রুশ পদার্থবিদ ম্যাটভেই ব্রনস্টেইন (Matvei Bronstein) ১৯৩০ সালে দুটি জার্নালে স্থানকালের সম্ভাব্য কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা দেন। ব্রনস্টেইনের হিসাব অনুসারে, স্থান নিরবিচ্ছিন্ন নয়। বরং, স্থানকে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বিভাজন করা সম্ভব। এই সীমা হলো, L(p)
এখানে, ћ = রিডিউসড প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক, G = নিউটনের মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, এবং c = আলোর গতি। এই তিনটি ধ্রুবক একই সমীকরণে ব্যবহার করার মানে হলো, আমরা এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি যেটা মাধ্যাকর্ষণ (G), আপেক্ষিকতা (c), এবং কোয়ান্টাম-মেকানিক্স (ћ) তিনটির সাথেই সম্পৃক্ত। ওপরের সমীকরণকে সমাধান করা হলে, L(p)য়ের মান পাওয়া যায় ১০^(-৩৩) সেন্টিমিটার। এই L(p)কে বলে প্ল্যাঙ্ক-দৈর্ঘ্য (যদিও এর আসল নাম হওয়া উচিত ছিলো ব্রনস্টেইন-দৈর্ঘ্য)। প্ল্যাঙ্ক-দৈর্ঘ্য পরিসরে কোনো পর্যবেক্ষণ সম্ভব নয়, সঠিকভাবে বললে প্ল্যাঙ্ক-দৈর্ঘ্যে শক্তি বা পদার্থ কোনো কিছুই থাকতে পারে না। ধারণা করা হয়, এই অতিক্ষুদ্র অঞ্চলে স্থানকাল তার চির পরিচিত ক্ল্যাসিকাল রূপ ঝেড়ে ফেলে কোয়ান্টাম রূপ ধারণ করে। অর্থাৎ, প্ল্যাঙ্ক-দৈর্ঘ্যে শুধুই যে জিনিসটা পাওয়া সম্ভব সেটা হলো, স্থানকালের কোয়ান্টা।
স্থানকালের কোয়ান্টা কেমন হতে পারে তার ওপর সবচেয়ে বেশি অবদান জন হুইলারের। হুইলার ছিলেন একই সাথে নিলস বোরের ছাত্র, আইনস্টাইনের সহকর্মী, অন্যদিকে ফাইনম্যানের মতো মহারথীদের শিক্ষক। ১৯৬৬ সালে সহকর্মী ব্রেসি ডিউইট (Bryce Dewitt) স্থানের তরঙ্গ-ফাঙ্কশন সম্পর্কিত একটি সমীকরণ হুইলারকে দেখান। এর কিছুদিন আগে আশার পেরেস (Asher Peres) সাধারণ-আপেক্ষিকতার হ্যামিল্টন-জাকোবি সমীকরণ তৈরি করেছিলেন। পেরেসের সমীকরণে ডেরিভেটিভের বদলে ডেরিভেটিভ-অপারেটর বসিয়ে ডিউইট স্থানের তরঙ্গ-ফাঙ্কশনে বের করেন। যা হোক, হুইলার এবং ডিউইটের প্রচেষ্টায় সমীকরণটিকে সাধারণ-আপেক্ষিকতার Equation of Orbital হিসেবে গণ্য করা হতো, পরবর্তীতে এটা হুইলার-ডিউইট সমীকরণ নামে পরিচিতি পায়।
শুরুর দিকে হুইলার-ডিউইট সমীকরণটির একটা বিরাট সমস্যা ছিলো, সেটা হলো, সমীকরণে কোনো t বা সময় চলরাশি ছিলো না। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে যেকোনো ডাইনামিক সমীকরণে t ব্যবহার করা হয়, যেটা সময়ের সাথে সাথে কোনো ফিল্ডের বিকাশ ব্যাখ্যা করে। তাই সময়হীন হুইলার-ডিউইট সমীকরণের তাৎপর্য একেবারেই স্পষ্ট ছিলো না। ১৯৮০ সালের দিকে হুইলার-ডিউইট সমীকরণের সমাধান পাওয়া যেতে শুরু হয়। ভারতীয় পদার্থবিদ অভয় এস্তেখার (Abhay Ashtekar) সমীকরণটিকে একটি সরল রূপ দেন। অন্যদিকে, মার্কিন পদার্থবিদ লি স্মোলিন এবং টেড জ্যাকোবসন যৌথভাবে অভয়ের সরলীকৃত সমীকরণটির একটি অদ্ভুত সমাধান বের করেন। অদ্ভুত বলার কারণ হলো, সমাধানগুলো নির্ভর করে এমন স্থানের ওপর যেটা দুই প্রান্ত জোড়া লাগানো রেখার মতো। এধরণের দুই প্রান্ত জোড়া লাগানো রেখাকে বলে লুপ। স্মোলিন-জ্যাকোবসন পদ্ধতিতে হুইলার-ডিউইট সমীকরণের প্রতিটি লুপের আলাদা আলাদা সমাধান বের করা সম্ভব। এভাবেই লুপ-থিওরি বা লুপ-কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটির যাত্রা শুরু। স্মোলিন-জ্যাকোবসন পদ্ধতিতে পাওয়া হুইলার-ডিউইট সমীকরণ থেকে স্থানের কোয়ান্টাম রূপের যে ছবি পাওয়া যায় সেটা এরকম,
যদিও ওপরের ছবিটা কাল্পনিক, তবে এটা থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট। প্ল্যাঙ্ক-দৈর্ঘ্যে স্থানের Discrete বা বিচ্ছিন্ন কাঠামো রয়েছে। এই কাঠামো দেখতে অনেকগুলো লুপের বুননের মতো। আর্জেন্টাইন বিজ্ঞানী জর্জ পলিন (Jorge Pullin) এবং পোলিশ বিজ্ঞানী জার্জি লিওয়ান্ডোস্কি (Jerzy Lewandowski) সর্বপ্রথম ধারণা দেন যে, স্মোলিন-জ্যাকোবসনের সমাধানগুলোর মূল ফিজিক্স নির্ভর করে লুপগুলো ছেদবিন্দুতে, যাকে বলে নোড (Node) এবং এই নোডগুলোর সংযোজক রেখা, যাকে বলে লিংক (Links)। আর, কিছু নোড এবং লিংক মিলিয়ে তৈরি হয় একটি গ্রাফ (Graph),
পলিন এবং লিওয়ান্ডোস্কির হিসাব অনুসারে, নোড ছাড়া স্থানের কোনো ঘনত্ব (volume) থাকতে পারে না। অন্যভাবে বললে, স্থানের ঘনত্ব অবস্থান করে নোডে, এবং স্থানের আয়তন অবস্থান করে লিংকে। লিংকের কাজ হলো, আয়তনের মাধ্যমে একাধিক নোডে অবস্থিত ঘনত্বগুলোকে সংযুক্ত রাখা। প্রতিটি নোডকে বলা চলে ঘনত্বের আলাদা আলাদা প্যাকেট। ফোটনের শক্তিস্তরের মতোই নোডের মানও Discrete, অর্থাৎ, চাইলেই নোড যেকোনো মান নিতে পারে না।
নোড হলো স্থানের মৌলিক কোয়ান্টা, স্থান-কণা। আর, গ্রাফ হলো স্থানের কোয়ান্টাম-স্টেট। গ্রাফে প্রতিটি নোডকে v এবং প্রতিটি লিংকে অর্ধ-পূর্ণসংখ্যা j য়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় (নিচের ছবি)। j য়ের এই অর্ধ-পূর্ণসংখ্যা স্ট্যান্ডার্ড-মডেল কণাদের স্পিনের সাথে তুলোনা করা চলে। তাই, v ও j য়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা গ্রাফকে বলে স্পিন-নেটওয়ার্ক (Spin Network)।
এই স্পিন-নেটওয়ার্কে প্রতি স্থান-কণা বা নোডের (v) অবস্থান নির্ভর করে লিংকের (j) ওপর। অর্থাৎ, অনেকগুলো নোডের সাপেক্ষে কোনো নির্দিষ্ট নোড কোথায় অবস্থিত সেটা নির্ভর করে লিংকের ওপর। ধরুন, আমরা যদি ওপরের v(১) নোড থেকে যাত্রা শুরু করলাম এবং ৫/২ লিংক ধরে এগুতে থাকলাম। এবং যাত্রা শেষে আমরা ঘুরপথে ১/২ লিংক ধরে আবার v(১) ফিরে আসলাম, এই ধরণের স্পিন-নেটওয়ার্ক একটি বদ্ধ-সার্কিটের মতো। আর, বদ্ধ-সার্কিট ধরণের স্পিন-নেটওয়ার্ক স্থানকালের বক্রতা নির্দেশ করে।
স্পিন-নেটওয়ার্ক স্থানের কোয়ান্টাম-স্টেট। তাই যেকোনো কোয়ান্টাম-স্টেটের মতোই একটি স্পিন-নেটওয়ার্কের বিকাশও প্রোবাবিলিস্টিক (Probabilistic) ধরণের। ব্যাপারটাকে ইলেক্ট্রনের সাথে তুলোনা করা চলে। একটি পরমাণুতে ইলেক্ট্রন যেমন ইলেক্ট্রন-মেঘ তৈরি করে, একইভাবে স্থান কোনো একক স্পিন-নেটওয়ার্ক দিয়ে তৈরি নয়। বরং, স্থান হলো সম্ভাব্য সব স্পিন-নেটওয়ার্কের সুপারপজিশন-স্টেট বা মেঘ।
আমরা এতক্ষণ শুধুই স্থান নিয়ে আলোচনা করেছি, সময় বা কাল সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। হুইলার-ডিউইট সমীকরণে t বা সময় চলরাশি ছিলো না। এরমানে হচ্ছে, কোয়ান্টাম-লুপ-গ্র্যাভিটিতে সময় বলতে কিছুই নেই। ধরুন, একটি বিলিয়ার্ড বোর্ডে দুটি বল একে অন্যকে আঘাত করে দুই দিকে ছিটকে পড়লো। প্রশ্ন হলো, এই ঘটনাকে আমরা কিভাবে সময় ছাড়া ব্যাখ্যা করবো? আমরা যদি বিলিয়ার্ড বোর্ডের সমান স্থান এবং বল দুটোর আঘাত করার ঘটনাটির আগে ও পরের কিছু সময় বরাবর স্থানকালকে কেটে নিই, তবে আমরা নিচের চারকোণা বাক্সটি পাবো,
লুপ-কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটির দৃষ্টিতে, এই বাক্সটি স্থানকালে মধ্যে অবস্থিত নয়। বরং উল্টো, অর্থাৎ, স্থানকাল এই বাক্সেরই একটি অংশ। এই বাক্সের দুটি সীমানা রয়েছে, Start of the process এবং End of the process। হেইজেনবার্গের একটা অন্তর্দৃষ্টি ছিলো, কোয়ান্টাম মেকানিক্স কোনো সিস্টেমের প্রারম্ভিক অবস্থা এবং শেষ অবস্থা এই দুইয়ের মধ্যকার সম্ভাবনা নির্দেশ করে কিন্তু, কিভাবে সিস্টেম এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পৌঁছালো সেটা ব্যাখ্যা করে না। ওপরের বাক্সটির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, লুপ-কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটি বাক্সের দুই সীমানার মধ্যকার সম্ভাবনা নির্দেশ করে। সীমানা দুটির ভেতরে কোনো নির্দিষ্ট স্থানকাল এবং কণাদের কোনো নির্দিষ্ট গতিপথ থাকে না।
আগেই বলা হয়েছে, স্থানের কাঠামোকে বলে স্পিন-নেটওয়ার্ক। তাহলে প্রশ্ন হলো, ওপরের বাক্সের মধ্যকার স্থানকালের কাঠামো কেমন? উত্তর হলো, স্পিন-নেটওয়ার্কের ইতিহাস। নিচে বাঁয়ের ছবির মতো একটি স্পিন-নেটওয়ার্ক নেয়া যাক। আমরা যদি, স্পিন-নেটওয়ার্কটিকে উপর দিকে ওঠাতে থাকি, তাহলে প্রতিটি নোড একটি রেখা, এবং প্রতিটি রেখা একটি পৃষ্ট তৈরি করবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্পিন-নেটওয়ার্কটির চলার পথে একাধিক নোড যুক্ত হয়ে একটি নোডে, কিংবা উল্টো, একটি নোড বিভক্ত হয়ে অনেকগুলো নোডের জন্ম দিতে পারে।
ওপরের ডানের ছবিটি একটি স্পিন-নেটওয়ার্কের ইতিহাস নির্দেশ করে, এই কাঠোমোর নাম স্পিনফোম (Spinfoam)। একে ফোম বলার কারণ হলো, এই কাঠামো কতগুলো পৃষ্ট দিয়ে তৈরি, যেগুলো কিছু রেখায় মিলিত হয়, আর রেখাগুলো মিলিত হয় কিছু শীর্ষবিন্দুতে (Vertex), অনেকটা সাবানের ফেনার মতো। আর, স্পিনফোম বলার কারণ হলো, প্রতিটি পৃষ্টের নির্দিষ্ট স্পিন (j) থাকে যা একটি লিংকের ইতিহাস বহন করে। এই স্পিনফোমই হলো স্থানকালের কাঠামো বা স্থানকালের কোয়ান্টা।
আমাদের স্থানকাল-বাক্সের ক্ষেত্রে, Start of the process এবং End of the process সীমানা দুটি আলাদা স্পিন-নেটওয়ার্ক। এই দুই স্পিন-নেটওয়ার্কের সম্ভাবনা বের করতে হলে, বাক্সের দুই সীমানার মধ্যকার সমস্ত স্পিনফোমকে হিসাবে আনতে হবে। লুপ-কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটির সমীকরণের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিকে বলে Sum over Spinfoam। এই পদ্ধতিটি মূলত স্ট্যান্ডার্ড-মডেলের ফাইনম্যান-ডায়াগ্রাম এবং ল্যাটিস-এপপ্রক্সিমেশন (Lattice approximation) এইদুটি গাণিতিক পদ্ধতির সমষ্টি। Sum over spinfoam পদ্ধতি ব্যবহার করে সময় ছাড়াই যেকোনো ঘটনার বিকাশ নির্ধারণ করা সম্ভব। নিচে, লুপ-কোয়ান্টাম-গ্রাভিটির সমীকরণগুলো দেয়া হলো,
বলে রাখা ভালো, স্পিনফোমের শীর্ষবিন্দুর কাঠামো একটু জটিল (নিচের ছবির মতো)।
সংক্ষেপে, স্থান একটি স্পিন-নেটওয়ার্ক, যার প্রতিটি নোড একটি মৌলিক স্থান-কণা, এবং প্রতিটি লিংক এই নোডগুলোর সান্নিধ্য বা অবস্থান নির্দেশ করে। স্থানকালের জন্ম হয় যখন একটি স্পিন-নেটওয়ার্ক অন্য আরেকটি স্পিন-নেটওয়ার্কে রূপান্তরিত হয়, Sum over spinfoam য়ের মাধ্যমে। একটি স্পিনফোম একটি স্পিন-নেটওয়ার্কের ইতিহাস নির্দেশ করে। একটি স্পিনফোম একটি স্থানকাল-কণা, যেখানে নোডেরা মিলিত বা বিচ্ছিন্ন হয়।
আধুনিক কোয়ান্টাম ফিজিক্সের ব্যাখ্যা অনুসারে, যেকোনো কোয়ান্টাম ফিল্ডের বিকাশ ঘটে স্থান ও কালের প্রেক্ষাপটে। অর্থাৎ, স্থানকাল হলো একটি ব্যাকগ্রাউন্ড। কিন্তু, লুপ-কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটি একটি ব্যাকগ্রাউন্ড বিহীন তত্ত্ব। অর্থাৎ এই তত্ত্ব অনুসারে, কোনো কোয়ান্টাম-ফিল্ডই স্থানকালের ভেতর অবস্থিত নয়। বরং, স্থানকালের কোনো ভিত্তি ছাড়াই তারা এক অন্যের ওপর সাজানো। এই কোয়ান্টাম-ফিল্ডগুলোর মিথষ্ক্রিয়ার ফলেই জন্ম হয় স্থানকালের। এই ধরণের ব্যাকগ্রাউন্ডহীন কোয়ান্টাম-ফিল্ডকে বলে কোভ্যারিয়ান্ট-কোয়ান্টাম-ফিল্ড (Covariant quantum field)। ধারণা করা হয়, এই মহাবিশ্ব, স্থানকাল, কণা, শক্তি, ইত্যাদির সবই একই কোভ্যারিয়ান্ট-কোয়ান্টাম-ফিল্ডের বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশ।
অবলম্বনে, Reality Is Not What It Seems: The Journey to Quantum Gravity লেখক Carlo Rovelli এবং Simon Carnell।