ক্যান্সারের ফলে কোষ পরিবর্তিত হয় এবং দেহের অন্যান্য কোষের চেয়ে সম্পূর্ণ বিভিন্নভাবে বেড়ে ওঠে। একটি বেড়ে ওঠা টিউমারের সাথে দেহের স্বাভাবিক কোষের কার্যত কোনো মিল নেই।

cancer-1
এটা দুইলক্ষ পঞ্চাশ হাজার বছরের পুরোনো একটি পুরুষের মাথার খুলি। উনি প্রোটেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই ক্যান্সার পরবর্তীতে তার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পরে, যাকে বলে মেটাস্টেসিস। খুলিতে ফুঁটোগুলো তৈরি হয়েছে মেটাস্টেসিসের কারণে ক্যান্সার হাড়ে ছড়িয়ে পড়াতে।
cancer-2
প্যাপিরাসের লিখে রাখা প্রাচীন মিশরীয়দের ক্যান্সারের ইতিহাস। ক্যান্সারকে মিশরীয়রা মনে করতো ঐশ্বরিক শাস্তি, তাই তারা অভিশাপের ভয়ে ক্যান্সারের চিকিৎসা করতো না। মাজার বিষয় হলো, মিশরীয়রা আট রকমের স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করতে পেরেছিলো। “Do thou nothing there against” কথাটার সোজাসাপ্টা মানে হলো “এই ব্যাধি উপশম করার চেষ্টা কোরো না (কারণ, তাতে দেবতারা ক্রুদ্ধ হবে”।

ক্যান্সারের বিরুদ্ধে মানবসভ্যতার উল্লেখ করার মতো সব সাফল্য আধুনিক মলিক্যুলার বায়োলজির। একটা উদাহরণ দেয়া যাক: করিম-আব্দুল-জব্বার একটি রেকর্ডধারী মার্কিন NBA তারকা। অসুখ বিসুখ তার মতো স্বাস্থ্যবান ক্রীড়াবিদের ধরে কাছেও ঘেঁষার কথা না। আব্দুল-জব্বার ১৯৮৯ সালে খেলা থেকে অবসর নেন, এবং ২০০৮ সালে তার CML বা ক্রনিক-ম্যায়লোজেনাস-লিউকেমিয়া (Chronic myelogenous leukemia) ধরা পরে। মলিক্যুলার বায়োলজির কল্যাণে আজ আমরা জানি, CMLয়ের কারণ হলো ক্রোমোসোম-৯ এবং ক্রোমোসোম-২২য়ের শেষের কিছু অংশের অদলবদল। এই বদলাবদলির ফলে ক্রোমোসোম-২২য়ে একটি অবাঞ্ছিত BCR-ABL অংশ তৈরি হয়। BCR-ABL যুক্ত এই ক্রোমোসোম-২২কে বলে ফিলাডেলফিয়া-ক্রোমোসোম (ph)। ক্রোমোসোম হলো DNAয়ের প্যাকেজিং, আর DNAয়ের কাজ হলো প্রোটিন সংশ্লেষণ করা। BCR-ABL অংশটি সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রোটিন তৈরি করে। DNAয়ের অংশ অদলবদলের ফলে সৃষ্ট প্রোটিনদের বলে ফিউশন-প্রোটিন। BCR-ABLয়ের ফিউশন-প্রোটিনটি যুক্ত হয় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন-কাইনেস টাইরোসিন-কাইনেসের (Tyrosine kinase) সাথে। যেকোনো কাইনেস প্রোটিনের মতোই টাইরোসিন-কাইনেসও এনজাইমের কাজ করে। এই নতুন BCR-ABL-টাইরোসিন-কাইনেসের প্রভাবে রক্তের ব্ল্যাস্ট-সেলগুলো দ্রুত এবং অপরিপক্কভাবে বিভাজিত হতে শুরু করে। ব্ল্যাস্ট-সেল একধরণের শ্বেতকণিকা। বিপুল পরিমাণের অপরিপক্ক ব্ল্যাস্ট-সেলগুলো রক্তে গাদাগাদিভাবে অবস্থান করে, ফলে লোহিতকণিকারা অক্সিজেন ঠিকমতো পরিবহন করতে পারে না তাই এনিমিয়া বা রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। প্ল্যাটলেট (Platelets) কণিকার নড়াচড়া করতে পারে না, তাই কোনো কারণে রক্তক্ষরণ শুরু হলে সেটা বন্ধ করা খুব কঠিন। শ্বেতকণিকার ঠিক মতো কাজ করতে পারে না ফলে ইমিউনিটি রেসপন্স দুর্বল হয়ে পরে।

cancer-3
ক্রোমোসোম-৯ এবং ক্রোমোসোম-২২ দুটির শেষ অংশের অদলবদল। এই বদলাবদলিতে ক্রোমোসোম-৯য়ের ABL অংশটি যুক্ত হয় ক্রোমোসোম-২২য়ের BCR অংশের সাথে। এই পরিবর্তিত ক্রোমোসোম-২২কে বলে ফিলাডেলফিয়া-ক্রোমোসোম।
cancer-6
ক্রোমোসোমদের অংশবিশেষের এই বদলাবদলিকে বলে ট্রান্সলোকেশন। এই ট্রান্সলোকেশনের ফলে যে প্রোটিন সংশ্লেষণ হয় তাদের বলে ফিউশন-প্রোটিন। BCR-ABL ফিউশন-প্রোটিন গিয়ে যুক্ত হয় একটি গুরুত্বপূর্ণ এনজাইমের সাথে নাম টাইরোসিন-কাইনেস। BCR-ABL সংযুক্তির ফলে এর নতুন নাম দাঁড়ায় BCR-ABL-টাইরোসিন-কাইনেস।

সুতরাং, CMLয়ের নিরাময় হলো এমন ঔষুধ তৈরি করা যেটা এই BCR-ABL-টাইরোসিন-কাইনেসকে অবদমিত করবে। সময়মতোই ঔষধটি তৈরি করা হলো, যার নাম গ্লিভেক (Gleevec), এই ঔষুধ ব্যবহারে তিন বছরের মাথায় আব্দুল-জব্বার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন। গ্লিভেক একটি কেমোথেরাপি ঔষধ। এর উপাদান STI-571 BCR-ABL-টাইরোসিন-কাইনেসকে ATPয়ের সাথে যুক্ত হতে বাধা দেয়, ফলে এনজাইমটি ধ্বংসযজ্ঞ চালাবার মতো শক্তি পায় না।

cancer-8
BCR-ABL ফিউশন-প্রোটিন সাবস্ট্রেট হিসেবে টাইরোসিন-কাইনেসের সাথে যুক্ত হয়। এই BCR-ABL-টাইরোসিন-কাইনেসই CMLয়ের জন্য দায়ী। গ্লিভেকের STI-571 BCR-ABL-টাইরোসিন-কাইনেসের ATP সংযুক্তির স্থান বন্ধ করে দেয়, ফলে শক্তির অভাবে এনজাইমটি কার্যক্ষমতা হারায়।

ক্যান্সার আক্রান্তদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বিশ্লেষণে ব্যবহার করা হয় কেপ্ল্যান-ম্যায়ার-স্যারভাইভাল রেখাচিত্রের মাধ্যমে। এই রেখাচিত্রের Y-অক্ষে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা (“০” সর্বনিম্ন এবং “১” সর্বোচ্চ সম্ভাবনা) এবং X-অক্ষে আয়ুষ্কাল (বছরে) দেখানো হয়। গ্লিভেকের কেপ্ল্যান-ম্যায়ার-স্যারভাইভাল রেখাচিত্র অত্যন্ত আশাপ্রদ। নিঃসন্দেহে এটা একটা বিশাল সাফল্য, কিন্তু, CML শুধু একটি ক্যান্সারের উদাহরণ মাত্র।

cancer-5
গ্লিভেকের ব্যবহারের পূর্বে (১৯৭৮, ১৯৮৮, এবং ১৯৯৮ সালে) CMLয়ে আক্রান্ত হবার প্রথম তিন বছরের মাথায় মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত ছিলো। কিন্তু, গ্লিভেক প্রয়োগের পর (২০০৮ সাল) বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আশ্চর্যজনক বেড়ে যায়।

 

পরের পর্ব – কারণ এবং কার্সিনোজেনেসিস

অবলম্বনে: “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “What Science Knows about Cancer” by “David Sadava”