মরণব্যাধি ক্যান্সার: অংকোজিন এবং টিউমার-সাপ্রেশন-জিন

শুধু একটি জিনের মিউটেশনে ক্যান্সার হয় না, ক্যান্সারের কারণ একাধিক জিনের পুঞ্জীভূত মিউটেশন। আমরা আগেই দেখেছি, কার্সিনোজেনেসিস বা ক্যান্সার-তত্ত্ব অনুসারে ক্যান্সারের জন্য দায়ী জিনগুলোকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়: অংকোজিন এবং টিউমার-সাপ্রেশন-জিন। এবার এদের বিস্তারিত দেখা যাক;

অংকোজিন: অংকোজিন কোষ বিভাজনের জন্য দায়ী। এই অংকোজিনগুলোর একটি বড় উৎস ভাইরাস। ভাইরাস হলো প্রোটিনের আবরণে লুকিয়ে থাকা সামান্য কিছু জেনেটিক উপাদান। এই জেনেটিক উপাদান হতে পারে DNA বা RNA। ভাইরাসের প্রোটিনের আবরণে থাকে হুকের মতো কিছু অংশ যেগুলো ভাইরাসদের আশ্রয়দাতার মেমব্রেনে আটকাতে সাহায্য করে। ভাইরাসের এই হুকগুলো আশ্রয়দাতা কোষের বহিঃস্থ সুনির্দিষ্ট কিছু মেমব্রেন-বাউন্ড প্রোটিনের সাথে আটকাতে পারে, তাই যেকোনো ভাইরাস  চাইলেও যে কোনো কোষের সাথে আটকাতে পারে না।

ভাইরাসের জীবনধারা দুই ধরণের হতে পারে। ভাইরাস মেমব্রেন ফুটো তাদের DNA বা RNA আশ্রয়দাতা কোষের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে আশ্রয়দাতা কোষের ট্রান্সক্রিপশন-ট্রান্সলেশন যন্ত্রাংশগুলো ভাইরাসের জেনেটিক উপাদানগুলো থেকে ভাইরাস-প্রোটিনের উৎপাদন শুরু করে। এই প্রোটিনগুলো অনেকটা মাছ ধরার জালের মতো আশ্রয়দাতা কোষের DNAকে প্যাঁচিয়ে ফেলে, ফলে কোষের DNA অচল হয়ে যায়। ভাইরাস এবার কোষের রেপ্লিকেশন যন্ত্রাংশগুলো ব্যবহার করে ভাইরাসের জেনেটিক উপাদানের অগণিত প্রতিলিপি তৈরি করা শুরু করে। এই নকলকৃত জেনেটিক উপাদানগুলো এবং ভাইরাস-প্রোটিন মিলিয়ে নতুন ভাইরাস তৈরি করে, এই প্রক্রিয়ায় আশ্রয়দাতা কোষের মৃত্যু ঘটে। এইধরণের ভাইরাসকে বলে সংক্রামক ভাইরাস।

ইমিউনিটি-সিস্টেম ভাইরাস শনাক্ত করার সাথে সাথে এন্টিবডি তৈরি করতে শুরু করে এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাই টিকে থাকার জন্য কিছু কিছু ভাইরাস একটু ব্যাতিক্রমী জীবনধারা অনুসরণ করে। কিছু RNA ভাইরাস আশ্রয়দাতা কোষের রিভার্স-ট্রান্সক্রিপটেস (Reverse transcriptase) এনজাইম ব্যবহার করে তাদের RNAকে DNAতে পরিবর্তিত করে এবং আশ্রয়দাতা কোষের DNAতে ঢুকিয়ে দেয়। ফলে, ইমিউনিটি-সিস্টেম এদের খুঁজে পায় না। এইধরণের ভাইরাসদের বলে রেট্রোভাইরাস। এইডসের HIV একটি রেট্রোভাইরাস। কিছু কিছু DNA ভাইরাসও আশ্রয়দাতা কোষের রেপ্লিকেশন এনজাইমগুলো ব্যবহার করে নিজের DNA আশ্রয়দাতার DNAতে সন্নিবেশিত করতে পারে। সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের HPV এমনই একটা ভাইরাস। HPV ভাইরাসের DNA মাত্র একটি বৃত্তাকার স্ট্রান্ড দিয়ে গঠিত। এর জিনগুলো মূলত তিন ধরণের প্রোটিন তৈরি করে: আবরণ প্রোটিন, আশ্রয়দাতার কোষ নিয়ন্ত্রণে নেবার প্রোটিন, এবং কোষ বিভাজন প্রোটিন (বা অংকোজিন)। এই অংকোজিনগুলো আশ্রয়দাতা কোষকে বিভাজত হতে সাহায্য করে, ফলে ইমিউনিটি-সিস্টেমকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ভাইরাসগুলো দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে। আশ্রয়দাতার ক্রোমোসোমে ঢোকানোর জন্য আবরণ-প্রোটিনের জিনটি বরাবর DNAকে ছিঁড়ে ফেলা হয়, ফলে ক্রোমোসোম সন্নিবেশন প্রক্রিয়ায় অংকোজিনের কোনো ক্ষতি হয় না।

cancer-1
HPV হিউমান প্যাপিলোমা ভাইরাসের (Human Papilloma Virus) বৃত্তাকার DNA। মানব DNAতে সন্নিবেশের সময় E4 অংশ বরাবর ছিঁড়ে ফেলা হয়, ফলে ভাইরাস অংকোজিন অক্ষত থাকে। HPV নারীদের সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের জন্য দায়ী।
Integration_of_viral_DNA_into_host_genome
রেট্রোভাইরাস যেভাবে মানব জিনোমে মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। ধাপগুলো সহজভাবে দেখানো হয়েছে, তাই ব্যাখ্যা করা হলো না। Image Credit: By Adrian Maglaqui – Own work, CC BY-SA 4.0, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=48727769

উপযুক্ত পরিবেশে আশ্রয়দাতা কোষ ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়ায় এই লুকিয়ে থাকা ভাইরাসগুলো প্রতিলিপি তৈরি করে এবং জন্ম হয় নতুন ভাইরাসের। মানব জিনোমের প্রায় ৫-৮%ই বিভিন্ন ভাইরাস DNA। আশ্রয়দাতার ক্রোমোসোমে লুকিয়ে থাকা যে ভাইরাসগুলো কোষ বিভাজনে ঘটায় তাদের বলে টিউমার ভাইরাস। ভাইরাস ঘটিত ক্যান্সারের সর্বপ্রথম ধারণা দেন মার্কিন গবেষক পেটোন রাউস (Peyton Rous) ১৯১০ সালে। মানব ক্যান্সারের ১০% ঘটে ভাইরাসের কারণে। নিচে কিছু ক্যান্সার ভাইরাসের নাম দেয়া হলো।

cancer-2
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ক্যান্সার ভাইরাস, সংশ্লিষ্ট ক্যান্সার, এবং বিশ্বব্যাপী এদের সংক্রামণের পরিসংখ্যান।

আশ্রয়দাতার কোষ যখন ট্রান্সক্রিপশনের মাধ্যমে নতুন ভাইরাস RNA তৈরি করে তাতে ভাইরাসের আদি DNAয়ের সাথে আশ্রয়দাতার এক বা একাধিক জিনও যুক্ত হয়। আশ্রয়দাতার এই জিনগুলোকে বলে প্রোটো-অংকোজিন। ভাইরাসের মিউটেশন সংশোধনের কোনো সামর্থ্য নেই, তাই ভাইরাস বাহিত এই প্রোটো-অংকোজিনগুলোর মিউটেশন ঘটে লাগামহীন। মিউটেশনের কারণেই ভাইরাসে প্রোটো-অংকোজিনগুলো পূর্ণাঙ্গ অংকোজিনে পরিণত হয়। এই ভাইরাসগুলোই যখন কোনো নতুন আশ্রয়দাতা খুঁজে পায়, তখন নতুন আশ্রয়দাতার ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা থাকে। রাউস যে ভাইরাস নিয়ে কাজ করছিলেন তার নাম RSV (Rous sarcoma virus), এই ভাইরাসটি মুরগির ক্যান্সারের জন্য দায়ী। পরবর্তীতে
মাইকেল বিশপ এবং হ্যারল্ড ভারম্যাস (Michael Bishop, Harold Varmus) এই ভাইরাসের দুটি শ্রেণী পান, একটি আশ্রয়দাতা কোষে ক্যান্সার সৃষ্টি করে, অন্যটি করে না। ক্যান্সারের জন্য দায়ী RSV ভাইরাসে একটি বিশেষ অংকোজিন থাকে নাম SRC, এই SRC আশ্রয়দাতা কোষে প্রোটিন-কাইনেস তৈরি করে যেটা কোষে বিভাজনের জন্য দায়ী। প্রোটো-অংকোজিন থেকে অংকোজিনের এই ভাইরাস বাহিত চক্র আবিষ্কারের জন্য বিশপ এবং ভারম্যাস দুজনেই নোবেল পদক পান।

cancer-3
প্রোটো-অংকোজিনের পূর্ণাঙ্গ অংকোজিনে রূপান্তরের একটা কারণ ভাইরাস। ভাইরাস DNA তৈরির সময় কিছু প্রোটো-অংকোজিন ভাইরাসের জিনোমে সন্নিবেশিত হয়। ভাইরাসে প্রোটো-অংকোজিনের লাগামহীন মিউটেশন ঘটে এবং জিনগুলো অংকোজিনে পরিণত হয়। এই ভাইরাসের সংক্রমণে নতুন আশ্রয়দাতা কোষের ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকে।

দেহের স্বাভাবিক কোষের কিছু না কিছু প্রোটো-অংকোজিনে থেকে। ভাইরাস ছাড়াই প্রোটো-অংকোজিন তিনভাবে পূর্ণাঙ্গ অংকোজিনে রূপান্তরিত হতে পারে। বস্তুত প্রায় ৯০% ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ভাইরাস ছাড়াই প্রোটো-অংকোজিন পুরোপুরি অংকোজিনে পরিণত হয়। এর কারণগুলো: কার্সিনোজেন এবং বিকিরণজনিত মিউটেশন, ট্রান্সলোকেশন বা ক্রোমোসোমের অংশবিশেষ অদলবদল, কিংবা জিন এম্প্লিফিকেশন। কার্সিনোজেন এবং বিকিরণজনিত মিউটেশন আগেই আলোচনা করা হয়েছে। CMLলের ক্ষেত্রে আমরা ট্রান্সলোকেশন দেখেছি। ক্রোমোসোমের সব অংশই সমান সক্রিয় নয়, কোনো অংশে দ্রুত আবার কোনো অংশে মন্থর গতিতে ট্রান্সক্রিপশন চলে। ট্রান্সলোকেশনের কারণে কোনো চুপচাপ প্রোটো-অংকোজিন যদি ক্রোমোসোমের সক্রিয় অংশে গিয়ে পড়ে তবে প্রোটো-অংকোজিনটি আর চুপচাপ থাকবে না, সে পরিণত হবে দামাল অংকোজিনে।

এম্প্লিফিকেশন একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া। মানব DNA একটি বিশাল অণু, তাই রেপ্লিকেশনের সময় একটি ক্রোমোসোমের অনেকগুলো অংশে যুগপৎ রেপ্লিকেশন চলতে থাকে। এই অংশগুলোতে তৈরি হয় রেপ্লিকেশন-ফর্ক, একেক রেপ্লিকেশন-ফর্কে একেকগুচ্ছ এনজাইম স্বাধীনভাবে রেপ্লিকেশন চালাতে থাকে। ফলে, দুটি রেপ্লিকেশন-ফর্কের সংযোগস্থলে থাকা জিনগুলোর একাধিক প্রতিলিপি তৈরি হবার সম্ভাবনা থাকে। আর জিনটি যদি স্বল্প প্রকাশিত কোনো প্রোটো-অংকোজিন হয় তবে জিনটির বহু প্রতিলিপি একসাথে প্রকাশ পেতে থাকলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। একেই বলে জিনের এম্প্লিফিকেশন; এম্প্লিফিকেশন বহু স্বল্প প্রকাশিত প্রোটো-অংকোজিন একটি আস্ত অনিয়ন্ত্রিত অংকোজিনের মতোই বিপদজনক হয়ে ওঠে। স্তন-ক্যান্সারের ক্ষেত্রে আমরা HER2 গ্রোথ-রিসেপ্টরের কথা বলেছিলাম। প্রায় ৩০% স্তন-ক্যান্সারের কারণ এই HER2 গ্রোথ-রিসেপ্টরের এম্প্লিফিকেশন।

অংকোজিনগুলো মূলত রেগুলেটরি বা নিয়ন্ত্রক জিন। এরা এমন প্রোটিন তৈরি করে যা: অন্যান্য জিনের প্রকাশ, গ্রোথ-সিগন্যালিং, এবং কোষের মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করে।

অংকোজিনেরা অনেকটা গাড়ি এক্সসেলারেটরের মতো, লাগামহীন অংকোজিন প্রকাশ হওয়া মানে ফুলস্পীডে কোষ বিভাজন চলতে থাকা। অংকোজিন নিষ্ক্রিয়কারক (Repressor) কিংবা সক্রিয়কারক (Activator) ধরণের নিয়ন্ত্রক প্রোটিন তৈরি করে। নিয়ন্ত্রক প্রোটিনগুলো জিনের প্রোমোটর অংশে যুক্ত হয় এবং জিনের প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। সক্রিয়কারক প্রোটিনগুলো প্রোটিন-কাইনেস তৈরি এবং গ্রোথ-হরমোন-রিসেপ্টরের প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্য দায়ী। অন্যদিকে, নিষ্ক্রিয়কারক প্রোটিনগুলো কোষ সংযোজক এবং বিশেষায়ন প্রোটিন অবদমনের জন্য দায়ী।

আগে বলা হয়েছিলো কিছু অংকোজিনেরা প্রোটিন-কাইনেস তৈরি করে। এই প্রোটিন-কাইনেসগুলো ফসফোরিলেশনের মাধ্যমে টিউমার-সাপ্রেশন-জিনদের অবদমিত করে। টিউমার-সাপ্রেশন-জিন অনেকটা গাড়ির ব্রেকের মতো, টিউমার-সাপ্রেশন-জিনদের অবদমন মানে বাধাহীনভাবে বিভাজন চলতে থাকা। কয়েকটা উদাহরণ দেয়া হলো:

MYC একটি ট্রান্সক্রিশন-ফেক্টর বা এমন জিন যেটা প্রমোটরের সাথে যুক্ত হয়ে জিনের প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। এভিয়ান-মাইলয়েড-লিউকেমিয়া (Avian Myeloid Leukemia) নামের এক ভাইরাস এই MYC অংকোজিন বহন করে। মানবদেহও এই MYC প্রোটো-অংকোজিন রয়েছে। MYCয়ের অনিয়ন্ত্রিত প্রকাশ ৮০% স্তন-ক্যান্সার, ৭০% কোলোরেক্টাল-ক্যান্সার, ৯০% গ্যাইনিকোলোজিক্যাল-ক্যান্সার, ৫০% যকৃতের ক্যান্সার, এবং ৮০% লিম্ফোমাসের জন্য দায়ী।

cancer-1
গ্রোথ-হরমোন সিগন্যালিং যেভাবে কাজ করে: বাঁয়ে: স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে গ্রোথ-হরমোনের উপস্থিতিতে সিগন্যাল-ট্রান্সডাকশন-পাথওয়ে সক্ৰিয় হয়। ডানে: মিউটেশনের কারণে গ্রোথ-হরমোনের উপস্থিতি ছাড়াই সিগন্যালিং-ট্রান্সডাকশন-পাথওয়ে সক্ৰিয় হয়ে পড়ে।
cancer-9
গ্রোথ-হরমোন সিগন্যালিংয়ে RAS ট্রান্সডাকশন-পাথওয়ের প্রথম প্রোটিন। মিউটেশনের কারণে RAS গ্রোথ-হরমোন ছাড়াই সেকেন্ড-মেসেঞ্জার অণু তৈরি করতে থাকে।

অংকোজিন গ্রোথ-সিগন্যালিং নিয়ন্ত্রণ করে সিগন্যাল-ট্রান্সডাক্টশন-পথওয়ে পরিবর্তনের মাধ্যমে। যেকোনো প্রোটিন সিগন্যালিংয়ের মতোই গ্রোথ-হরমোন কোষের বহিঃস্থ গ্রোথ-হরমোন-রিসেপ্টরে যুক্ত হয়, যেটা কোষের অন্ত:স্থ কিছু মেমেব্রেন-বাউন্ড প্রোটিনকে সেকেন্ড-ম্যাসেঞ্জার তৈরিতে প্ররোচিত করে, এবং এই সেকেন্ড-ম্যাসেঞ্জারই ধারাবাহিকভাবে কোষকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দেয়। RAS এমনই একটা অন্ত:স্থ মেমেব্রেন-বাউন্ড প্রোটিন, যেটা গ্রোথ-হরমোনের বিপরীতে সেকেন্ড-ম্যাসেঞ্জার তৈরি করে। কিন্তু মিউটেশনের কারণে RAS যখন অংকোজিনে পরিণত হয়, তখন কোনো গ্রোথ-হরমোন ছাড়াই RAS সেকেন্ড-ম্যাসেঞ্জার তৈরি করতে থাকে এবং কোষকে ক্যান্সারের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। বস্তুত প্রায় ৫০% ক্যান্সারের ক্ষেত্রে RAS অংকোজিনকে সক্রিয় দেখা যায়।

cancer 10
কেপ্ল্যান-ম্যায়ার কার্ভ: বিভিন্ন অংকোজিনের যুগপৎ সক্রিয়তার ফসল। MYC এবং RAS যৌথ প্রকাশ দুরারোগ্য ক্যান্সারের কারণ।

আমরা দেখেছিলাম শ্বেতকণিকায় BCL2 জিনের প্রকাশ এপোপটোসিস অবদমিত করে। বি-সেল লিম্ফোমার জন্যও দায়ী  ভাইরাসের BCL2 অংকোজিন। অন্যদিকে, কোষের BCL2 প্রোটো-অংকোজিন লার্জ-সেল ফলিক্যুলার লিম্ফোমার ঝুঁকি বাড়ায়। রক্ত বাদে অন্যান্য কোষের এপোপটোসিস দীর্ঘ সময় অবদমিত থাকলে DNAতে বিপদজনক মিউটেশন জমা হতে থাকে। অনেক ক্যান্সার যেমন: বিভিন্ন ধরণের মেলানোমা, স্তন-ক্যান্সার, প্রোস্টেট-ক্যান্সার, যকৃতের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটতে দেখা গেছে।

আমরা এতোক্ষণ যে নিয়ন্ত্রক অংকোজিনের কথা বললাম সেগুলো ট্রান্সক্রিপশনাল-রেগুলেটর জিন, এরা ট্রান্সক্রিপশন বা জিনকে থেকে mRNA উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের DNAতে ছোট ছোট কিছু সিকোয়েন্স আছে যেগুলো ট্রান্সলেশনাল-রেগুলেটরি ধরণের, এরা ট্রান্সলেশন বা mRNA থেকে প্রোটিন উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে। DNAয়ের এই ট্রান্সলেশনাল-রেগুলেটরি অংশগুলো ট্রান্সক্রিপশন শেষে microRNAতে পরিণত হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই নির্দিষ্ট microRNA নির্দিষ্ট কিছু mRNAয়ের সাথে যুক্ত হয়, এতে mRNAগুলো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। টিউমার কোষ microRNAনের প্রকাশ কমিয়ে দেয়। microRNA ব্যবহার করে কিভাবে অংকোজিনজনিত mRNA ধ্বংস করা করা যায় তা নিয়ে সক্রিয় গবেষণা চলছে।

cancer-1
ডানে: microRNA প্রথমে পথপ্রদর্শক প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়। এই প্রোটিন সংযুক্তির ফলে microRNA সুনির্দিষ্ট mRNAয়ের সাথে আটকে যায় এবং ধ্বংস করে দেয়। বাঁয়ে: Y-অক্ষে বিভিন্ন আকারের (বেস-পেয়ার সংখ্যা) microRNA এবং X-অক্ষে বিভিন্ন ধরণের কোষে তাদের উৎপাদনের পরিমাণ। টিউমার কোষে microRNAয়ের উৎপাদন উল্লেখ করার মতো কমে যায়।

টিউমার-সাপ্রেশন-জিন: ক্যান্সারের জন্য দায়ী কিছু মিউটেশন প্রজননের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে যেতে পারে। ফলে, এই প্রজন্মগুলোর ক্ষেত্রে ক্যান্সার হবার মতো যথেষ্ট মিউটেশন পুঞ্জীভূত হতে অনেক কম সময় লাগে। বংশগত মিউটেশনের কারণে অনেক শিশু, কিশোর, তরুণের ক্যান্সার হতে পারে। বস্তুত প্রায় ১০% ক্যান্সারের কারণ বংশগত মিউটেশন। ক্যান্সারের বংশগত মিউটেশনগুলো অংকোজিন সম্পর্কিত নয়। বরং মিউটেশনগুলো কিছু অতি প্রয়োজনীয় জিনের উধাও বা নিষ্ক্রিয় সম্পর্কিত। এই জিনগুলোকে বলে টিউমার-সাপ্রেশন-জিন। ক্যালটেকের ক্যান্সার গবেষক আলফ্রেড নোডসন (Alfred Knudson) সর্বপ্রথম শিশুদের রেটিনোব্ল্যাস্টোমা ক্যান্সারের ওপর গবেষণা চালিয়ে টিউমার-সাপ্রেশন-জিনের সাথে বংশগত ক্যান্সারের সম্পর্ক বের করেন। পাকস্থলীর ক্যান্সারের ১০% বংশগত মাধ্যমে পাওয়া বাকি ৯০% বিক্ষিপ্ত পরিবেশগত (Sporadic, Environmental), কোলন-ক্যান্সারের ৫% বংশগত বাকি ৯৫% বিক্ষিপ্ত।

বংশগত ক্যান্সারের ঝুঁকির একটা ভালো উদাহরণ হলো তামাকের বেঞ্জপাইরিনজনিত ক্যান্সার। বেঞ্জপাইরিনকে রক্তে দ্রবণীয় করার কাজ যকৃতের। কিছু জিনের উপস্থিতিতে (ছবিতে দেখানো কাল্পনিক A) যকৃতে বেঞ্জপাইরিনের মেটাবোলিক এক্টিভেশন হয় দ্রুত, কিছু জিনের ক্ষেত্রে (C) ধীর, আর কিছু জিনের ক্ষেত্রে A এবং Cয়ের মাঝামাঝি (B)। যাদের DNAতে মা-বাবার কাছ থেকে পাওয়া দুটি জিনই A, বা অ্যালীল A/A তাদের ধূমপানে ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেশি, যাদের অ্যালীল C/C তাদের ঝুঁকি কম। ঠিক এইজন্যই আমরা অনেক ধূমপায়ীদের ক্যান্সার হতে দেখিনা।

cancer 10
যেসব ধূমপায়ীর C/C অ্যালীল রয়েছে তাদের তামাকজনিত ক্যান্সারে ঝুঁকি কম, অন্যদিকে A/A অ্যালীলের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এইজন্যই সব ধূমপায়ীর ক্যান্সার হতে দেখা যায় না। ক্রোমোসোমে একই জিনের দুটি প্রতিলিপি থাকে, এদের একসাথে অ্যালীল বলে, অ্যালীলের একটা প্রতিলিপি আসে মা থেকে অন্যটি বাবা থেকে।

নিউরোফাইব্রোম্যাটোসিস (Neurofibromatosis) আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় এমন একটি ক্যান্সার। এই ক্যান্সারে নার্ভ কোষের আশপাশের আঁশালো টিস্যুতে নিউরোফাইব্রোমা টিউমারের বিকাশ ঘটে। ৫০% নিউরোফাইব্রোম্যাটোসিস বংশগত। শুক্রাণু-ডিম্বাণুর স্বতঃস্ফূর্ত মিউটেশন এর মূল কারণ।

Neurofibromatosis
নিউরোফাইব্রোম্যাটোসিস। ছবি: By Almazi (talk) – Author, Public Domain, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=18572940

আমরা ক্রোমোসোমের ট্রান্সলোকেশনের কথা বলেছিলাম, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্রোমোসোমের কিছু অংশ একেবারে উধাও হয়ে যেতে পারে, একে বলে ডিলিশন (Deletion)। এই উধাও হয়ে যাওয়া অংশের সাথে সাথে টিউমার-সাপ্রেশন-জিন হারিয়ে গেলে ক্যান্সারের ঝুঁকিতে বেড়ে যায়। তীব্র তেজস্ক্রিয় বিকিরণে DNAয়ের দুটি স্ট্র্যান্ড একসাথে ভেঙ্গে গেলে ডিলিশন হতে পারে, তবে সাধারণ ক্ষেত্রে এই ডিলিশনের কারণ পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। টিউমার-সাপ্রেশন-জিনের নিষ্ক্রিয়তার অন্যান্য কারণ যেমন: কার্সিনোজেন, বিকিরণ, এবং এপিজেনেটিক পরিবর্তন আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

cancer-2
ক্রোমোসোম ডিলিশনের একটা উদাহরণ: লম্বালম্বি রেখাগুলো বিভিন্ন ক্রোমোসোম ডিলিশন বোঝানো হয়েছে। RB অংশটি যদি কোনো ডিলিশনে ভেতর পরে যায়, তবে RB জিনের অভাবে রেটিনোব্ল্যাস্টোমা হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

কোষে টিউমার-সাপ্রেশন-জিনের কাজ মূলত: DNA মেরামত, DNAয়ের সুরক্ষা, এবং কোষের বিভাজন নিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদি।নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিউমার-সাপ্রেশন-জিন, তাদের কাজ, এবং সংশ্লিষ্ট ক্যান্সার উল্লেখ করা হলো:

cancer-1
কিছু টিউমার-সাপ্রেশন-জিন, তাদের কাজ, এবং সংশ্লিষ্ট ক্যান্সার।

BRCA1 এবং পরবর্তীতে আবিষ্কৃত BRCA2য়ের কাজ DNA মেরামত করা। ডিলিশন বা মিউটেশন সরাসরি এই দুটি জিনকে অবদমিত করে।

cancer-3
BRCA1 প্রোটিন ভেঙ্গে বা আলগা হয়ে যাওয়া DNA মেরামতে সাহায্য করে। BRCA1 ভেঙ্গে যাওয়া স্ট্র্যান্ডকে ধরে থাকে, এরপর অন্যান্য সংশোধনী এনজাইম এসে ভাঙ্গা স্ট্র্যান্ডকে জোড়া লাগিয়ে দেয়।

আমরা রেটিনোব্ল্যাস্টোমার RB টিউমার-সাপ্রেশন-জিনের কথা বলেছিলাম। কার্যকর RB প্রোটিন কোষ বিভাজনের জন্য দায়ী একটি ট্রান্সক্রিপশন-ফেক্টর E2Fয়ের সাথে যুক্ত হয় এবং শক্তিশালী নিষ্ক্রিয়কারক প্রোটিন হিসেবে কাজ করে। অংকোজিনের তৈরি প্রোটিন-কাইনেস ফসফোরেলেশনের মাধ্যমে RBয়ের আকার পাল্টে দেয়। ফলে, RB অকেজো হয়ে পরে এবং E2Fয়ের সাথে যুক্ত হতে পারে না।

cancer-4
ডানে: স্বাভাবিক RB প্রোটিন প্রোমোটরে লেগে থাকা E2F ট্রান্সক্রিপশন-ফেক্টরের সাথে যুক্ত হয়। বাঁয়ে: প্রোটিন-কাইনেস RBকে ফসফোরেলেট করে, এতে RBয়ের আকার পাল্টে যায়। পাল্টে যাওয়া RB E2Fয়ের সাথে যুক্ত হতে পারে না, ফলে কোষ R-বিন্দু অতিক্রম করে।

P53য়ের কাজ হলো যেকোনো DNA সংক্রান্ত পরিস্থিতি মোকাবেলা করা। P53 প্রথমে DNAয়ের ক্ষতি মেরামত করার চেষ্টা করে, সম্ভব না হলো P21 জিন প্রকাশের মাধ্যমে কোষের বিভাজন থামিয়ে দেয়। আর যদি DNAয়ের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে থাকে তবে এপোপটোসিস ঘটায়। P53কে বলা হয় জিনোমের অভিভাবক (Guardian of genome)। শরীরের কোনো অংশ পুড়ে গেলে কিছুদিন পর ঐ অংশের চামড়া শুকিয়ে খসে পড়তে দেখা যায়, এর কারণ P53য়ের এপোপটোসিস।

cancer-6
P53কে বলে জিনোমের অভিভাবক। P53 তিন উপায়ে DNA রক্ষার চেষ্টা চালায়। DNA মেরামত, কোষ বিভাজন স্থগিতকরণ, এবং এপোপটোসিস।

এবার আধুনিক কার্সিনোজেনেসিসের মাধ্যমে দুটি ক্যান্সার দেখা যাক: প্রথমে কোলন ক্যান্সার। কোলন-ক্যান্সারের রোগনির্ণয়ের লক্ষণগুলো: পলিপ (গুটি ), কার্সিনোমা (টিউমার), এবং মেটাস্টেসিস। এই তিনটি লক্ষণ দেখা যায় ধাপে ধাপে বিভিন্ন অংকোজিন এবং টিউমার-সাপ্রেশন-জিনের মিউটেশনের কারণে। কোলন-ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রথমে APC টিউমার-সাপ্রেশন-জিনের অবদমিত হয়। APC জিনটি RB জিনের মতোই নিষ্ক্রিয়কারক। এই অবদমন ঘটে প্রোটিন-কাইনেসের মাধ্যমে। এরপর, MLH টিউমার-সাপ্রেশন-জিনের মিউটেশন ঘটে, MLHয়ের কাজ অমিল বেস-পেয়ারযুক্ত DNA মেরামত করা। এরপর মিউটেশন ঘটে RASয়ের, আমরা জানি RAS একটি অংকোজিন। RAS মিউটেশনে পর্যায়ে পলিপ ধরা পরে। এরপর DCC, DCC একটি সংযোজক-নিয়ন্ত্রক ধরণের টিউমার-সাপ্রেশন-জিন, এর মিউটেশনে ক্যান্সার কোষ কোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। DCC মিউটেশনের ক্যান্সার টিউমার পর্যায় পৌঁছে। এরপর P53য়ের মিউটেশন ঘটে। সবশেষে মিউটেশন ঘটে মেটাস্টেসিস ধরণের টিউমার-সাপ্রেশন-জিনের। এটা কোলন-ক্যান্সারের সবচেয়ে শেষ এবং বিপদজনক ধাপ।

cancer-7
কার্সিনোজেনেসিস: বাঁয়ে; কোলন-ক্যান্সারের বিভিন্ন পর্যায়। ডানে: প্রতি পর্যায়ের জন্য দায়ী জিন।
cancer-1
APC টিউমার-সাপ্রেশন-জিন: ডানে; APC বেটা-ক্যাটেনিন (beta-catenin) নামক ট্রান্সক্রিপশন-ফেক্টরের সাথে যুক্ত হয় এবং বেটা-ক্যাটেনিন ধ্বংস করে। বাঁয়ে; প্রোটিন-কাইনেস APCকে ফসফোরেলেট করে আকার পাল্টে দেয়, ফলে বেটা-ক্যাটেনিন কোষ বিভাজনের জন্য দায়ী জিনের সাথে যুক্ত হয় এবং ট্রান্সক্রিপশন শুরু করে।

ফসফুসের ক্যান্সার: ধূমপানে ফুসফুসের অ্যাভিয়োলি (Alveoli) নামক বায়ুকুঠুরিগুলোতে প্রথমে P16 টিউমার-সাপ্রেশন-জিনের মিউটেশন ঘটে। স্বাভাবিক P16 কোষ বিভাজন থামিয়ে রাখে। এই P16 জিনের মিউটেশনের কারণ এপিজেনেটিক। সময়ের সাথে সাথে P16য়ের প্রোমোটরে প্রচুর মিথাইলেশন ঘটে। এই মিথাইল-গ্রুপগুলো অন্যান্য নিষ্ক্রিয়কারক প্রোটিনকে প্রোমোটরে আটকাতে সাহায্য করে। ফলে P16 অকেজো হয়ে যায়। এই পর্যায় অ্যাভিয়োলির কোষগুলো বিভাজিত হতে শুরু করে (ছবিতে: Precancerous cell division)। P16য়ের পর মিউটেশন ঘটে RAS অংকোজিনের, এতে ক্যান্সার টিউমার বা কার্সিনোমা ধাপে উন্নীত হয় (ছবিতে: Lung carcinoma)। সবশেষে মিউটেশন ঘটে P53 জিনের, এটা ফসফুসের ক্যান্সারের সবচেয়ে বিপদজনক পর্যায় (ছবিতে: Invasive lung cancer)।

cancer-8
কার্সিনোজেনেসিস: ফুসফুসের ক্যান্সারের তিনটি ধাপ: কোষ বিভাজন, টিউমার, এবং সংক্রমণ।
cancer-5
মিথাইলেশনের মাধ্যমে P16 জিনের অবদমন।

এই আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, একেক ক্যান্সারের বিকাশ একেক রকমের। ভিন্ন ভিন্ন ক্যান্সারে ভিন্ন ভিন্ন জিনের ভিন্ন ভিন্ন মিউটেশন ঘটে। তাই ক্যান্সারকে ভালো করে বোঝার জন্য একটি বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে, নাম: ক্যান্সার-জিনোম-প্রজেক্ট। এই উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য হলো, মানব জিনোমের কি কি মিউটেশন ক্যান্সারে কারণ সেগুলো খুঁজে বের করা। আশা করা যায় এই প্রজেক্টের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে প্রতিটি ক্যান্সারের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে। এই প্রজেক্টের অধীনে EU কাজ করছে কিডনি, চীন পাকস্থলী, কানাডা প্রোস্টেট, অস্ট্রেলিয়া ওভ্যারিয়ান ক্যান্সারের ওপর। ক্যান্সার-জিনোম-প্রজেক্ট সম্পর্কে বিস্তারিত এখানে

আগের পর্ব: টিউমার
পরের পর্ব: চিকিৎসা

অবলম্বনে: “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “What Science Knows about Cancer” by “David Sadava”