ব্ল্যাকহোল এবং সময় ভ্রমণ

ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের স্পষ্ট অভাব আছে। বিশেষ করে এর কেন্দ্রের সিঙ্গুলারিটির স্বরূপ এখনো সুনিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। এর মূল কারণ, কোয়ান্টাম-মেকানিক্স ও আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার অসঙ্গতি। সিঙ্গুলারিটি বাদ দিয়ে শুধু সাধারণ আপেক্ষিকতাকে হিসেবে নেয়া হলে বলতেই হবে ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে আমরা অনেক কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য জানি। এই তথ্যগুলো এসেছে মূলত সাধারণ আপেক্ষিকতার বিভিন্ন গাণিতিক সমাধান থেকে। যদিও এদের পেছনে বাস্তব পর্যবেক্ষণলব্ধ প্রমাণ খুবই কম।

যদি ইন্টারস্টেলার মুভিটি দেখে থাকেন তবে আপনার হয়তো ধারণা থাকতে পারে ব্ল্যাকহোল মধ্য দিয়ে ভ্রমণ কেমন হতে পারে। দুঃখজনকভাবে, আমরা যতদূর জানি এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বাস্তবে একেবারেই ভিন্ন। আসুন বিস্তারিত জানা যাক।

singularity
ব্ল্যাকহোলের সিঙ্গুলারিটিকে দূর থেকে ত্রিমাত্রিক স্থানে অবস্থিত একটা বিন্দু বলে মনে হয়।

আমরা যদি স্থানকালের বক্রতা দেখতে পেতাম তবে ব্ল্যাকহোলকে বহুদূর থেকে মনে হতো ওপরের ছবিটার মতো। ফানেলের মতো অংশটার শেষে রয়েছে সিঙ্গুলারিটি। বাহির থেকে সিঙ্গুলারিটিকে মনে হবে দূরের একটা জায়গায় অবস্থিত বিন্দুর মতো (Point in space)। আপনি যদি চান তবে ইচ্ছে করলেই আপনার গতিপথ পরিবর্তনের মাধ্যেম এই বিন্দুসম সিঙ্গুলারিটি নামক জায়গাটিকে এড়িয়ে যেতে পারেন। তবে ঘটনাচক্রে সিঙ্গুলারিটি যদি আপনার যাত্রাপথে পরেই যায় তবে সেটা এড়ানোর শেষ সুযোগ হলো ঘটনা-দিগন্ত নামক সীমানা পর্যন্ত। মহাবিশ্বের ত্রিমাত্রিক স্থানে এই ঘটনা-দিগন্ত একটা গোলকের মতো যার ব্যাসার্ধকে বলে সোয়ার্জচাইল্ড ব্যাসার্ধ (Schwarzschild radius)। ব্ল্যাকহোলের ঘটনা-দিগন্ত হলো একটি একমুখী রাস্তা, এই সীমানা একবার অতিক্রম করলে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। ঘটনা-দিগন্তের বাহিরে সোয়ার্জচাইল্ড ব্যাসার্ধের দেড়গুণ বড় ব্যাসার্ধের অঞ্চলকে বলে ফোটনস্ফিয়ার (Photon sphere)। নিচের ছবি।

photosphere
ফোটনস্ফিয়ার। Rs = সোয়ার্জচাইল্ড ব্যাসার্ধ।

ফোটনস্ফিয়ার থেকে ঘটনা-দিগন্ত পর্যন্ত অঞ্চলটিতে স্থানকালের বক্রতাজনিত মাধ্যাকর্ষণ বল প্রচন্ড। কিন্তু, এই অঞ্চল থেকে বের হওয়া একটা রাস্তা আছে, একে বলে এক্সিট-কোণ (Exit Cone), নিচের ছবি।

Exit-Cone
এক্সিট-কোণ এবং ফোটনস্ফিয়ারে আলোর গতিপথ।

ধরুন, ছবির এই হলুদ রঙের এক্সিট-কোণের বিন্দুটিতে আপনি টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। যদি টর্চের আলো এই এক্সিট-কোণের বাহিরে তাক করা হয় তবে স্থানকালের বক্রতার জন্য টর্চের আলো ফোটনস্ফিয়ার থেকে বেরুতে পারবেনা বরং ফোটনেরা ফোটনস্ফিয়ার বরাবর আবর্তিত হতে থাকবে। ইন্টারস্টেলার মুভিতে এই ফোটনস্ফিয়ারকে চমৎকারভাবে দেখানো হয়েছে।

intersteller-photonsphere
ইন্টারস্টেলার (২০১৪): ফোটনস্ফিয়ারে আটকে পরা ফোটন।

আমরা যখন পৃথিবীর বুকে রাতে আকাশের দিকে তাকাই তখন আমরা দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল মহাকাশ দেখতে পাই। কিন্তু, ফোটনস্ফিয়ার থেকে ঘটনা-দিগন্ত পর্যন্ত কোনো অঞ্চলে মহকাশ দেখাবে এক্সিট-কোণ বরাবর এক চিলতে বৃত্তের মতো, এই এক্সিট-কোণ বৃত্তের বাহিরের বাকি সবকিছুই ঘন অন্ধকার।

sky-from-exit-cone
ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি মাথার ওপর এক চিলতে মহাকাশ।

আপনি যতোই ফোটনস্ফিয়ার থেকে ঘটনা-দিগন্তের দিকে এগুবেন আপনার এক্সিট-কোণের পরিধি ততোই কমতে থাকবে, আকাশ ছোট হয়ে আসতে শুরু করবে। ঘটনা-দিগন্তের ওপর দাঁড়ালে এই পরিধি বিন্দুতে পরিণত হবে। আর ঘটনা-দিগন্ত পার হবার সাথে সাথে এই বিন্দুটিও বিলীন হয়ে যাবে। মজার ব্যাপার হলো, ফোটনস্ফিয়ার ঢোকার আগেই, প্রায় ১০ সোয়ার্জচাইল্ড ব্যাসার্ধের কাছাকাছি চলে আসেলই বুঝতে পারবেন যে আপনি ব্ল্যাকহোলের দিকে এগিয়ে চলছেন। আপনাকে শুধু আকাশে নক্ষত্রদের অবস্থান দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ব্ল্যাকহোলের তার অবস্থান বরাবর (Line of sight ) আশপাশের নক্ষত্রদের জন্য গ্র্যাভিটেশনাল-লেন্স হিসেবে কাজ করে, ফলে ব্ল্যাকহোলের বরাবর নক্ষত্রগুলোর একাধিক প্রতিবিম্ব দেখা যায়, নিচের ছবির মতো।

star reflection
অদৃশ্য ব্ল্যাকহোলের গ্র্যাভিটেশনাল-লেন্সিং-এর কারণে সিরিয়াস, বিটেলজিউস, ও প্রোসিয়ন নক্ষত্রের প্রতিবিম্ব।

এবার আসুন একটা কাল্পনিক ভ্রমণে যাওয়া যাক। বহুদূর থেকে ঘটনা-দিগন্ত কাছাকছি চলে আসলে স্থানকালের বক্রতার কারণে আমাদের চারিপাশের মহাকাশ কেমন দেখাবে সেটা নিচের ভিডিওতে দেখানো হয়েছে।

 

এতক্ষণ আমরা ঘটনা-দিগন্তের বাহির থেকে ব্ল্যাকহোলের কার্যকলাপ দেখলাম। এবার আসা যাক, ঘটনা-দিগন্ত অতিক্রম করার পর আমরা কি দেখবো। এখানে আমার উদ্দেশ্য ঘটনা-দিগন্ত ভেতরে স্থানকালের স্বরূপ উপস্থাপন করা। ব্ল্যাকহোল ও তার আশেপাশের স্থানকাল দেখানোর জন্য ক্রুসকেল-সেকারেস্ ডায়াগ্রাম (Kruskal–Szekeres Diagram) ব্যবহার করা হয়। এই কোঅর্ডিনেট সিস্টেমের প্রবক্তা মার্টিন ক্রুসকেল ও জর্জ সেকারেস্। ব্ল্যাকহোলের ক্রুসকেল-সেকারেস্ ডায়াগ্রাম ব্যাখ্যা আগে স্বাভাবিক স্থানকালের স্পেসটাইম ডায়াগ্রাম ব্যাখ্যা করা দরকার। ধরুন, আপনি স্থানকালের কোনো বিন্দু O-তে দাঁড়িয়ে আছেন, তবে আপনার স্পেসটাইম ডায়াগ্রাম দেখাবে নিচের মতো।

spacetime-diagram
স্থানকালের কোনো বিন্দু O-তে স্পেসটাইম ডায়াগ্রাম।

ওপরের ছবিতে Y-অক্ষ “সময়” এবং X-অক্ষ “স্থান” নির্দেশ করছে, স্থান-অক্ষ বরাবর আপনি ডানে (সামনে/Forward) বা বামে (পেছনে/Backward) যেতে পারেন। আর সময়-অক্ষ বরারর আপনি ওপরে (ভবিষ্যৎ/Future) বা নিচে (অতীত/Past) যেতে পারেন। আপনার চলাচলের ক্ষেত্রে শুধু একটা শর্ত আছে। সেটা হলো, আপনার সর্বোচ্চ গতি হতে পারবে আলোরগতির সমান। অর্থাৎ, আপনার গতি কখনোই আলোর চেয়ে বেশি হতে পারবেনা। ধরুন, আপনার অবস্থান O বিন্দুতে, এখন আপনি যদি আলোরগতিতে OD-দূরত্ব সামনের দিকে এগিয়ে যান এবং এরজন্য যদি আপনার OC-সময় খরচ হয়, তবে আপনার নতুন অবস্হান হবে P বিন্দুতে। ভালো করে খেয়াল করে দেখবেন, আপনি আপনার সর্বোচ্চ গতিতে সামনে বা পেছনে যেদিকেই যান, আপনার “গতিপথ” সময়-অক্ষের ওপরের অংশ, অর্থাৎ, ভবিষ্যৎ বরাবর ৪৫ ডিগ্রী কোণ করে থাকে। স্পেসটাইম ডায়াগ্রামে আপনার বৈধ গতিপথ ভবিষ্যৎ-অক্ষ বরাবর একটা ৪৫ ডিগ্রী ত্রিমাত্রিক মোচক (Cone) তৈরি করে যেটা ডায়াগ্রামে ওপরের সাদা অঞ্চলের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। এই ত্রিমাত্রিক মোচকে বলা হয় লাইট-কোণ (Light cone)। আপনি ভবিষ্যৎ বরাবর এই ৪৫ ডিগ্রী লাইট-কোণ ভেতরে যেখানে খুশি যেতে পারেন, কিন্তু, ৪৫ ডিগ্রী অতিক্রম করতে হলে আপনাকে আলোর চেয়ে বেশি গতিতে ছুটতে হবে, যেটা নিষিদ্ধ। হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, স্থান-অক্ষ বরাবর আপনি ডানে বা বামে যেতে পারেন (অবশ্যই ৪৫ ডিগ্রী সীমানার মধ্যে), তাই X-অক্ষ দুই মাথায় তীর চিহ্ন দেয়া আছে। কিন্তু, সময়-অক্ষ বরাবর আপনি শুধুই ওপরে যেতে পারেন কারণ ভবিষ্যৎ আপনার লাইট-কোণের ভেতরে অবস্হিত। কিন্তু, অতীত আপনার লাইট-কোণের বাহিরে অবস্হিত, তাই অতীতে যেতে আপনাকে ৪৫ ডিগ্রী সীমানা লঙ্ঘন করতে হবে, অর্থাৎ, আলোর চেয়ে বেশি গতিতে ছুটে হবে। একারণে, সময়-অক্ষে তীর চিহ্ন শুধুমাত্র ভবিষ্যতের দিকেই দেয়া আছে।

এখন ব্ল্যাকহোলের ফেরা যাক। ক্রুসকেল-সেকারেস্ ডায়াগ্রাম প্রায় স্পেসটাইম ডায়াগ্রামের মতোই, এখানেও ৪৫ ডিগ্রী লাইট-কোণ অনুসরণ করতে হয়। নিচে ব্ল্যাকহোলের ক্রুসকেল-সেকারেস্ ডায়াগ্রাম দেয়া হলো।

none-rotating-KSD
ক্রুসকেল-সেকারেস্ ডায়াগ্রাম: তিনটি সম্ভাব্য ভ্রমণ।

ওপরের ডায়াগ্রামে আমাদের মহাবিশ্ব থেকে তিনটি সম্ভাব্য ভ্রমণ দেখানো হয়েছে। ভ্রমণ-A (Trip A) অত্যন্ত সাদামাটা, এর মানে হলো, আপনি লাইট-কোণের ভেতরে মহাবিশ্বের যেকোনো জায়গায় যেতে পারেন। ভ্রমণ-B (Trip B) বৈধ, কারণ এটিও লাইট-কোণের ভেতরে অবস্থিত। তবে এই ভ্রমণের বৈশিষ্ট্য হলো, আপনার গতিপথে একটা ব্ল্যাকহোল আছে। সমস্যাটা হচ্ছে ঘটনা-দিগন্ত পার হবার আর ফিরে আসা সম্ভব নয়, কারণ, ঘটনা-দিগন্ত ওপারে আপনি যে লাইট-কোণ পাবেন তার ভেতরে কোনো ঘটনা-দিগন্ত থাকবেনা, নিচের ছবি।

none-rotating-KSD-2
ঘটনা-দিগন্তের ভেতরের লাইট-কোণ (নীল রং)।

আগে বলেছিলাম, ঘটনা-দিগন্তের বাহির থেকে সিঙ্গুলারিটিকে মনে হয় একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থিত একটা বিন্দুসম স্থানের মতো (Point in space), কিন্তু, ঘটনা-দিগন্তের ভেতরে সিঙ্গুলারিটিকে মনে হয় একটা ঘটনা যেটা আপনার ভবিষ্যতে অবস্থিত (Event in time)। আপনি লাইট-কোণের ভেতরে যেদিকেই যাননা কেনো আপনি সিঙ্গুলারিটিকে কোনোভাবেই এড়াতে পারবেননা।  অর্থাৎ, ঘটনা-দিগন্তের বাহির ও ভেতরে পর্যবেক্ষকে দৃষ্টিভঙ্গিই পুরোপুরি উল্টো হয়।

ভ্রমণ-C (Trip C) ঠিক একই কারণে বৈধ নয়, অর্থাৎ, ঘটনা-দিগন্তের ভেতরে এমন লাইট-কোণ পাওয়া সম্ভব নয় যেটাতে ঘটনা-দিগন্ত থাকবে। কিন্তু, এই ভ্রমণটি অত্যন্ত ইন্টারেষ্টিং। তাই এর একটু ব্যাখ্যা দরকার। ওপরের ক্রুসকেল-সেকারেস্ ডায়াগ্রামটিতে আসলে দুটি ব্ল্যাকহোল, এবং দুটি মহাবিশ্ব বা স্থানকাল দেখানো হয়েছে। এইধরণের বিন্যাসটাকে বলে আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ বা ওয়ার্মহোল। বাহির থেকে এই ওয়ার্মহোলকে দেখায় নিচের ছবি দুটির মতো।

wormhole-1
“আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ” বা “ওয়ার্মহোল”: একই মহাবিশ্বের দুটি দূরবর্তী স্থানকালকে সংযুক্ত করে।
wormhole-2
“আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ” বা “ওয়ার্মহোল”: দুটি বিছিন্ন মহাবিশ্বকে সংযুক্ত করে।

পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে ওয়ার্মহোলের দুটো ব্ল্যাকহোলের একটি হলো হোয়াইটহোল (Whitehole)। ক্রুসকেল-সেকারেস্ ডায়াগ্রামটিতে আমাদের মহাবিশ্বের (Our universe) সাপেক্ষে নিচের সিঙ্গুলারিটি হলো হোয়াইটহোল, আর অন্য মহাবিশ্বের (Other universe) সাপেক্ষে ওপরের সিঙ্গুলারিটি হলো হোয়াইটহোল। হোয়াইটহোল ব্ল্যাকহোলের মতোই একমুখী রাস্তা, তবে বিপরীতমুখী। কোনো বস্তু একবার হোয়াইটহোলের ঘটনা-দিগন্ত অতিক্রম করে আমাদের মহাবিশ্বে প্রবেশ করলে সেটাকে আর ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়।

এবার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণ আপেক্ষিকতা থেকে ব্ল্যাকহোল পাওয়ার মোট চারটি সমাধান আছে। এদের মধ্যে দুই ধরণের ব্ল্যাকহোলের স্থির, বাকি দুই ধরণের ঘূর্ণনশীল (rotating) । এতক্ষণ আমরা যেই ব্ল্যাকহোলগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি তাদের ঘূর্ণনগতি নেই, এরা স্থির, এদের বলে সোয়ার্জচাইল্ড ব্ল্যাকহোল। এটা এখন স্পষ্ট যে, ভ্রমণ-C বা ওয়ার্মহোল অতিক্রম করা সোয়ার্জচাইল্ড ব্ল্যাকহোল দিয়ে সম্ভব নয়।

four-BH-solutions
সাধারণ আপেক্ষিকতার চারটি ব্ল্যাকহোল সমাধান।

অন্যদিকে, ঘূর্ণনশীল ব্ল্যাকহোলদের বলা হয় কার্র (Kerr) ব্ল্যাকহোল। নিউজিয়াল্যান্ডের রয় কার্র (Roy Kerr) সর্বপ্রথম ঘূর্ণনশীল ব্ল্যাকহোলের সমাধান বের করেন। কার্র ব্ল্যাকহোলের মজার ব্যাপার হলো, এদের দুটো ঘটনা-দিগন্ত থাকে। এই ঘটনা-দিগন্ত দুটোর ব্যাসার্ধ নির্ভর করে এদের ঘূর্ণনগতির ওপর। কার্র ব্ল্যাকহোলের বহিঃঘটনা-দিগন্ত ও এর সোয়ার্জচাইল্ড ব্যাসার্ধের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে বলে আর্গোস্ফিয়ার (Ergosphere)। নিচের ছবি দুটির মতো।

Kerr_black_hole
কার্র ব্ল্যাকহোলের: r-outer = বহিঃঘটনা-দিগন্ত, r-inner = আন্তঃঘটনা-দিগন্ত, r-static = সোয়ার্জচাইল্ড ব্যাসার্ধ।
static-rotating-BH
ঘূর্ণনের ফলে ব্ল্যাকহোলের ঘটনা-দিগন্তের আকার হ্রাস পায় এবং আর্গোস্ফিয়ারের সৃষ্টি হয়।

ঘূর্ণনশীল ব্ল্যাকহোলের একটা মজার বৈশিষ্ট্য হলো, ঘূর্ণনগতি যখন সর্বোচ্চে পৌঁছে তখন এর ঘটনা-দিগন্ত দুটি একে অপরকে বিলীন করে ফেলে। ফলে, ব্ল্যাকহোল হয়ে পরে ঘটনা-দিগন্তহীন সিঙ্গুলারিটিতে, নিচের ছবি। আগে বলেছিলাম, আকাশে নক্ষত্রদের এলোমেলো অবস্থান দেখে অনেক দূর থেকেই কোনো ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। কিন্তু, সিঙ্গুলারিটি ছাড়া এই ধরণের নগ্ন ব্ল্যাকহোল স্থানকালে অন্যকোনো বক্রতা তৈরি করে না। তাই, একবারে সিঙ্গুলারিটিতে আছড়ে পরার আগ পর্যন্ত এই ব্ল্যাকহোলের অবস্হান বোঝা সম্ভব নয়। ব্যাপারটা অনেকটা বেখেয়ালে হাঁটার সময় নুড়ি পাথরে হোঁচট খাওয়ার মতো। অনেক অ্যাস্ট্রোফিজিস্ট মনে করেন, যদিও নগ্ন ব্ল্যাকহোল একটি গাণিতিক ভবিষ্যদ্বাণী, বাস্তবের হয়তো এদের পাওয়া যাবে না।

naked singularity
ঘটনা-দিগন্ত বিহীন নগ্ন ব্ল্যাকহোল।

সাধারণ আপেক্ষিকতার একটা ভবিষ্যদ্বাণী হলো, স্থানকালের নমনীয়তা (Elasticity)। কোনো আবর্তনশীল বস্তু সাথে সাথে স্থানকাল নিজেও ঘুরতে থাকে। স্থানকালের এই ঘূর্ণন ঘটে বস্তুর বিষুবরেখা (Equator) বরাবর এবং এর নাম ফ্রেম ড্র্যাগিইং (Frame Dragging) নিচের ছবি।

spacetime-frame-dragging
পৃথিবীর ঘুর্ণনের ফলে স্থানকালের স্থানীয় ফ্রেম ড্র্যাগিইং।

ফ্রেম ড্র্যাগিইং ছাড়াও স্থানকালের আরো একটি চলন (Motion) আছে, যেটাকে বলে জিওডেটিক প্রিসেশন (Geodetic precession)।  আবর্তনশীল বস্তুর ঘূর্ণন অক্ষ হেলে পরার কারণে স্থানকালের জিওডেটিক প্রিসেশন ঘটে। NASA-এর গ্র্যাভিটি প্রোব বি (Gravity Probe B) স্যাটেলাইটের পাঠানো তথ্য অনুসারে পৃথিবীর কারণে স্থানকালের ফ্রেম ড্র্যাগিইং ও জিওডেটিক প্রিসেশনের অনুমিত ও পরিমিত মান দেয়া হলো নিচের ছবিতে।

Gravity Probe B
ফ্রেম ড্র্যাগিইং ও জিওডেটিক প্রিসেশনের ভবিষ্যদ্বাণী ও পরিমিত মান। Photo Credit: https://physics.aps.org/articles/v4/43

কার্র ব্ল্যাকহোলের আর্গোস্ফিয়ার অঞ্চলে স্থানকালের ফ্রেম ড্র্যাগিইং ভয়াবহ রকম বেশি। বস্তুত, এমন কোনো মহাকাশ যান তৈরি করা সম্ভব নয় যেটা আর্গোস্ফিয়ার ভেতর ফ্রেম ড্র্যাগিইং-এর বিপরীতে স্থির থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, আর্গোস্ফিয়ারের এই ফ্রেম ড্র্যাগিইং ব্যবহার করে, উন্নত সভ্যতা তাদের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে পারে, নিচের ছবির মতো। আর্গোস্ফিয়ারের একদিকে তাদেরকে কোনো বস্তু ফেলে দিতে হবে (অনেকের মতে, আবর্জনা হলেও চলবে), এই নিক্ষিপ্ত বস্তুটি আর্গোস্ফিয়ারের অন্যদিক দিয়ে প্রচন্ড গতিতে বেড়িয়ে এসে একটা টারবাইন ঘোরাতে থাকবে। এই প্রক্রিয়ার ফলে, সময়ে সাথে সাথে ব্ল্যাকহোল তার ঘূর্ণনগতি হারাতে থাকবে এবং আর্গোস্ফিয়ারের আকার ছোট হতে থাকবে।

power-ergosphere
কার্র ব্ল্যাকহোলের আর্গোস্ফিয়ার ব্যবহার করে উন্নত সভ্যতা তাদের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আবর্জনা পুনর্ব্যবহারযোগ্য করতে পারে।

এবার কার্র ব্ল্যাকহোলের ক্রুসকেল-সেকারেস্ ডায়াগ্রাম দেখা যাক। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটি হলো এটা, সোয়ার্জচাইল্ড ব্ল্যাকহোলের সিঙ্গুলারিটি সময়-অক্ষের সাথে লম্ব অবস্হায় থাকে, ফলে সিঙ্গুলারিটির কাছাকাছি অঞ্চলের লাইট-কোণগুলোতে ঘটনা-দিগন্ত পাওয়া যায় না। কিন্তু, কার্র ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে সিঙ্গুলারিটি সময়-অক্ষের সাথে সমান্তরাল অবস্থায় থাকে, তাই সিঙ্গুলারিটির কাছাকাছি অঞ্চলের লাইট-কোণগুলোতে ঘটনা-দিগন্ত পাওয়া খুবই সম্ভব।

KSD-Kerr-BH
কার্র ব্ল্যাকহোলের ক্রুসকেল-সেকারেস্ ডায়াগ্রাম। ভ্রমণ-৩ লাইট-কোণের ভেতরে।

ভ্রমণ-A ও B সোয়ার্জচাইল্ড ব্ল্যাকহোলের মতোই তাই আলোচনা করা হলো না। ভ্রমণ-D সম্ভব নয়, কারণ এটি লাইট-কোণের বাহিরে হওয়ায় এই ভ্রমণে আলোর চেয়ে বেশি গতি প্রয়োজন। কিন্তু, কার্র ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে ভ্রমণ-C বৈধ, কারণ, এই ভ্রমণের গতিপথ লাইট-কোণের ভেতর। অর্থাৎ, কার্র ব্ল্যাকহোলের তৈরি  ওয়ার্মহোল দিয়ে ভিন্ন মহাবিশ্বে ভ্রমণ করা গণিতিকভাবে সম্ভব।

এবার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এতক্ষণ আমরা ব্ল্যাকহোলের ভেতরে ও বাহিরে স্থানকালের বক্রতার জ্যামিতি নিয়ে আলোচনা করেছি। সমস্যা হলো, ব্ল্যাকহোল বক্রতার (Curvature) পাশাপাশি স্থানকালের টোপোলজিও (Topology) পরিবর্তন করে। উদাহরণ দেয়া যাক, একটা কাগজকে যদি রোল করে পাইপের আকার দেয়া হয়, তবে এতে কাগজের পৃষ্টে বক্রতা তৈরি হয় না বরং পৃষ্টের টোপোলজির পরিবর্তন হয়। নিচের ছবিতে লাল সরলরেখাটি পৃষ্টের টোপোলজি পরিবর্তনের কারণে একটা বৃত্তাকারে রূপান্তরিত হয়েছে।

PaperRoll
পাইপ টোপোলজিতে লাল সরলরেখা ধরে চলতে থাকলে পুরো বৃত্তাকার পথ ঘুরে আবার শুরুতে এসে পৌঁছানো সম্ভব।

কার্র ব্ল্যাকহোল কাগজের মতোই ক্রুসকেল-সেকারেস্ ডায়াগ্রামকেও পাইপ টোপোলজির দিতে পারে। নিচের ছবি।

KSD-topology
ক্রাসকেল-সেকারেস্ ডায়াগ্রামের পাইপ টোপোলজি।

ওপরের ছবি দেখে হয়তো ধরতে পারছেন আলোচনা কোন দিকে গড়াচ্ছে। এই পাইপ টোপোলজিতে আপনি যদি শুরুর স্থানটি ঠিকমতো বেছে নিতে পারেন তবে গাণিতিকভাবে আপনি এমন একটি লাইট-কোণ পেতে পারেন যেটা অনুসরণ করলে আপনি আপনার শুরুর মহাবিশ্বেই ফিরে আসবেন, তবে, সময়টা হবে অতীত। অর্থাৎ, কার্র ব্ল্যাকহোল স্থানকালের বক্রতা ও টোপোলজি পরিবর্তনের মাধ্যমে এমন ধরণের আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ বা ওয়ার্মহোল তৈরি করতে পারে যা দিয়ে টাইমট্রাভেল করা সম্ভব। এই টাইমট্রাভেল ওপর ভিত্তি করেই কারণ-প্রভাব ভঙ্গের প্যারাডক্সগুলো গড়ে উঠেছে। অনেকেই মনে করেন, ওয়ার্মহোল ভ্রমণ আদতেই সম্ভব নয়। কারণটা হলো, ঘটনা-দিগন্ত পার হবার সাথে সাথে বস্তুর গতি আলোরগতি সমান হয়ে পরে, ফলে বস্তুর ভরবেগ হয় অসীম। বস্তুর এই অসীম ভরবেগ বা অসীম শক্তির প্রভাবে ওয়ার্মহোল ভেঙ্গে পরবে, ওয়ার্মহোল অতিক্রম করার আগেই। প্রকৃতি হয়তো ওয়ার্মহোল তৈরি করে কিন্তু, ভ্রমণের জন্য এদের ব্যবহার করা সম্ভব নয়।

“এলেক্স ফিলিপেঙ্কো” (Alex Filippenko) ও জে প্যাসাকফ (Jay M Pasachoff)  রচিত “The Cosmos: Astronomy in the New Millennium” অবলম্বনে