পুরুষ কেন ধর্ষণ করে? ধর্ষণ কেন নারীদের জন্য অচিন্তনীয়?

১৯৯৭-তে সাইকোলজির ওপর ল্যান্ডমার্ক একটা বই লিখেন স্টিভেন পিঙ্কার, নাম “How the Mind Works”। বইয়ের এক জায়গায় নারী ও পুরুষের যৌন চিন্তার পার্থক্য কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, এই পার্থক্য যে এতো বিশাল সেটা আমার জানা ছিলো না। ঐ বই থেকে বলার মতো একটা উদাহরণ হলো পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পর্নোগ্রাফির দর্শক সংখ্যা খেলাধুলা ও ছায়াছবির সম্মিলিত দর্শক সংখ্যার চেয়েও বেশি। এবং এই পর্ন দর্শকেরা মূলত পুরুষ। বার্ষিক দশ বিলিয়ন ডলারের এই ইন্ডাস্ট্রির আয়ও আসে পুরুষদের পকেট থেকে। অন্যদিকে, নারীদের জন্য পর্নোগ্রাফির কাছাকাছি বিনোদন হলো রোমান্টিক উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি যেগুলোতে যৌনতা উপস্থাপন করা হয় “আবেগঘন” পারিপার্শ্বিকতায়। তবে, পিঙ্কার এই “আবেগের” ধরণ ও উৎস সম্পর্কে কিছুই বলেননি। সেই সাথে, নারী পুরুষের যৌন মনস্কামনার “পার্থক্যের” বায়োলজিক্যাল কারণও উল্লেখ করেননি। 

স্টিভেন পিঙ্কারের বই।

২০১৯-তে সমাজবিদ্যার ওপর উল্লেখ করার মতো একটি বই লিখেন নিকোলাস ক্রিস্ট্যাকিস, নাম “Blueprint: The Evolutionary Origins of a Good Society”। বইটিতে ক্রিস্ট্যাকিসকের “বায়োলজিক্যাল” বর্ণনা পিঙ্কারের “মনস্তাত্বিক” দৃষ্টিভঙ্গির সন্তোষজনক ব্যাখ্যা মেলে। ক্রিস্ট্যাকিসক যেটা বলছেন তার সংক্ষিপ্ত হলো:

মানুষের রোমান্টিক ভালোবাসার পেছনে কাজ করে অক্সিটোসিন। প্রতিটি স্তন্যপায়ী প্রজাতির ক্ষেত্রেই এই হরমোনটি মাতৃ-সন্তান বন্ধনের জন্য দায়ী। কিন্তু, মানুষসহ মাত্র ৩% প্রজাতিতে অক্সিটোসিন বিবর্তিত হয়েছে যুগল বন্ধন (pair bonding) তৈরিতে। 

এই বিবর্তনীয় ইতিহাসগুলো স্বাধীন; মানে, বিভিন্ন প্রাইমেটদের অক্সিটোসিন যেমনি বিবর্তিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পথে, তেমনি মানব নরনারীর অক্সিটোসিন পাথওয়েরও বিবর্তনীয় ইতিহাস আলাদা। 

সন্তান প্রসবে অক্সিটোসিন নিঃসরিত হয়, যা জরায়ু দেয়ালের মসৃন মাংসপেশী সঙ্কোচনের মাধ্যমে জন্মদান ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে, শিশুর প্রথম দুগ্ধপানে স্তন উদীপ্ত হয়, এতে আবারো অক্সিটোসিন পাথওয়ে সক্রিয় হয়, যেটা জরায়ুর রক্তনালী আটকে দেয়া। ফলে, প্ল্যাসেন্টা নির্গমন পরবর্তী রক্তক্ষরণ জনিত মৃত্যু থেকে মা ও শিশু রক্ষা পায়। 

মানুষের সাথে অন্যান্য প্রাইমেটদের প্রজনন সম্পর্কিত কিছু বিশেষ পার্থক্য আছে; যেমনঃ মানব পুরুষাঙ্গ প্রাইমেটদের তুলনায় অস্বাভাবিক রকম বড় হওয়া, শিশু প্রতিপালন সময়কাল ছাড়াও স্তন বিকশিত থাকা, এবং মুখোমুখি নারী-পুরুষ সহবাসে লিপ্ত হয় (যেটা প্রাইমেটদের মধ্যে একমাত্র মানুষই করে)। নারীদের ক্ষেত্রে মুখোমুখি সহবাসে জন্মদান ও দুগ্ধপান ঘটিত অক্সিটোসিন পাথওয়ে একই সাথে সক্রিয় হয়। এজন্যই ধারণা করা হয়, নারীদের জন্য রোমান্টিক ভালোবাসা ও সন্তান প্রতি ভালোবাসা দুটোরই অক্সিটোসিন পাথওয়ে একই। 

প্রজনন তন্ত্রের ভিন্নতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই নারীদের অক্সিটোসিন পাথওয়ে পুরুষের জন্য প্রযোজ্য নয়। পুরুষের অক্সিটোসিনের বিবর্তন প্রসঙ্গে জর্জিয়া উনিভার্সিটির ল্যারি ইয়ংয়ের মত হলো, পুরুষদের রোমান্টিক ভালোবাসা “এলাকার” (territory) সাথে সম্পর্কিত।

অন্যান্য প্রাইমেটদের মতো মানুষও একটি “এলাকাচারী” (territorial) প্রজাতি। এরা পরিবেশগত সুবিধাজনক এলাকা দখল করে, জীবনবাজি রেখে পাহারা দেয়; এবং এই দায়িত্বের পুরোটাই বর্তায় পুরুষের ওপর। ফলে, মিলিয়ন বছরের প্রাকৃতিক-নির্বাচনে পুরুষের মস্তিষ্কে অক্সিটোসিনের পাথওয়ে তৈরি হয়েছে এলাকা দখল ও পাহারার “পুরস্কার” হিসেবে। ইয়ং বলেন, পুরুষের মস্তিষ্কে “নারী” এবং “এলাকা” একই অক্সিটোসিনের পাথওয়ে সক্রিয় করে।

যেই প্রক্রিয়ায় পুরুষ অক্সিটোসিনের এই বিবর্তন ঘটেছে তাকে বলে “এক্সপ্টেশন”(exaptation)। এক্সপ্টেশন একটি নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক-নির্বাচিত অভিযোজনকে (adaptation) সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চালিত করে…এক্ষেত্রে, পুরুষ মস্তিষ্কের “এলাকা” সম্পর্কিত নিউরাল সার্কিটকে “নারীদের” জন্য বরাদ্দ করা। 

এই ভিন্ন ধর্মী বিবর্তনের ফসল হলো, যেখানে নারী মস্তিষ্কের একই অংশ “সন্তান ও “প্রেমিক” উভয়কেই উপস্থাপন করে, পুরুষ মস্তিষ্কে সেটা “এলাকা” ও “নারী”। 

ক্রিস্ট্যাকিস তার বইতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাদের গণধর্ষণের জন্য পুরুষের যৌন ও এলাকাচারী আচরণের বিবর্তনীয় যোগসূত্রকে দায়ী করেন।

নিকোলাস ক্রিস্ট্যাকিসের বই।

চুয়াল্লিশ থেকে আটচল্লিশ পর্যন্ত অনীশ্বরবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায় দুই মিলিয়ন জার্মান নারীর সম্ভ্রমহানির ঘটায়, যেটা গোটা মানব ইতিহাসে সবার্ধিক ধর্ষণের রেকর্ড। সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পডগোর্নি একাত্তরের দোসরা এপ্রিল বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন বন্ধে পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানান। সোভিয়েতদের কাছ থেকে মানবাধিকারের আহ্বান আসাটা জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে হাস্যকর মনে হয়। তবে একই বছরে, মাত্র নয় মাসে দুই লাখ বাঙালির সম্ভ্রমহানির মাধ্যমে পাকিস্তান “অল্প সময়ে সবার্ধিক” ধর্ষণের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

ইসরায়েল ও পাকিস্তান রাষ্ট্র দুটির জন্মই হয়েছে ঐশী মতাদর্শের ভিত্তিতে। একাত্তরে পাকিস্তানিদের নৃশংসতায় অনেক সম মতাদর্শীরা দাবি করতে পারে যে, পাক সেনারা “সহি-আস্তিক” ছিলো না। অন্যদিকে, Better Angels Of Our Nature বইতে পিঙ্কার সাহেব সোভিয়েত ইউনিয়নকে অর্থোডক্স চার্চের সাথে জড়ানো চেষ্টা করেছেন; এরমানে হলো, ওনার কাছে সোভিয়েত সেনারা “সহি-নাস্তিক” ছিলো না। ব্যাপার হলো, পাকিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রমান করে যে, কোনো মহান কিংবা ঐশী মতাদর্শই মানুষের বিবর্তনীয় “আচরণ” অগ্রাহ্য করতে পারে না। তাই, মানুষের কখনো বায়োলজিক্যাল সীমাবদ্ধতা উর্ধে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। 

স্টিভেন পিঙ্কেরের বই।

ছয়ই এপ্রিল ইয়াহিয়া ক্ষোভের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নকে “দেশপ্রেমহীন” বাঙালিদের (unpatriotic elements) প্রশ্রয় না দেয়ার জোর দাবি জানায়। মানুষের একটা প্রবণতা হলো জন্মভূমি, পৃথিবী ইত্যাদিকে মাতৃভূমি, ধরণীর মতো নারী চরিত্রে ভূষিত করা। দেশমাতৃকা প্রতি রোমান্টিক ভালোবাসার বা দেশপ্রেমের বিভিন্ন রূপক সাহিত্য, রাজনীতি, পরিবেশবাদসহ মানব পাণ্ডিত্যের প্রায় সব শাখায় খুঁজে পাওয়া যায়। ব্যাপার হলো, পুরুষত্রান্তিক সমাজবাবস্থায় দেশপ্রেম জিনিসটা কোনো “রূপক” নয় বরং “আক্ষরিক”। পুরুষ মস্তিষ্কে “দেশ” ও “নারী” দুটোই সমার্থক, তারা আক্ষরিক অর্থেই “territory”। তাই, বিপরীত মেরুর দুই স্কলারদের কাছ থেকে “তেঁতুল-তত্ত্ব” বা “শাড়ি-তত্ত্বের” মতো বিজ্ঞ সহমতে অবাক হবার কিছুই নেই।