স্থানকালের বিদায়

আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা আমাদের সর্বপ্রথম ধারণা দিয়েছিলো যে, “স্থান” ও “সময়” মূলত একই জিনিস তাই দুটোকে একসাথে বলা হয় “স্থানকাল” এবং প্রতিটি পর্যবেক্ষকের জন্য স্থানকালের পরিমাপ আলাদা আলদা। অন্যদিকে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা বলে, “স্থানকাল” ও “মাধ্যাকর্ষণ-ক্ষেত্র (Gravitational Field)” একই জিনিস। স্থানকাল বক্রতার মাধ্যমে মাধ্যাকর্ষণ-ক্ষেত্রের স্বরূপ নির্দেশ করে। আমাদের জানা মতে, প্রতিটি ফিল্ডই কোনো না কোনো পরিসরে কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট প্রকাশ করে। তাই আমাদের বিশ্বাস, স্থানকালেরও কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট রয়েছে। স্থানকালের কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট জানার জন্য আমাদেরকে প্রথমে স্থান ও সময়ের প্রকৃতি সম্পর্কে একটু জানা দরকার। সাধারণ আপেক্ষিকতায় স্থানকালকে মসৃন রেইম্যানিয়ান সমতলে (Riemannian manifold) মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, মাধ্যাকর্ষণ হলো এই মসৃন সমতলের বক্রতা। অর্থাৎ, সাধারণ আপেক্ষিকতায় মাধ্যাকর্ষণ হলো একটা মসৃন সমতলের জ্যামিতিক বৈশিষ্ট। সমস্যা হলো, স্থানকালের এই বর্ণনা কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

এই  অসংগতি প্রথম উম্মোচিত হয় একটা ভুল থেকে, ভুলটি করেন একজন রাশান পদার্থবিদ নাম লেভ ল্যানদাউ (Lev Landau)। হাইজেনবার্গ তার বিখ্যাত অনিশ্চয়তার নীতি ও তার গাণিতিক সমীকরণের প্রকাশের পরপরই ১৯৩১ সালে ল্যানদাউ এটা প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, স্থানকালের নির্দিষ্ট কোনো বিন্দুতে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের কোনো উপাদানকে নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা যায় না। উনার উপলব্ধি এই ছিলো এরকম, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতির কারণে স্থানকালে কোনো স্পষ্ট অবস্থান নির্ণয় সম্ভব নয় (Sharp location with arbitrary precision)। নীলস বোর ভুলটি ধরতে পারেন এবং ১৯৩৩ সালে তিনি লিও রোসেনফেল্ডের (Léon Rosenfeld) একটা গবেষণাপত্র ব্যবহার করে প্রমাণ করেন যে, কোয়ান্টাম তত্ত্বে স্থানকালের স্পষ্ট বিন্দুতে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের কোনো একক উপদানের নির্ভুল পরিমাপে কোনো বাধা নেই। কিন্তু, ল্যানদাউ এতো সহজে হার মানার পাত্র ছিলেন না। তিনি “স্থানকাল”, “ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড”, ও “অনিশ্চয়তার নীতি” সংক্রান্ত এই বিবাদে টেনে আনলেন এক তরুণ বন্ধুকে যার নাম ম্যাটভেই পিত্রোভিচ ব্রনস্টেইনকে (Matvei Petrovich Bronstein)। ব্রনস্টেইন ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান, তিনটি খুব শীঘ্রই (১৯৩৬ সালে) বুঝতে পারলেন যে, “ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড” বাদ দিয়ে যদি “মাধ্যাকর্ষণ-ক্ষেত্র” এবং সাধারণ আপেক্ষিকতাকে হিসেবে আনা হয় তবে ল্যানদাউ ধারণা সঠিক। অর্থাৎ, কোয়ান্টাম তত্ত্ব সত্যি সত্যিই স্থানকালে স্পষ্ট অবস্থান নির্ণয়ে বাধা দেয়। নিচে ব্রনস্টেইনের এই আবিষ্কারের আধুনিক বর্ণনা দেয়া হলো।

Matvei Petrovich Bronstein
এটা ম্যাটভেই পিত্রোভিচ ব্রনস্টেইনের শেষ ছবি। যিনি সর্বপ্রথম আইনস্টাইনের স্থানকালে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতির প্রভাব (কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি) বুঝতে পেরেছিলেন। স্টালিনের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী না হওয়ায় অগাস্ট ৬, ১৯৩৭ থাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ফেব্রুয়ারী ১৯৩৮ সালে লেনিনগ্রাদ কারাগারে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।

ধরুন, আমরা স্থানকালের একটা নির্দিষ্ট অবস্হান x-এ কোনো কণার (Particle) ভরবেগ p বের করবো। প্রথমে আমাদেরকে x অবস্থানটি খুঁজে বের করতে হবে। আমরা চাই এই অবস্হান নির্ণয়ের নির্ভুলতা (Precision) হবে “L”। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি বলছে, কণাটির অবস্হান ও ভরবেগের কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা হলো যথাক্রমে Δx ও Δp। অবস্হান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য, L > Δx। অনিশ্চয়তার সমীকরণ থেকে আমরা পাই, Δp > ħ/Δx বা Δp > ħ/L। এক্সপেরিমেন্ট অনুসারে p^২-এর গড় মান সবসময় (Δp)^২-এর চেয়ে বেশি, তাই আগের সমীকরণটি লেখা যায় এভাবে, p^২ > (ħ/L)^২। এই p^২ > (ħ/L)^২ হলো হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতির সুপরিচিত পরিণতি, আর এর মানে হলো, “স্পষ্ট অবস্হান নির্ণয়ের জন্য প্রচুর ভরবেগের দরকার”। ঠিক এইজন্যই CERN-এ ক্ষুদ্র পরিসরে (Small Scale) পর্যবেক্ষণের জন্য উচ্চ ভরবেগযুক্ত কণা ব্যবহার করা হয়। খেয়াল করুন, আমরা এখনো কোয়ান্টাম মেকানিক্সেই আছি। এবার ভরবেগ জিনিসটার দিকে আসা যাক, কণার স্থিরভর (Rest Mass) যদি নগন্য ধরা হয়, তবে বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, E ~ cp (এখানে E = শক্তি, c = শূন্যস্থানে আলোরবেগ)। অর্থাৎ, আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, প্রচুর ভরবেগের জন্য প্রচুর শক্তির দরকার। আমরা জানি, শক্তি ও ভর একই জিনিস, শক্তি প্রয়োগে কণার ভর বৃদ্ধি পায়, এই ভরকে আমরা বলি মাধ্যাকর্ষণজনিত ভর (Gravitational Mass), আর মাধ্যাকর্ষণজনিত ভর স্থানকালের বক্রতার সৃষ্টি করে, তাই সংক্ষেপে বলা যায়, শক্তি মাধ্যাকর্ষণ সৃষ্টি করে। এখন, কণার ওপর শক্তি প্রয়োগের ফলে যে মাধ্যাকর্ষণজনিত ভর তৈরি হবে সেটা খুব সহজেই আইনস্টাইনের বিখ্যাত E=mc^২ সমীকরণের মাধ্যমে বের যায় করা, এই ভরের মান M ~ E/c^২। যেহেতু, ভর ও মাধ্যাকর্ষণ ইত্যাদি চলে আসলো তাই আমাদেরকে এখন সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বকে টেনে আনতে হবে। সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে, শক্তি বাড়ার সাথে সাথে স্থানকালের বক্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকবে, এক পর্যায়ে এই বক্রতা ব্ল্যাকহোলে রূপান্তরিত হবে, যার ঘটনা-দিগন্তের ব্যাসার্ধ, R ~ GM/c^২, এখানে, G নিউটন  ধ্রুবক আর M মাধ্যাকর্ষণজনিত ভর। এখন, L-কে যদি খুব ছোট একটা অঞ্চল হিসেবে ধরা হয় (L যতো ছোট হবে কণার অবস্হানও ততো স্পষ্ট হবে) তবে এই ক্ষুদ্র অঞ্চলে কণার অবস্হানও নির্ণয়ের জন্য প্রচুর শক্তি প্রয়োগ করতে হবে, ফলে একসময় R > L হয়ে পরবে, এর মানেটা হলো, “L” নামক যেই অঞ্চলে আমরা কণা খোঁজার চেষ্টা করছিলাম সেটা এখন একটা মিনি ব্ল্যাকহোলে ভেতরে। L-এর এই ক্ষুদ্রতম মানটি হলো, L = √(ħG/c^৩) ~ ১০^(-৩৩) সেন্টিমিটার। এই দৈর্ঘ্যকে বলে প্লান্ক-দৈর্ঘ্য (Planck Length)। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও সাধারণ আপেক্ষিকতাকে যখন এক করা হয় তখন প্লান্ক-দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। তাই স্থানকালে প্লান্ক-দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট অঞ্চলকে বলে মিনি ব্ল্যাকহোল।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে সাব-প্লান্ক-দৈর্ঘ্যে (Sub Plank Length) স্থানকালের শক্তি ওঠানামা করে, যেটাকে বলে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন (Quantum Fluctuation)। কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের কারণ হলো ওই হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি। অনিশ্চয়তার নীতি বলে, স্থানকালে যেকোনো ফিল্ডের শক্তির মান সুনির্দিষ্ট হতে পারে না। তাই স্থানকালের কোনো অঞ্চল যদি একেবারেই বস্তুশূন্য হয় তবুও ওই অঞ্চলের শক্তির পরিমাণ শূন্য হবে না, বরং শক্তির পরিমাণ ক্ষণে ক্ষণে ওঠানামা করবে (Quantum Jitters)। কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের গাণিতিক মান ১০^১১২ আর্গ/ঘন সেন্টিমিটার এবং পর্যবেক্ষণকৃত মান ১০^(-৮) আর্গ/ঘন সেন্টিমিটার। কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনকে বলা হয় শূন্যস্থানের শক্তি বা ভ্যাকুয়াম এনার্জি। ভ্যাকুয়াম এনার্জির গাণিতিক ও পর্যবেক্ষণকৃত মানের ব্যবধান ১০^(-১২০), এই সংখ্যাকে বলে মহাজাগতিক ধ্রুবক (Cosmological Constant)। সাব-প্লান্ক-দৈর্ঘ্যে স্থানকালের এই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের কারণে প্রতিনিয়তই অগণিত ভার্চুয়াল কণা ও প্রতিকণার (Anti Particle) সৃষ্টি হয় এবং মুহূর্তেই বিপরীতধর্মী কণার নিজেদের বিনাশ করে। এই ভার্চুয়াল কণারা অন্য যেকোনো ফার্মিয়ন ও বোসন কণাদের মতোই, শুধু পার্থক্য হলো, এদের সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় না। কিন্তু, পর্যবেক্ষণকৃত কণাদের ওপর এইসব ভার্চুয়াল কণাদের প্রভাব পরিমাপ করা যায়। সাব-প্লান্ক-দৈর্ঘ্যে ভার্চুয়াল কণা ও প্রতিকণাদের সৃষ্টি ও বিলীনের ঘটনাকে বলে কোয়ান্টাম ফেনা (Quantum Foam)। অন্যদিকে, সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বমতে, সাব-প্লান্ক-দৈর্ঘ্যে স্থানকাল অত্যন্ত মসৃন, অর্থাৎ, মাধ্যাকর্ষণ-ক্ষেত্রের শক্তিমাত্রা স্থির।

Quantum foam
শিল্পীর দৃষ্টিতে কোয়ান্টাম ফেনা

কথা হলো, সমস্যাটা কোথায়? কোয়ান্টাম মেকানিক্সে নাকি সাধারণ আপেক্ষিকতায়? এই দুটোই হলো পদার্থবিজ্ঞানের সফলতম দুটি তত্ত্ব। কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটি মতে স্থানকাল সম্পর্কিত আমাদের প্রচলিত ধরণাগুলো ভুল, আমরা মনে করি যে, স্থানকাল হলো বিশাল একটা কন্টেইনার যার মধ্যে বিভিন্ন কোয়ান্টাম-ফিল্ডগুলো অবস্থিত। কিন্তু বাস্তবে, স্থান ও সময় হলো কোয়ান্টাম কনফিগারেশন, অর্থাৎ, স্থান ও সময় যেকোন কণার স্পিন, চার্জ, ঘূর্ণন-ভরবেগ ইত্যাদির মতোই কোয়ান্টাম স্টেট নির্দেশ করে। স্থানকালের অবস্থান কোয়ান্টাম-ফিল্ডের মধ্যেই, যদি তাই হয়, তবে স্থান ও সময় দুটোরই কোয়ান্টাইজ (Quantized) করা জরুরি। সাধারণ আপেক্ষিকতায় আইনস্টাইন মাধ্যাকর্ষণকে স্থানকালের জ্যামিতিতে পরিণত করেছিলেন। আর কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির কাজ এই জ্যামিতিকে কোয়ান্টাইজ করা। যদি সেটা সম্ভব হয় তবে মাধ্যাকর্ষণকে কোয়ান্টাম-ফিল্ড তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে, এবং তাহলেই মাধ্যাকর্ষণের জন্য আমাদের আর আইনস্টাইনের স্থানকালের প্রয়োজন হবে না।

end of space-time
স্থানকালের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। সত্যিকারের কোয়ান্টাম গ্রাভিটিতে স্থানকালের প্রয়োজন নেই। বিদায় স্থানকাল।

অবলম্বনে: “Covariant Loop Quantum Gravity: An Elementary Introduction to Quantum Gravity and Spinfoam Theory” by “Carlo Rovelli” and “Francesca Vidotto”