ক্যান্সারের প্রচলিত চিকিৎসাগুলো হলো: শল্যচিকিৎসা বা সার্জারি, বিকিরণ থেরাপি, এবং রাসায়নিক থেরাপি বা কেমোথেরাপি। যে চিকিৎসাগুলো এখনো উন্নয়ন কিংবা নিরীক্ষাধীন পর্যায়ে আছে সেগুলো হলো: ইমিউনো থেরাপি, এবং জিন থেরাপি। ক্যান্সার চিকিৎসায় একাধিক ব্যবস্থা পরিপূরক হিসেবে প্রয়োগ করা হয়, এদের বলে অ্যাডজ্যাভ্যান্ট থেরাপি (Adjuvant therapy)। যেমন: শল্যচিকিৎসা পরপর যদি কেমোথেরাপি ব্যবহার করা হয়, তবে কোমোথেরাপি হলো অ্যাডজ্যাভ্যান্ট।
প্রায় ৯০% ক্যান্সার নির্ধারণ করা হয় শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে। একে বলে বায়োপসি (Biopsy): বায়োপসি বিভিন্ন প্রকারের হয় যেমন: Needle aspiration, Core needle biopsy, Incisional biopsy (এতে টিউমারে ছোট্ট একটা অংশ খুলে নেয়া হয়), এবং Excisional biopsy (এতে পুরো টিউমার খুলে নেয়া হয়)। প্রায় ৬০% ক্যান্সার টিউমার অপসারণে শল্যচিকিৎসা ব্যবহার করা হয়। শল্যচিকিৎসা সুবিধাগুলো হলো: ক্যান্সার শল্যচিকিৎসার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। এই চিকিৎসার কোনো কার্সিনোজেনিক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই, প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার ধরা পড়লে শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে পুরোপুরি আরোগ্য সম্ভব। আর অসুবিধাগুলো হলো: মেটাস্টেসিস পর্যায়ে শল্যচিকিৎসার ব্যবহার করা যায় না, এতে ছড়িয়ে যাওয়া ক্যান্সার কোষের এঞ্জিয়োজেনেসিস শুরু হয়ে পড়ে। চোখসহ কিছু কিছু অঙ্গে সূক্ষ্ম শল্যচিকিৎসা চালানো কঠিন, তাই শল্যচিকিৎসায় ছোট্ট টিউমারে পুরো চোখ সরিয়ে ফেলতে হয়। আবার মস্তিষ্কে মতোকিছু কিছু অঙ্গে শল্যচিকিৎসায় টিউমারের সাথে সাথে আশেপাশের গুরুত্বপূর্ণ টিস্যু অপসারণ করতে হয়, ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার ব্যাঘাত ঘটাতে সম্ভাবনা থাকে।
টিউমার যদি শরীরের দুর্গম কোনো অংশে কিংবা শল্যচিকিৎসার জন্য বিপদজনক এমন কোনো অঙ্গে অবস্থান করে, তবে বিকিরণ থেরাপি ব্যবহার করা হয়। চোখ, মস্তিস্ক ইত্যাদি অঙ্গের জন্য বিকিরণ একটি আর্দশ চিকিৎসা। বিকিরণ থেরাপিতে ব্যবহার করা হয় তরঙ্গ-বিকিরণ বা কণা-বিকিরণ। টিউমারের প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা নেয়া হোলে বিকিরণ থেরাপির মাধ্যমে পূর্ণ আরোগ্য সম্ভব। বিকিরণের কাজ হলো ক্যান্সার কোষের যতো বেশি সম্ভব ক্ষতি করা। আমরা আগেই দেখেছি বিকিরণ কিভাবে DNAয়ের ক্ষতি করে; DNA ক্ষতি ছাড়াও বিকিরণ কোষের ফসফোলিপিড-মেমব্রেন গলিয়ে ফেলা, প্রোটিন নষ্ট করে দেয়া সহ বিভিন্ন রকমের ক্ষতি করে।
তরঙ্গ-বিকিরণে উচ্চশক্তির ফোটন ব্যবহার করা হয়, যেমন: এক্স-রে (বা রঞ্জন-রশ্মি), এবং গামা-রশ্মি। তরঙ্গ রশ্মির সমস্যা হলো, এরা গতিপথে সুস্থ কিংবা ক্যান্সার প্রতিটি কোষের ক্ষতি করে থাকে। তাই কিছু বিকিরণ থেরাপিতে বিভিন্ন ফোকাসিং পদ্ধতি ব্যবহার করে তরঙ্গের পুরো শক্তি শুধুই টিউমারে ঢেলে দেয়া হয়। এরকম একটি প্রযুক্তি হলো গামা-ছুরি (Gamma knife), গামা-ছুরি ব্যবহার করা হয় মস্তিষ্কের টিউমারে। গামা-ছুরিতে প্রায় ২০০টি গামা-রশ্মির উৎস ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি উৎসের বিকিরণ মাত্রা কম, তাই এককভাবে এরা স্বাভাবিক কোষের তেমন ক্ষতি করতে পারে না। এই উৎসগুলোকে মস্তিষ্কের টিউমারের এমনভাবে ফোকাস করা হয় যে, সমস্ত উৎসের শক্তি সম্মিলিতভাবে শুধুই টিউমারের উপর গিয়ে পড়ে। ফলে, তরঙ্গ গতিপথে স্বাভাবিক কোষের ক্ষতি বহুলাংশে কমে যায়।
অপেক্ষাকৃত আধুনিক কিন্তু ব্যয়বহুল বিকিরণ থেরাপিতে কণা-বিকিরণ ব্যবহার করা হয়। একে বলে প্রোটন-থেরাপি। এতে বিশাল বৃত্তাকার পার্টিকেল-এক্সসেলারেটরের মাধ্যমে উচ্চ ভরবেগের প্রোটোনকে টিউমার কোষে পাঠিয়ে দেয়া হয়; আর প্রোটন তার ভরবেগের বিশাল অংশ শক্তি হিসেবে টিউমারে ঢেলে দেয়। ব্রাগ-পিকিং (Bragg peak) পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রোটন-রশ্মির ফোকাস এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় যে, সমস্ত গতিপথে প্রোটনের ভরবেগ থাকে নূন্যতম কিন্তু ফোকাস বিন্দুতে প্রোটনের ভরবেগ হয় সর্বোচ্চ (Peak)। তাই প্রোটন-বিকিরণে স্বাভাবিক কোষের ক্ষতি হয় না বললেই চলে। তরঙ্গ-বিকিরণের চেয়ে প্রোটন থেরাপি অনেক নিরাপদ। চোখের ক্যান্সার যেমন কোরোইডাল-মেলানোমা (Choroidal melanoma) চিকিৎসায় এটা অত্যন্ত সফল একটা পদ্ধতি।
আগেই বলা হয়েছিলো, তরঙ্গ বিকিরণে উচ্চ শক্তির ফোটন নিঃসরণ ঘটে; আর কোষের বিভিন্ন অণু এই ফোটনগুলো শোষণ করে। এই শোষণ মাত্রার এককে বলে গ্রে (Grey)। গ্রে হলো শরীরের প্রতি একক ওজনের বিপরীতে শোষিত শক্তির পরিমাণ (বা শোষিত-শক্তি/শরীরের-ওজন)। গ্রেয়ের হিসাব নিচে দেয়া হলো:
১ জুল/কিলোগ্রাম = ১ রাড (Rad)
১০০ রাড = ১ গ্রে
এই ১ গ্রে বিকিরণ শরীরের এক লক্ষ অণুকে আয়নে পরিণত করতে পারে। এই পরিমাণের আয়ন DNAয়ের প্রায় ১০হাজার সিঙ্গেল-স্ট্র্যান্ড এবং ৪০টি ডাবল-স্ট্র্যান্ড ভাঙ্গনের জন্য দায়ী, এতে টিউমারের প্রায় ৯০% কোষ মারা যায়। একজন সাধারণ পেশাজীবী মানুষ সারা জীবনে প্রায় ০.১৬ গ্রে বিকিরণের মুখোমুখি হয়। অন্যদিকে, ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় প্রায় ৬০গ্রে। সমস্যা হলো, প্রযুক্তিগত কারণে গামা-ছুরি বাদে বেশিরভাগ বিকিরণ চিকিৎসায় তরঙ্গকে ফোকাস করা যায় না। এই ৬০গ্রে বিকিরণ একবারে দেয়া হোলে টিউমারের পাশাপাশি তরঙ্গ গতিপথের পড়ে যাওয়া ৯০% সুস্থ কোষও মারা যাবে। তাই বিকিরণ এবং কেমোথেরাপি চিকিৎসায় বিকিরণ বা ঔষধের পুরো মাত্রাকে স্বল্পমাত্রার একাধিক ডোজে ভাগে করে কাছাকাছি সময় ব্যবধানে প্রয়োগ করা হয়, একে বলে ডোজ-ফ্রাকশনেশন (Dose fractionation)।
ক্যান্সার কোষ দ্রুত বিভাজিত হয়, তাই ক্যান্সার কোষ DNA মেরামতের যথেষ্ট সময় পায় না, ফলে ক্যান্সার কোষে মিউটেশন সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে। অন্যদিকে সুস্থ কোষ বিভাজিত হয় ধীরে ধীরে, তাই DNA মেরামতে এরা যথেষ্ট সময় পায়। ডোজ-ফ্রাকশনেশন মূলনীতি হলো, স্বল্প ডোজ ক্যান্সার এবং সুস্থ কোষ দুটোরই সমান ক্ষতি করে। কিন্তু ডোজগুলোর মাঝে সময় ব্যবধান এমনভাবে নির্ধারণ করা হয় যাতে সুস্থ কোষ DNA মেরামত করতে সক্ষম হয়, অন্যদিকে ক্যান্সার কোষের পক্ষেDNA মেরামত সম্ভব হয় না। ফলে পূর্ণ ডোজ শেষে আশা করা যায় যে, সুস্থ কোষ বিভিন্ন ডোজের ক্ষতি সামলে উঠতে পারবে; কিন্তু ক্যান্সার কোষে DNAয়ের ক্ষতিগুলো পুঞ্জিভূত হতে হতে শেষ পর্যন্ত কোষকে এপোপটোসিসের দিকে ঠেলে দেবে।
একটি বিশেষ ধরণের বিকিরণ চিকিৎসার নাম ব্র্যাসিথেরাপি (Brachytherapy)। এই চিকিৎসায় তেজস্ক্রিয় পদার্থের তৈরি গুটি শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে টিউমার অঞ্চলে স্থাপন করা হয়, চিকিৎসার শেষে এই গুটিগুলো বের করে আনা হয়। মস্তিষ্ক এবং অন্ত্রের ক্যান্সারে এই পদ্ধতিটি প্রচলিত। এই চিকিৎসায় রোগীর দেহ থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ পরিবেশে ছড়িয়ে যেতে থাকে, তাই চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে রোগীকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখা হয়।
কিছু কিছু কোষের DNA মেরামত ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি যেমন: স্তন, কিডনি, অগ্নাশয় (Pancreas); এইসব অঙ্গের ক্যান্সার কোষ দ্রুত বিকিরণের ক্ষতি সামলে ওঠে। তাই বিকিরণ থেরাপি এইসব ক্যান্সারে কার্যকর নয়।
বিকিরণ থেরাপির একটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হলো, স্টেমসেল নষ্ট হয়ে যাওয়া। বিশেষে করে রক্তের স্টেমসেল যেটা অস্থিমজ্জায় পাওয়া যায়। ক্যান্সারের কারণেও এই অস্থিমজ্জার ক্ষতি হতে পারে। তাই কিছু বিকিরণ থেরাপিতে রোগীর সুস্থ অস্থিমজ্জার সংরক্ষণ করা হয়, এই স্ব-দাতাদের বলে অটোলোগাস (Autologous)। শারীরিক অবস্থার কারণে রোগী যদি অটোলোগাস হতে না পারেন, তবে তার জেনেটিক-অভিন্ন যমজ থেকেও অস্থিমজ্জা নেয়া যেতে পারে, এই ধরণের দাতাদের বলে সিনজেনেরিক (Syngeneic)। সিনজেনেরিক দাতা না থেকে থাকলে অ্যালোজেনেটিক (allogeneic) দাতা থেকেও অস্থিমজ্জা নেয়া যেতে পারে। অ্যালোজেনেটিক দাতারা হলেন তারা, যাদের HLA বা হিউমান-লিউকোসাইট-এন্টিজেন (Human leukocyte antigen ) জিনগুচ্ছ রোগীদের সাথে মিলে রয়েছে। HLA-A সিস্টেম কাজ হলো ইমিউনিটি-সিস্টেমকে “নিজ” এবং “অন্যের” উপাদানের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণে সাহায্য করা। HLA জিনগুচ্ছের কাজ MHC বা মেজর-হিসটোকমপ্যাটিবিলিটি-কমপ্লেক্স শ্রেণীর প্রোটিন উৎপাদন করা, এই MHC দিয়ে শ্বেতকণারা বিভিন্ন প্যাথোজেনের ইমিউনো-প্রেজেন্টেশন তৈরি করে। বিকিরণ থেরাপি শেষে প্রয়োজনে এই অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় পঞ্চাশ হাজার অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন চিকিৎসা দেয়া হয়।
ক্যান্সার যখন মেটাস্টেসিস পর্যায় পৌঁছে তখন একমাত্র প্রচলিত চিকিৎসা হলো কেমিক্যাল বা কেমোথেরাপি। কেমোথেরাপি হলো সম্পূর্ণভাবে রক্তবাহিত চিকিৎসা। তাই কেমোথেরাপি ঔষধের ডোজ নির্ধারণে তিনটি বিষয়ে জোর দেয়া হয়:
ফার্মাকোকাইনেটিক্স (Pharmacokinetics): যকৃৎ কি পরিমাণ ঔষধ রক্তে মেশাতে সক্ষম, রক্তে পৌঁছে অন্য কোনো উপাদানের সাথে ঔষধের বিক্রিয়া, কিডনির মাধ্যমের ঔষধের রক্ত থেকে অপসারণ, ইত্যাদি।
ফার্মাকোডাইনামিক্স (Pharmacodynamics): টিউমার কোষের এঞ্জিয়োজেনেসিস, টিউমার কোষে ঔষধ প্রবেশের পরিমাণ, টিউমার কোষে ঔষধের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।
ফার্মাকোজিনোমিক্স(Pharmacogenomics): জিনগত ভিন্নতার কারণে ঔষধের প্রতি রোগীর সংবেশনশীলতা।
এই তিনটি বিষয় গাণিতিকভাবে পরিমাপের মাধ্যমে ব্যক্তিবিশেষের জন্য ঔষধের ডোজ নির্ধারণ করা হয়। বিভিন্ন কেমোথেরাপি ঔষধের কার্যপ্রণালী বা ফার্মাকোডাইনামিক্স বিভিন্ন প্রকারের। নিচে কিছু ঔষধ কোষ বিভাজন চক্রের কোন পর্যায় কাজ করে সেটা দেখানো হয়েছে।
প্রায় সব কেমোথেরাপিতে বিভিন্ন ঔষুধের সমন্বয় ব্যবহার করা হয়। নিচে এমন কিছু প্রচলিত সমন্বিত ঔষধ এবং সংশ্লিষ্ট ক্যান্সারের নাম উল্লেখ করা হলো।
কিছু কিছু কেমোথেরাপি ঔষুধ সাইটোস্ট্যাটিক (Cytostatic), এরা কোষ বিভাজন থামিয়ে দেয়। ক্যাপাসিটাবিন (Capecitabine) একটি খাবার ঔষুধ, যেটা 5-fluorouraci নামের ফ্লোরিনযুক্ত একটি অণু রক্তে মিশিয়ে দেয়। ফ্লোরিনের মাধ্যমে 5-fluorouraci অণুগুলো কোষে T-বেস বা থায়মিন তৈরির জন্য দায়ী এনজাইমের সাথে আটকে যায়, এতে একজাইমগুলো অকেজো হয়ে যায়। ফলে কোষ DNA মেরামত কিংবা প্রতিলিপি তৈরি করার মতো থায়মিন উৎপাদন করতে পারে না। ফলে কোষ বিভাজন থেমে যায় এবং কোষের সময়মতো এপোপটোসিস ঘটে। এই ঔষধ স্তন, গলা, চর্ম, এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসায় করা হয়।
আরো একটি প্রাকৃতিক সাইটোস্ট্যাটিক ঔষধ হলো ভিনক্রিসটিন (Vincristine), এটা তৈরি হয় Periwinkle উদ্ভিদ থেকে। সাইটোপ্লাসোমের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত উপাদান হলো মাইক্রোটিউব্যাল (Microtubules) প্রোটিন। এই মাইক্রোটিউব্যাল অনেকটা নলের মতো; এরা দ্রুত লম্বা হতে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যে পৌঁছানোর পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভেঙ্গে পড়ে। এই মাইক্রোটিউব্যালগুলোর একটি কাজ হলো বিভাজিত হতে থাকা কোষের নতুন কেন্দ্র নির্ধারণ, এবং বিভাজত DNAদের নতুন কেন্দ্রে টেনে নিয়ে যেতে সাহায্য করা (অনেকটা রেললাইনের মতো)। ভিনক্রিসটিন এই মাইক্রোটিউব্যালদের লম্বা হতে বাধা দেয়, ফলে বিভাজত DNA আলাদা হতে পারে না।
সিসপ্ল্যাটিনের (Cisplatin) কাজ হলো DNAয়ের স্ট্র্যান্ড দুটিকে শক্ত করে জোড়া লাগিয়ে দেয়া, ফলে রেপ্লিকেশন বা ট্রান্সক্রিপশনের সময় DNA স্ট্যান্ড দুটো খোলা সম্ভব হয় না। সিসপ্ল্যাটিন কাজ করে অনেকটা মাস্টার্ড-গ্যাস এবং ম্যাস্টিনের মতো। মাস্টার্ড-গ্যাস এবং ম্যাস্টিনের মধ্যে পার্থক্য হলো, প্রথমটিতে সালফার এবং দ্বিতীয়টিতে নাইট্রোজেন ব্যবহার করা হয়। মাস্টার্ড-গ্যাসের ব্যবহার আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ তাই ক্যান্সার গবেষণায় ম্যাস্টিন ব্যবহার করা হয়। ম্যাস্টিন DNAয়ের বিপরীত স্ট্র্যান্ডে থাকা G-বেস দুটিকে স্থায়ীভাবে জোড়া লাগিয়ে দেয়।
সাইক্লোফসফামাইড (Cyclophosphamide) DNAয়ের G-বেসের সাথে যুক্ত হয় এবং G-বেসের বিকৃতি ঘটায়। পুরো DNA জুড়ে G-বেসের বিকৃতি ঘটলে রেপ্লিকেশননের সময় বিপুল পরিমাণে বিভ্রাট ঘটে যেটা কোষের পক্ষে সংশোধন করা সম্ভব হয় না, ফলে কোষের এপোপটোসিস ঘটে। ডক্সরুবিসিন (Doxorubicin) DNAয়ের স্ট্র্যান্ড দুটির মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং স্ট্র্যান্ড দুটিকে ফাঁক করে ধরে রাখে, এতে রেপ্লিকেশনের সময় প্রচুর বিভ্রাট ঘটে থাকে। ইনিপ্যারিবের (Iniparib) কাজ হলো DNA মেরামত যন্ত্রাংশকে অচল করে দেয়া। এসব ঔষধগুলোর কাজই হলো কোষের DNAয়ের ক্ষতির মাধ্যমে এপোপটোসিসের দিকে ঠেলে দেয়া। দ্রুত এপোপটোসিস ঘটানোর কারণে এই ঔষুধদের বলে সাইটোটক্সিক (Cytotoxic)।
আমরা এস্ট্রোজেনজনিত স্তন এবং জরায়ুর ক্যান্সারের কথা বলেছিলাম। টেমোক্সিফেন (tamoxifen) উত্তেজিত করা ছাড়াই এস্ট্রোজেন-রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়, ফলে এস্ট্রোজেন যুক্ত হবার মতো রিসেপ্টরের সংখ্যা কমে যায়। অন্যদিকে, এনেস্ট্রোজোলের (Anastrozole) কাজ এস্ট্রোজেন এবং টেস্টোস্টেরোন হরমোনের নিঃসরণ বদ্ধ করা।
আগেই বলা হয়েছিলো যে, ক্রোমোসোমে DNA প্যাঁচানো বা জট পাঁকানো অবস্থায় থাকে। তাই DNAয়ের কোনো অংশ নিয়ে কাজ করার সময় কোষকে এই জট খুলতে হয়, আর এটা করতে কোষকে আশপাশের DNA স্ট্র্যান্ডগুলোকে সাময়িকভাবে খোলা এবং জোড়া লাগাতে হয়। নিচের ছবির মাধ্যমে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। DNAয়ের জট খোলার কাজটি করে একটি এনজাইম নাম টোপোইসোমারেস (Topoisomerase)। ইটোপোসাইড (Etoposide) হলো ম্যাপল গাছে পাওয়া উপাদান থেকে তৈরি একটি সাইটোস্ট্যাটিক ঔষধ, এটি টোপোইসোমারেসকে জট খুলতে দেয়া না, ফলে ক্রোমোসোম একপ্রকার ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে।
এতোক্ষণ যেসব কেমোথেরাপি ঔষুধের কথা বলা হলো তাদের তুলোনা করা চলে এক্স-রে বিকিরণ থেরাপির সাথে, এরা ক্যান্সার কিংবা সুস্থ যেকোনো কোষের সমান ক্ষতি করে। ফলে এদের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া খুব বেশি। কেমোথেরাপির একটা সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হলো তীব্র বমি বমিভাব (Nausea)। নিচে কিছু প্রচলিত ক্যান্সার কেমোথেরাপির ঔষুধ এবং শরীরের যে অঙ্গে তাদের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সেগুলো দেখানো হলো। তাই কেমোথেরাপি চলাকালীন সময়ে রোগীকে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অবদমনকারী ঔষধও দিতে হয়।
কিছু কিছু ঔষুধ রয়েছে যেগুলো শুধুই সুনির্দিষ্ট টিউমারের ওপর কাজ করে, অনেকটা গামা-ছুরির মতো। ফলে, এদের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অন্যদের তুলোনায় অনেক কম। এরকম লক্ষ্য নির্ধারিত একটি কেমোথেরাপি ঔষধ হলো স্যানিটিনিব (Sunitinib)। এর ব্যবহার কিডনি বা রেনাল ক্যান্সারে। কিডনি ক্যান্সারের বৈশিষ্ট্য হলো, টিউমারের ব্যাপক এঞ্জিয়োজেনেসিস ঘটে এবং এই এঞ্জিয়োজেনেসিসের সময় প্রচুর সিগন্যালিং প্রোটিন ব্যবহার করা হয়। স্যানিটিনিবের লক্ষ্যবস্তু হলো এই এঞ্জিয়োজেনেসিস সম্পর্কিত প্রোটিন-সিগন্যালিং। নিচের কেপ্ল্যান-ম্যায়ার-স্যারভাইভাল রেখাচিত্রে স্যানিটিনিব বনাম প্রচলিত ঔষুধের তুলোনা দেখানো হলো। লক্ষ্য নির্ধারিত কেমোথেরাপি ঔষধগুলো অপেক্ষাকৃত নতুন। এগুলো তৈরিতে সমস্যা হলো, টিউমারের এমন বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করা যেটা স্পষ্টভাবে শুধুই টিউমারকে চিহ্নিত করে। নিচে কিছু ক্যান্সার এবং সংশ্লিষ্ট লক্ষ্য দেয়া হলো, এই লক্ষ্যগুলোর সবগুলোই টিউমার নিঃসরিত সিগন্যালিং প্রোটিন। বেশিরভাগ ক্যান্সার টিউমারের দ্রুত মিউটেশন চলতে থাকে, এতে টিউমারের বৈশিষ্ট্যেরও পরিবর্তন ঘটে, ফলে এই ধরণের ঔষধগুলোর লক্ষচ্যুতি ঘটে খুব তাড়াতাড়ি। অধিকাংশ ক্যান্সার দ্রুত এইসব ঔষধ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।
ক্যান্সার চিকিৎসার তিনটি ফলাফল হতে পারে; রিমিশন (Remission): চিকিৎসার ৫ বছর পরেও যদি কোনো দৃশ্যমান টিউমার ধরা না পড়ে, তবে লুকোনো ক্যান্সার কোষ থাকে পারে। আরোগ্য (Cured): চিকিৎসার ১০ বছর পরেও যদি কোনো টিউমার ধরা না পড়ে। টিউমার নিয়ন্ত্রণ: টিউমারের বিকাশ বন্ধ থাকা। কেমোথেরাপির ফলাফল আরোগ্য হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বিরল। কেমোথেরাপির আরেকটা সমস্যা হলো ক্যান্সার টিউমার দ্রুত নির্দিষ্ট ঔষধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।ঔষধ প্রতিরোধের একটি প্রধান উপায় হলো পাম্পিং। অনেক প্রতিরোধী ক্যান্সার প্রচুর মেমব্রেন-বাউন্ড প্রোটিন-পাম্প তৈরি করে, এই প্রোটিন-পাম্পগুলো দ্রুত ঔষুধ কোষ থেকে বের করে দেয়। এই পাম্পিংয়ের কারণে ঔষধ কোষে পৌঁছুতে পারে না। পাম্পিং ছাড়াও ঔষধ নিষ্ক্রিয়করণ, দ্রুত DNA মেরামত, ইত্যাদি পদ্ধতিতে ক্যান্সার কোষ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে; তবে প্রতিটি পদ্ধতির কারণ কোনো না কোনো মিউটেশন।
আগে বলা হয়েছিলো যে, অনেক ক্যান্সার কোষ ইমিউনো-প্রেজেটেশন লুকিয়ে রাখে তাই এরা সহজেই ইমিউনিটি-সিস্টেমকে ফাঁকি দিতে পারে। আমাদের অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেমের দুটি অংশ আছে, হিউমোরাল (Humoral) এবং সেলুলার (Cellular)। হিউমোরাল অংশটি বি-সেল দিয়ে গঠিত, বি-সেলের কাজ এন্টিবডি তৈরি করা, এরা সরাসরি প্যাথোজেন ধ্বংস করে না। অন্যদিকে সেলুলার অংশটি টি-সেল দিয়ে গঠিত, টি-সেলের কাজ কোনো নির্দিষ্ট প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেমকে কার্যকর করা বা নিষ্ক্রিয় করা, কিছু টি-সেল সরাসরি প্যাথোজেন ধ্বংস করে, এদের বলে কিলার-টি-সেল।
ক্যান্সার টিউমার কিছু কিছু প্রোটিন অতিরিক্তি পরিমাণের তৈরি করে। যেমন: ফুসফুসের, স্তন, কোলন, জরায়ুসহ বিভিন্ন ক্যান্সারে MUC1 জিনের অতিরিক্ত প্রকাশ পায়। গবেষণাগারে এই MUC1 প্রোটিনকে কোনো প্যাথোজেনের মেমব্রেনে বসিয়ে দেয়া হয়। ফলে, MUC1 হয়ে যায় প্যাথোজেনটিকে শনাক্তকারী এন্টিজেন। এই প্রস্তুতকৃত প্যাথোজেনটিকে ভ্যাকসিন আকারে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করলে অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেম দ্রুত MUC1য়ের ইমিউনো-প্রেজেন্টেশন তৈরি করে এবং MUC1 এন্টিজেনযুক্ত যেকোনো কোষ ধ্বংস করতে শুরু করে। এই MUC1 এন্টিজেন ভ্যাকসিন ব্যবহার করে ফুসফুসের ক্যান্সার রোগীর ২৪মাসের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কালকে প্রায় দ্বিগুণ করা গেছে। এন্টিজেন ভ্যাকসিন এখনো উন্নয়নের ধাপে রয়েছে।
যুদ্ধ শেষে কোনো নির্দিষ্ট প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে অ্যাকোয়ার্ড-ইমিউনিটি-সিস্টেমকে নিষ্ক্রিয় করা হয়। এই নিষ্ক্রিয়করণ কাজটি করে APC বা এন্টিজেন-প্রেজেন্টিং-সেল (Antigen-presenting cell)। APCয়ের একটি কাজ হলো কিলার-টি-সেলের CTLA-4 রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হওয়া এবং এতে কিলার-টি-সেল নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আর্ভয় (Yervoy) নামের ঔষধের কাজ হলো কিলার-টি-সেলের CTLA-4কে বন্ধ করে দেয়া, যাতে APC কোনোভাবেই টি-সেলের CTLA-4 ব্যবহার করতে না পারে। ফলে, কিলার-টি-সেল অনবরত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।
আর্ভয় একটি এন্টিবডি ভিত্তিক ক্যান্সার ভ্যাকসিন। কেমোথেরাপি ঔষধের সাথে এন্টিবডি ভ্যাকসিনের পার্থক্য হলো, কেমোথেরাপি সিগন্যালিং-রিসেপ্টরসহ আস্ত কোষ ধ্বংস করে দেয়, অন্যদিকে এন্টিবডি ভ্যাকসিনগুলো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে শুধু সিগন্যালিং-রিসেপ্টরদের কার্যত অচল করে দেয়। এই এন্টিবডিগুলো গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত করা হয়। এন্টিবডিগুলো বিভিন্ন সিগন্যালিং-রিসেপ্টর প্রোটিনকে এন্টিজেন হিসেবে শনাক্ত করে। নিচে কিছু এন্টিবডি ভ্যাকসিন এবং তাদের এন্টিজেন উল্লেখ করা হলো।
কিছু কিছু এন্টিবডির সাথে তেজস্ক্রিয় সমাণু জুড়িয়ে দেয়া হয়, ফলে এন্টিবডিগুলো শুধু ক্যান্সার কোষের সিগন্যালিং বন্ধই করে না একই সাথে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে দেয়। এই ধরণের চিকিৎসাকে বলে রেডিওইমিউনো থেরাপি। লিম্ফোমার ক্ষেত্রে কেমোথেরাপির পাশাপাশি তেজস্ক্রিয় আয়োডিনযুক্ত এন্টিবডি ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়।
ক্যান্সারের চিকিৎসায় সবচেয়ে অগ্রবর্তী এবং নিরীক্ষাধীন পদ্ধতি হলো জিন থেরাপি। ক্যান্সারের ক্ষেত্রে জিন থেরাপি তখনই দেয়া হয় যখন অন্য সকল চিকিৎসা ব্যর্থ হয়। জিন থেরাপি তিন ধরণের হতে পারে। জিন প্রতিস্থাপন: এটা টিউমার-সাপ্রেশন-জিনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। RNA ইন্টারফেরেন্স: এতে microRNA ব্যবহারের মাধ্যমে অংকোজিনের ট্রান্সলেশন বন্ধ করে দেয়া হয়। RNA ইন্টারফেরেন্স পদ্ধতিটি আগের পর্বে আলোচনা করা হয়েছে। সবশেষ পদ্ধতিটি হলো টিউমার ভাইরাস।
জিন প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে টিউমার কোষে টিউমার-সাপ্রেশন-জিন প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রতিস্থাপনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় ভাইরাস। প্রথমে উপযুক্ত ভাইরাস খুঁজে বের করতে হয়, যেমন: ফুসফুসের ক্যান্সার চিকিৎসায় ফুসফুসের কোষ আক্রমণ করতে পারে এমন ভাইরাস প্রয়োজন। এরপর ভাইরাসের DNA বের করে প্রজনন সম্পর্কিত জিন কেটে বাদ দেয়া হয় এবং কাটা অংশে স্বাভাবিক টিউমার-সাপ্রেশন-জিনের জুড়িয়ে দেয়া হয়। সবশেষে, ক্যান্সার টিউমারকে ঐ ভাইরাস দিয়ে সংক্রমিত করা হয়।
কিছু কিছু ভাইরাস আছে যারা শুধুই টিউমার কোষে বংশবিস্তার করতে পারে, এদের বলে অংকোল্যাটিক ভাইরাস (Oncolytic virus)। এদের প্রজনন প্রক্রিয়ায় টিউমার কোষের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু স্বাভাবিক কোষের এরা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। রিওভাইরাস (Reovirus) এমনই একটি অংকোল্যাটিক ভাইরাস, এদের সক্রিয় করতে দরকার RAS জিনের প্রকাশ। স্বাভাবিক কোষের RAS জিনের প্রকাশ একেবারেই মন্থর, তাই রিওভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় থেকে। কিন্তু, ক্যান্সার কোষের যখন RAS ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেতে থাকে তখন ভাইরাসটি সক্রিয়ভাবে প্রজনন শুরু করে, ফলে কোষ ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে পড়ে। ভাইরাস প্রজননের শেষ পর্যায় কোষের মৃত্যু ঘটে। কোলন ক্যান্সারে এই চিকিৎসাটি এখনো নিরীক্ষাধীন রয়েছে, তবে ফলাফল আশাপ্রদ।
আগের পর্ব: অংকোজিন এবং টিউমার-সাপ্রেশন-জিন
অবলম্বনে: “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “What Science Knows about Cancer” by “David Sadava”